1. pragrasree.sraman@gmail.com : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী
  2. avijitcse12@gmail.com : নিজস্ব প্রতিবেদক :
  3. wp-configuser@config.com : James Rollner : James Rollner
শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২২ পূর্বাহ্ন

রবীন্দ্র ভাবনায় সুগত ছায়া

প্রতিবেদক
  • সময় বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৭
  • ১২১৯ পঠিত

শ্রীমান বড়ুয়া:
রবীন্দ্র প্রতিভা সর্বপ্লাবিত এবং বিশ্বজনীন। সময়ের ধারাপাত এবং কালিক ভাবনায় রবীন্দ্র সৃষ্টি পরিক্রমা কালোত্তীর্ণ। বাঙালি মননে রবীন্দ্র মানস নিত্যদিনের আসা যাওয়া আর বিশ্ব চিত্ত শতদলে রবীন্দ্রনাথের ভাবব্যঞ্জনা অতুলনীয়। মানুষের অবারিত চিত্ত ভূমিতে রবীন্দ্রনাথ প্রান্তিক চাষী নন। বলা চলে অমিত ভূস্বামী। রবীন্দ্রনাথ মানব জমিতে দীঘল সময় ধরে অন্তর্লীন চাষাবাদ করেছেন। তাঁর কর্ষিত মানব জমির শস্য দানা কখনো কবিতায়, কখনো অতুলানন্দ সঙ্গীতে, কখনো গল্প–উপন্যাসে, কখনো প্রবন্ধের প্রাজ্ঞ–বাণী বিন্যাসে, কখনো চিত্রকল্পে, আবার কখনো গীতি–নাট্যে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। একজন প্রমুগ্ধ পাঠক কিংবা নিবিড় গবেষক সারা জীবনব্যাপী রবীন্দ্র সৃষ্টির মহিমায় অবিরত অনুধ্যানে ব্যাপিত থাকলেও তাঁর দর্শন কিংবা সৃষ্টিতত্ত্ব শেষ করতে পারবে না। এইতো সেদিন গেলো দুই বছর আগে দুই বাংলা সম্মিলিত প্রয়াসে রবীন্দ্র নাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী সৌরভে গৌরবে উদযাপন করা হলো। এই রকম আরো কয়েক শতাব্দী অতিক্লান্ত হলেও রবীন্দ্র অনুশীলন অশেষ থেকে যাবে। তাই স্বয়ং রবীন্দ্র কণ্ঠে গীত হয়েছে –

আমারে তুমি অশেষ করেছো এমনি লীলা তব, . . .

প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্র প্রতিভার প্রোজ্জ্বল দীপ্তি বাঙালি চিত্ত মানসের অন্ধ বিবরে এমনই দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছে তা উপেক্ষা করে অন্য ভুবনে দৃষ্টি ফেরানো কখনো সম্ভবপর নয়। জগৎব্যাপী শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশমান ধারায় যতগুলো উত্তরাধিকার আছে তন্মধ্যে বাঙালির অবস্থান নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম। আমাদের যাপিত জীবনে রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বাঙালির প্রেম বিরহ, প্রকৃতি বন্দনা , নিসর্গ প্রীতি, স্বদেশপ্রেম, মাটি ও মানুষের নিবিড় সান্নিধ্য, দ্রোহী চেতনার বাঙ্ময় উৎসবে, বসন্তের বাসন্তি বাহারে, নববর্ষের অফুরাণ আনন্দ ধারায়, শারদীয় বর্ণিল অভিব্যঞ্জনায় শীতার্ত দিনের নবান্নের মৌ–মৌ উৎসবে, বিজন দুপুরে বাউলের একতারায়, পথের শেষে পান্থজনের দুর্নিবার প্রেরণায়। এবার ব্রক্ষ্যমান বিষয়ে বিশ্লেষণে ফেরা যাক।

রবীন্দ্রনাথ মূলত উপনিষদের বাণীময় ঐশ্বর্যের চরমভাবে প্রণোদিত তবুও বুদ্ধ দর্শনের প্রতি তাঁর অনুরাগ দিগন্ত বিস্তৃত। তথাগত বুদ্ধের মৌলিক ঘোষণা “আত্তা হি অত্তনো নাথো কোহি নাথো পরো সিয়াঃ তুমিই তোমার প্রভু, তুমিই তোমার আশ্রয় । আত্ম শরণ অনন্য শরণ, সুতরাং আত্ম দীপ হয়ে প্রজ্বলিত হও। আত্মশক্তির উজ্জীবিত বার্তা রবীন্দ্র কাব্য ধারায় বিবৃত হয়েছে চমৎকারভাবে।

বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা,

বিপদে আমি না যেন করি ভয়।

দুঃখ তাপে ব্যথিত চিত্তে নাই বা দিলে সান্ত্বনা,

দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।

রবীন্দ্রনাথ এখানে আত্মশক্তি কিংবা আত্মশরণের জয়ধ্বনি করেছেন অতীব প্রাজ্ঞ চৈতন্যে। ত্রাণ পেতে হলে কিংবা ভব দুঃখের অথই সমুদ্দুর পার হতে হলে আত্মশরণ কিংবা আত্মদীপ পরম আশ্রয়। সেখানে অন্য কোনো সোপানের বালাই নেই। কুশল কর্মের অনিন্দ বিভার সঞ্চয় না থাকলে দুঃখ নদীর পারাপার হওয়া যায় না। বুদ্ধ তথাগতের এই বাণীময় ঐশ্বর্যের প্রতিধ্বনি শোনা যায় লালন দর্শনে। লালন সাঁইজির কণ্ঠ গীত হয়েছে, “আমি অপার হয়ে বসে আছি, পার করে নিয়ে যাও আমারেঃ মানুষ জন্মাবধি অপার হয়ে বসে থাকে ভব দুঃখ পার হওয়ার ভরসায়। পারের কড়ির বিপলু সঞ্চয় না থাকলে দুঃখের খেয়াঘাট পার হওয়া যায় না। এই প্রেক্ষিতে ভয়ঙ্কর আলবক যক্ষের সাথে বুদ্ধের কথোপকথন প্রণিধানযোগ্য।

alavaka asked the Buddha ;

How does one cross the flood ?

How does one over come sorrow ?

How is one purified ?

By confidence one crosses the flood, by heedfuness the sea .

By effort one overcomes sorrow, by wisdom one is purified

মানুষের জীবন সমুজ্জ্বল হিরন্ময় দ্যোতনায় পরিবর্তন হয় কুশল কর্ম বিভায়, আত্মপ্রভাব এবং সত্যোপার্জনে, অঢেল মৈত্রীবন্ধনে ঐহিক পারত্রিক পরিবর্তন সাধন জীবনকে পুণ্য প্লাবিত করে থাকে। যাপিত জীবনে মাঙ্গলিক শুভ্রতা প্রাপ্তির জন্যে প্রয়োজন রাশি রাশি ভারা ভারা পুণ্য ঐশ্বর্যের ডালি। প্রকৃত পক্ষে জীবনের সুবর্ণ আয়ু সীমা কিংবা পরিসর একেবারে ছোটো তরীর মতো অথচ জীবন নামক এই ছোটো তরীটি অকুশল চেতনাজাত পাপ পংকিল আবর্তে একেবারে টইটম্বুর । জীবন গাঙ্গে ভাসমান সোনার তরী কুশল কর্মজাত পুণ্য সম্পদের সোনালি ফসলে পরিপূর্ণ হলে সেখানে অন্য কোনো পার্থিব সম্পদ নেয়ার ঠাঁই থাকে না। তাই রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কাব্য ধারায় ধ্বনিত হয়েছে –

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট্টো সে তরী

আমার সোনার ধানে গিয়াছে ভরি,

শ্রাবণ গগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে

শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি

যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।

বুদ্ধের মৌলিক দর্শন শাশ্বত, অবিভাজ্য, একখণ্ড অখণ্ড নীলাকাশের মতো। যেখানে কল্পিত ভাবব্যঞ্জনা কিংবা কোনো প্রকার ভ্রান্তি বিলাসের প্রশ্রয় নেই। মূল দর্শনের নির্যাস চতু:সত্য, অষ্টমার্গ এমন কি গভীর সৃষ্টি তত্ত্বের অমোঘ বিধান–প্রতীত্যসমুদপাদ নীতি কিংবা কার্যকারণ তত্ত্ব রবীন্দ্রনাথকে তেমন করে ভাবিয়ে তোলেননি যেমন করে রবীন্দ্র চেতনার আধারে ব্রক্ষ বিহার ছায়াপাত করেছে।

The four sterling virtues are collectively termed in pail Brahmavihara which may be rendered by modes of sublim conduct, sublime states or divine abodes

বলা বাহুল্য তথাগত বুদ্ধের মেত্তা, করুণা, মুদিতা আর উপেক্ষার আদর্শ এবং বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায় মর্মবাণীতে প্রণোদিত হয়ে, একই সাথে বিচিত্র পারত্রিক কর্মানুষ্ঠানের আদর্শ প্লাবিত শীলসমাধি প্রজ্ঞার অম্লান বিশিষ্ট রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃষ্টরূপে আকর্ষণ করেছিলো। স্মরণ করা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বুদ্ধ দর্শন সম্পর্কিত প্রতীত উন্মেষিত হয়েছিলো রাজেন্দ্র লাল মিত্র, বিধুশেখর শাস্ত্রী, প্রবোধচন্দ্র সেন , প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও ভারততত্ত্ববিদ ড. বেণীমাধব বড়ুয়া প্রমুখ বরেণ্য বৌদ্ধ গবেষক ও পণ্ডিতদের প্রাজ্ঞ রচনা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে পণ্ডিত ধর্মরাজ বড়ুয়া রচিত হস্তসার গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।

তাছাড়া বৌদ্ধ দর্শনের অমিত গ্রন্থ ধম্মপদ রবীন্দ্র চেতনার সরোবরে প্রজ্ঞা ধারা বইয়ে দিয়েছিলো ধম্মপদের বাণীময় প্রকাশ রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে প্রাণিত করেছিলো। ধম্মপদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অভিমত “ধম্মপদ সমগ্র ত্রিপিটক গ্রন্থমালার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। কিন্তু এই ক্ষুদ্র গ্রন্থটি ভাব, ভাষা ও অনুপম সাহিত্য মাধুর্যে বৌদ্ধ সাহিত্যে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এ গ্রন্থ শুধু বৌদ্ধদের কাছেই নয়, বিশ্বের সকল সম্মার্গান্বেষী মানুষের কাছেই আদরণীয়। ধম্মপদ সম্পর্কে রবীন্দ্র বলেছেন: জগতে যে কয়েকটি শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ আছে ধম্মপদ তাহার একটি। ভগবদ্‌গীতায় ভারত বর্ষ যেমন আপনাকে প্রকাশ করিয়াছে , গীতার উপদেশ ভারতের চিন্তাকে যেমন একস্থানে একটি সংহত মূর্তি দান করিয়াছেন, ধম্মপদও ভারতবর্ষের চিত্তের একটি পরিচয় তেমনি ব্যক্ত হইয়াছে, বুদ্ধের সূত্র পিটকের মঙ্গল সূত্রের বাণীময় প্রকাশ রবীন্দ্র সংস্কৃতির বহুমাত্রিক রূপারোপ করেছে। দেব মানবের সর্বোত্তম মঙ্গলের বিশদ বর্ণনা মঙ্গল সূত্রের আলোকে ভাষণ করেছিলেন তথাগত বুদ্ধ। তন্মধ্যে বর্ণিত আছে;

বহুসঞ্চচ্চ সিপ্পঞ্চচ্‌, বিনযো চ কতপুঞ্‌ঞতা,

সুভাসিতা চ যা বাচা, এতং মঙ্গলমুত্তমং।

Vast-learning perfect handicraft, a highly trained discipline and pleasant speech this is the Highest Blessing

বহু শাস্ত্র সম্পর্কিত অধ্যয়ন, বিবিধ শিল্প চর্চা করা, বিনয়ী ও সুশিক্ষিত হওয়া এবং সবার সাথে সুবচন ভাষণ করা ইহাই উত্তম মঙ্গল।

অনুরূপ বহুমাত্রিক শাস্ত্র অধ্যয়ন, নন্দনতত্ত্ব এবং উর্বর মানব কল্যাণধর্মী সংস্কৃতির বিকাশ সাধন, চিত্রকল্প, কারুশিল্প এবং অতুল গৌরবে সঙ্গীতচর্চার নিবিড় তপোবন হিসেবে রবীন্দ্রনাথ শান্তি নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শান্তি নিকেতন প্রতিষ্ঠার অনন্য উপমা কিংবা প্রেরণার উৎস ভূমি ছিলো বৌদ্ধ সভ্যতার প্লাবিত সময়ে গড়ে ওঠা পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, ক্ষত শিলা, সোম বিহার, বাসু বিহার, পাহাড়পুর, জগদ্দালা বিহার বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ। রবীন্দ্রনাথের বাঙ্ময় উপলদ্ধির বিন্যাসে ধরা দিয়েছে, প্রকৃতি কিংবা নিসর্গের হাতছানি, শিক্ষা আর জীবনধারা একই অনুষঙ্গে লালিত হলে মানবিক মূল্যবোধ বিকশিত হয় সহ্র ধারায়। জাতিস্মর কিংবা জন্মান্তরবাদ বৌদ্ধ দর্শনের অনন্য উপাদান। ৗRebirth consciousencss যার বাসনার সম্পূর্ণ তৃপ্তি আর কর্মের বন্ধন ক্ষয় হয়নি মৃত্যুর পর অতৃপ্ত বাসনার সূত্র ধরে আবার তাকে জন্ম নিতে হয়। এই জন্মান্তরবাদ কিংবা পুন:জন্মের দুর্নিবার আকাঙ্খা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত ভাবনায় মূর্ত হয়ে ওঠেছে দারুণভাবে –

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি

সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি

নতুন নামে ডাকবে মোরে বাঁধবে নতুন বাহু ডোরে

আসব যাব চিরদিনের এই আমি।

বৌদ্ধ ধর্ম অবশ্যই ইতিবাচক মোটেই নিবৃত্তিমূলক নয় এই প্রদীপ্ত সত্য রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছেন। উপমা হিসেবে তিনি চিত্রিত করেছেন, তেলের প্রদীপের বর্ণনা বিবৃত করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, তেল নিজেকে পোড়ায় নিজেকে নিঃস্ব করার জন্যে নয়, চারপাশকে আলোকিত করতে। তিনি বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন বুদ্ধই প্রথম মানুষ যিনি বলেছিলেন প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এক অনন্ত বিশাল মহাজাগতিক শক্তি আছে। তারই নাম বুদ্ধ। তাকে জাগিয়ে তুলে বিকশিত করতে হবে। তাহলেই মানুষ মুক্তির দিশা পাবে। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধ ভাবনায় উৎসারিত হয়েছেন মূলত দ্বতভাবে। এক, বুদ্ধ বাণীর অম্লান উপদেশ এবং চিরন্তন বৌদ্ধ সাহিত্যের আঙ্গিকে দুই, বৌদ্ধ বাংলার লোক ঐতিহ্যের ধারা বেয়ে। তবে রবীন্দ্রনাথের মন যতই মুক্তি চিন্তায় ভাবিত হোক কবি কখনোই বরাগ্য নিয়ে সংসার ত্যাগের কথা ভাবেননি। বরং সংসারের মধ্যে অবস্থান করে তিনি মুক্তি আনন্দে গা ভাসাতে চেয়েছিলেন। তিনি মুক্তির খোঁজে স্বর্গের দিকে ছুটতে চাননি, সংসারের শত কাজের মধ্যে লিপ্ত থেকেও তিনি মুক্তি খুঁজেছেন উদার আকাশে, আলোয় আলোয়। তিনি বলেছেন বিশ্বের প্রাঙ্গণে আজি মুক্তি হোক মোর। তাঁর পছন্দ ছিলো পায়ে শৃংঙ্খল অন্তরে মুক্তি। এ সম্পর্কে রচিত রবীন্দ্র কাব্য ধারার সেই অতি পরিচিত পংক্তি গুলো আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে –

বরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমারক্ষায়

অসংখ্যবন্ধন–মাঝে–মহানন্দময়

লভিব মুক্তির স্বাদ

ইন্দ্রিয়ের দ্বার

রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার,

যে–কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে

তোমার আনন্দ রবে তারি মাঝখানে,

মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া,

প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া।

(নবেদ্য–৩০)

বর্ণ–বিদ্বেষের যন্ত্রণা মানুষের সার্বজনীন জাতি সত্তাকে চরমভাবে বিপ্লব করে। এতে মানবিক উপলদ্ধির দরোজাগুলো রুদ্ধ হয়ে যায়। ব্রাক্ষণ, চন্ডাল আর শুদ্র চিন্তা–চেতনা মানুষের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর তরী করে।

আমাদের বঙ্গীয় সমাজ এবং ভূভারতে অস্পৃশ্যতার উন্মেষ ঘটিয়েছে চরমভাবে। এই ক্ষেত্রে বুদ্ধ বাণীর মহিমায় প্রকাশিত হয়েছে –

By birth is not an outcast

By birth is not one Brahmin

By deeds is one an outcast

By deeds is one a Brahmin

অস্পৃশ্যতার আগল ভেঙে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবতার জয়ধ্বণি করেছেন। অস্পৃশ্য চন্ডালিকার হাতে জলপান করে বুদ্ধ শ্রাবক সংঘ আনন্দ প্রমাণ করেছেন অস্পৃশ্যতার গ্লানি মানবতার চরম অপমান। তাই রবীন্দ্রনাথ প্রফুল্ল অনুভবে তাঁর চন্ডালিকা নাটকে বিবৃত করেছেন –

“যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা

সেই বারি তীর্থ বারি

যাহা তৃপ্ত করে তৃষিতেরে,

যাহা তাপিত শ্রান্তেরে ড়িবগ্ধ করে

সেই তো পবিত্র বারি

জল দাও আমায়, জল দাও।

মথুরাপুরী বিশাল ভারত ভূমের এক অনিন্দ ভূস্বর্গ। এ মাটির সোনালী ঐশ্বর্যে একদা জন্ম পরিগ্রহ করেছিলো মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণ। সেই একই রমনীয় ভূমি ধন্য হয়েছিলো বৌদ্ধ সন্নাসী উপগুপ্ত। প্রতিদিন সাঝের মায়ায় স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে পরিভ্রমণ করতেন বৌদ্ধ সন্নাসী উপগুপ্ত। সন্নাসী উপগুপ্ত বুদ্ধ পথের অভিযাত্রী। বিরজ বিমল চেতনার প্রদীপ্ত আধার । একদিন স্মৃতিমান হয়ে সংঘারামে ফেরার সময় সন্ধ্যার মায়াবী পরিবেশে রাস্তার পাশে সবুজ নির্ঝর থেকে হঠাৎ এক অস্পরা রমনীর কণ্ঠ সন্নাসী উপগুপ্তের কর্ণ কুহুরে প্রতিধ্বনিত হলো। পয়মন্ত মদমত্তা রমনী সন্নাসীকে আকুল আহবান জানিয়ে ডাকছে, এসো সন্নাসী আমার রূপের সুধা পান করে তৃপ্ত হও, আর পরিতৃপ্ত করো আমার যৌবনকে । সন্ন্যাসী উপগুপ্ত বললেন, সময় আমার এখনো হয়নি। অত:পর অতিক্রান্ত হলো অনেক সুদীপ্ত ফাল্গুনী প্রহর। কিন্তু থেমে নেই সন্ন্যাসী উপগুপ্তের স্মৃতিময় পথ পরিক্রমা। অকস্মাৎ একদিন মায়াবী সাঝের কুন্তলে স্মৃতিমান হয়ে সংঘারামে ফেরার সময় সবুজ নিসর্গের আড়াল থেকে ভেসে এলো এক বিপ্লব রমনীর কাতর আর্তনাদ। সন্নাসী সবুজ নিসর্গ ভেদ করে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, ক্ষত বিক্ষত পচন ধরা এক রমনীর জ্বরাজীর্ণ দেহ। সন্নাসী আপন অঙ্কে রমনীর দেহ তুলে নিয়ে সযত্ম পরিচর্যা শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর চেতনা ফিরে পেয়ে রমনী কাতর কণ্ঠে শুধালেন, কে গো দয়াময় আমার নিথর দেহে প্রাণের সঞ্চার করেছো। এবার সন্নাসী উপগুপ্ত শুধালেন, আমার সময় হয়েছে, আমি এসেছি গো বাসবদত্তা। বৌদ্ধ সন্নাসী উপগুপ্তের করুণাঘন এই দৃশ্যপট রবীন্দ্র কাব্য বিন্যাসে বাঙ্ময় হয়েছে অতুল ঐশ্বর্যে –

“সন্নাসী বসি আড়ষ্ট শির তুলি নিল নিজ অঙ্কে

ঢালি দিল জল শুঅধরে

মন্ত্র পড়িয়া দিল শির–ঃ পরে,

লেপি দিল দেহ আপনার করে শীতচন্দন পঙ্কে॥

ঝরিছে মুকুল , কূজিছে কোকিল , যামিনী জোছনামত্তা

‘কে এসেছ তুমি ওগো দয়াময়ম্ব

‘আজি রজনীতে হয়েছে সময়, এসেছি বাসবদত্তা!ঃ

–অভিসার।

কোলকাতার মহাবোধি সোসাইটির আয়োজিত বুদ্ধ পূর্ণিমার অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধ সম্পর্কে সারবান অভিমত ব্যক্ত করেছেন।“মানুষের সৃষ্টি আজও অসম্পূর্ণ হয়ে আছে, এই অসমাপ্তির নিবিড় আবরণের মধ্যে থেকে মানুষের পরিচয় আমরা পেতুম কী করে যদি না মানব সহসা আমাদের কাছ আবির্ভূত হত কোনো প্রকাশবান মহাপুরুষের মধ্যে? মানুষের সেই মহাভাগ্য ঘটেছে, মানুষের সত্যস্বরূপ দেদীপ্যমান হয়েছে ভগবান বুদ্ধের মধ্যে, তিনি সকল মানুষকে আপন বিরাট হ্নদয়ে গ্রহণ করে দেখা দিয়েছেন। ন ততো বিজুগুল্পতে–আর তাঁকে গোপন করবে কিসে, দেশকালের কোন্‌ সীমাবদ্ধ পরিচয়ের অন্তরালে, কোন্‌ ক্ষুদ্র্র প্রয়োজন সিদ্ধির প্রলুব্ধতায়? ভগবান বুদ্ধ তপস্যার

আসন থেকে উঠে আপনাকে প্রকাশিত করলেন। তাঁর সেই প্রকাশের আলোকে সত্যদীপ্তিতে প্রকাশ হলো ভারতবর্ষের। ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে ব্যাপ্ত হলো দেশ–দেশান্তরে। চিরন্তন আবির্ভাব ভারতবর্ষের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে ব্যাপ্ত হল দেশ দেশান্তরে । ভারতবর্ষ তীর্থ হয়ে উঠল, অর্থাৎ স্বীকৃত হলো সকল দেশের দ্বারা, কেননা বুদ্ধের বাণীতে ভারতবর্ষ সেদিন স্বীকার করেছে সকল মানুষকে, সে কাউকে অবজ্ঞা করেনি, এই জন্যে সে আর গোপন রইল না। সত্যের বন্যায় বর্ণের বেড়া দিলে ভাসিয়ে, ভারতের আমন্ত্রণ পেঁছল দেশ–বিদেশের সকল জাতির কাছে। ৎ

সময়, কাল আর মহাকাল এবং তাবৎ বসুধার জাতি সত্তা অফুরন্ত মেলবন্ধনে উৎসারিত হয়েছে বুদ্ধের ধ্যানী উদ্ভাবনায়। মানব জমির অঢেল দুঃখবোধ বুদ্ধের বিশাল হূদয়ে ধারণ করে বিশ্বমানবতার উদ্বোধন ঘটিয়েছেন। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনন্ত ভাবনার প্রাজ্ঞ বিন্যাসে বুদ্ধকে উপলব্দি করেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে। যাঁর ধ্যানী আলোর বাঙ্ময় প্রকাশ ভারতকে বিশ্ব মানবের পুণ্য তীর্থে পরিগণিত করেছে। তাই জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ নয়, মানুষে মানুষে হিংস্রতার বিষাক্ত ছোবল নয়। সমগ্র বিশ্বময় শান্তির ললিত বাণী শোনার জন্যে আসুন আমরা বৈরীতাকে জয় করি মেত্তানন্দ অনুভবের অতুল গৌরবে।

তথ্য নির্দেশঃ

সঞ্চয়িতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ধর্মপদ – সম্পাদনায় রণব্রত সেন

লালন দর্শন

রবীন্দ্র মননে বুদ্ধ – জগজ্জ্যোতি

ড. বেণীমাধব স্মারক গ্রন্থ

মহাবোধি সোসাইটি স্মারক গ্রন্থ

The Buddha and his teachings Narada

শেয়ার করুন।

Facebook Comments Box

শেয়ার দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো
© All rights reserved © 2019 bibartanonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazarbibart251
error: Content is protected !!