আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল :প্রথমে গিয়েছিলাম বালি দ্বীপে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার পর ঠিক করলাম ঐতিহাসিক জায়গা হিসেবে এবার না হয় বোরোবুদুর মন্দিরটাই দেখে আসা যাক। বালি দ্বীপ থেকে চলে এসেছিলাম জালান মালিয়েবুরো। বোরোবুদুর যাওয়ার বাসের খোঁজ পাওয়া গেল এখানকার হোটেলের ম্যানেজারের কাছেই। ভদ্রলোক বেশ সাহায্য করলেন। সকালে ‘ছোটমি’ (চিকেন স্যুপ ও ভাত) খেয়ে বোরোবুদুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জালান মালিয়েবুরোর টুরিস্ট তথ্যকেন্দ্রের সামনেই বাসস্ট্যান্ডটা। ছোট ছোট টুরিস্ট বাস ছেড়ে যায় এখান থেকে। বাসস্ট্যান্ডটি বেশ সুন্দর।
চারদিক কাচ দিয়ে ঘেরা। ভেতরে ঢুকতে হয় টিকিট কেটে। জালান মালিয়েবুরো থেকে বোরোবুদুর যেতে লাগবে দুই ঘণ্টা। প্রথমে জালান মালিয়েবুরো থেকে এক ঘণ্টার পথ জুম্বো বাস টার্মিনালে। আবার সেখান থেকে অন্য বাসে করে সোজা বোরোবুদুর। একবারে যাওয়ার কোনো বাস নেই। কী আর করা, উঠে বসলাম এক বাসে। বাসেই পরিচয় হলো জাকার্তা থেকে আসা দুই তরুণ-তরুণীর সঙ্গে। ভিক্টর আর নূরুল। দেশ দেখতে বেরিয়েছে। বালি দ্বীপে যাবে জোকজা হয়ে। ফাঁকে বোরোবুদুর ঘুরতে যাচ্ছে। গন্তব্য একই হওয়ায় আলাপ জমে উঠতে সময় নিল না। আর ইন্দোনেশিয়ানরা বেশ বন্ধুবৎসলও বটে। ওরা জানাল সমস্যা নেই, বোরোবুদুর যেতে আমাকে সাহায্য করবে ওরা। যাক, নিশ্চিন্তে থাকা গেল এমন স্বেচ্ছাসেবক দুই গাইড পেয়ে। আলাপচারিতার একপর্যায়ে জানতে চাইলাম তোমরা কি শুধুই বন্ধু, নাকি প্রেমিক-প্রেমিকাও? জানাল, শুধু ভালো বন্ধু। তোমরা কি বিয়ে করবে? একত্রে ‘নো নো’ করে উঠল। এভাবেই কথাবার্তা জমে উঠল।
জম্বু বাস টার্মিনাল পৌঁছলাম এক ঘণ্টা পর। বাস বদল করে এবার চেপে বসলাম বোরোবুদুর যাওয়ার বাসে। এবারও ঘণ্টাখানেকের পথ। বাসে যাত্রী ওঠার জন্য মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হলো। এ সময় বাসে গিটার নিয়ে গান গাইতে উঠল দুই-তিনজনের একটি দল। গান শুনিয়ে পয়সা নেয় ওরা। তারপর এক বৃদ্ধা মহিলা বাসে উঠলেন সালেক ফল বিক্রি করার জন্য। জাভা আর সুমাত্রাতেই এই ফল হয়ে থাকে। এক প্রকার জোর করেই ভিক্টরের কাছে ফল বিক্রি করলেন মাত্র ১০ হাজার রুপিয়াতে! সালেকের ছাল বেশ শক্ত। ছাল ফেললে ভেতরে তিনটি কোয়া পাওয়া যাবে। দেখতে অনেকটা আমাদের লটকন ফলের মতো। প্রতিটির আবার বীজ আছে, গোল কালো পাথরের মতো। স্বাদ বাংলাদেশের কাঁঠাল ও লিচুর সংমিশ্রণ। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে।
ঘণ্টাখানেক পর বোরোবুদুর এসে পৌঁছলাম। এটা আসলে একটা বৌদ্ধ মন্দির। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মন্দিরও বটে। ৪০৩ ফুট বর্গ আয়তনের ১১৫ ফুট উঁচু এই স্মৃতিস্তম্ভটি একটি ছোট্ট পাহাড়ের ওপর তৈরি হয়েছে ভারতের গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের শিল্পকলার অনুকরণে। মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছে ৮০০ খ্রিস্টাব্দে শৈলেন্দ্র রাজবংশের রাজত্বকালে। বৌদ্ধস্তূপ, মন্দির ও মণ্ডলা অর্থাৎ ধর্মীয় নকশা—এই তিনের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এই মন্দির। এর নিচের দিকে আছে তিনটি গোলাকার চত্বর। গোলাকার অংশ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক আর বর্গাকার অংশ পৃথিবীর প্রতীক। বর্গাকার অংশের কেন্দ্রে সিঁড়ি আছে ওপরে ওঠার জন্য। প্রতিটি ধাপের দেয়ালে দেয়ালে আছে ছোট ছোট কুলুঙ্গি, প্রতিটি কুলুঙ্গির মধ্যে আছে বৌদ্ধ মূর্তি। সর্বোচ্চ বৃত্তাকার চত্বরে ৭৪টি গম্বুজাকৃতির স্তূপের প্রতিটিতে আছে একটি করে বুদ্ধ মূর্তি। প্রায় হাজার বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার ফলে মন্দিরটির স্থাপত্য শিল্পকলা ও সৌন্দর্যের বেশির ভাগই বর্তমানে বিলুপ্ত। ১৯০৭ সালে ওলন্দাজ স্থাপত্য শিল্পীরা মন্দিরটির প্রাথমিক সংস্কার করেছিলেন। এরপর ১৯৭৫ ও ১৯৮২ সালেও আরো সংস্কার করা হয়েছে। ইউনেসকো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেও ঘোষণা করেছে।
বাস থেকে নামার পর পরই কিছু ঘোড়া গাড়ির চালক ঘিরে ধরল তাঁদের গাড়িতে করে বোরোবুদুর যাওয়ার জন্য। যদিও হেঁটেই পাড়ি দেওয়া যেত মন্দিরে যাওয়ার পথটুকু। তার পরও কড়া রৌদ্রের জন্য সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। রওনা হলাম ঘোড়ার গাড়িতে করেই। ভাড়া মাথাপিছু পাঁচ হাজার রুপিয়া। দুই-তিন মিনিটের পথ। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামতেই এবার ঘিরে ধরল টুপি বিক্রেতা আর ছাতাওয়ালারা। নুরুল কিনল একটা টুপি। চারপাশে বেশ দোকানপাট। খাবারদাবারসহ নানা সুভ্যেনির শপ। হেঁটে টিকিট কাউন্টারে এলাম। দেখি, ইন্দোনেশিয়ানদের জন্য আলাদা কাউন্টার ও প্রবেশ মূল্য মাত্র ৩০ হাজার রুপিয়া। বিদেশিদের জন্যও আলাদা টিকিট কাউন্টার আর প্রবেশ মূল্য দুই লাখ ৮০ হাজার রুপিয়া, যা কি না ২২ ডলার। তবে ছাত্র হলে মিলবে ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট। টিকিট কাটার পর বিনা মূল্যে পাওয়া গেল পানি আর কফি। মন্দিরের সম্মানার্থে সবাইকে লুঙ্গির মতো একটা কাপড় দেওয়া হয়। ‘সারং’ নাম সেটার। প্যান্টের ওপরেই পরে নিলাম ওটা।
মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছানোর পরই মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের কথা। এখানে এসে কবিগুরু নাকি ‘বুদ্ধ প্রণাম’ করেছিলেন। বোরোবুদুরকে নিয়ে লিখেছিলেন কবিতাও,
“পাষাণের মৌনতটে যে বাণী রয়েছে চিরস্থির
কোলাহল ভেদ করি শত শতাব্দীর
আকাশে উঠিছে অবিরাম
অমেয় প্রেমের মন্ত্র ‘বুদ্ধের শরণ লইলাম’। ”
সূর্য মামা তখন ঠিক মাথার ওপর। বেশ রেগে আছেন। গরমে সবাই অস্থির। কানে বাজছে ‘পানাস-পানাস’ (পানাস মানে গরম)। মন্দিরে ঘোরার চমৎকার একটা ম্যাপ দেওয়া আছে, আছে অডিও ধারাভাষ্য শোনার ব্যবস্থাও। প্রয়োজনে গাইডের সাহায্য নেওয়া যায়। পর্যটকদের নিরাপত্তা ও ছবি তোলার সময় স্তূপার গায়ে যেন কেউ পা না দেয়—এসব দেখভালের জন্য আছে নিরাপত্তাকর্মীও। সেলফির যুগে সবাই চারদিকে ছবি তুলতে দারুণ ব্যস্ত। মন্দির দেখা কিংবা এর ইতিহাস জানার চেয়ে নিজেদের ছবি তোলাতেই ব্যস্ত সবাই। তবে প্রকৃত দর্শনার্থীরা খুব ভোরে আসেন সূর্যোদয় দেখতে। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত সময়টা হচ্ছে বোরোবুদুর দেখার সেরা সময়। যদিও এখন অনেক পর্যটক। কিন্তু কোথাও হট্টগোল বা কোলাহল নেই, শুধু মাঝেমধ্যে নিরাপত্তারক্ষীদের ব্যস্ততা লক্ষ করা যায়। বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী এসেছে। একজন ছাত্রী এসে অনুরোধ করল, আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চায় সে। পরে আরো অনেকের এই আবদার রক্ষা করতে হয়েছে। নিজেকে বেশ তারকা তারকা মনে হলো। আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি পর দিনের আলো নিভে আসতে লাগল। এবার মালিয়েবুরোতে ফিরতে হবে।