আহনাফ তাহমিদ: বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষের নিচে দীর্ঘ ছয় বছর তপস্যা করে বোধিজ্ঞান লাভ করেছিলেন তরুণ সিদ্ধার্থ। রাজপ্রাসাদের আরাম আয়েশ, মোহ মায়া তাকে আটকাতে পারে নি, সুন্দরী স্ত্রীর ভালোবাসা তার মনকে গলাতে পারে নি, এমনকি বাবা শুদ্ধোধন মা মহামায়ার ভালোবাসাও তার মনকে আচ্ছন্ন করতে পারে নি। একদিন, দুইদিন তিনদিন করে চতুর্থদিন সারথিকে জিজ্ঞাসা করলে তরুণ সিদ্ধার্থ জানতে পারেন জগত দুঃখময়। মানুষের জীবনে জরা ব্যাধি আছে, কষ্ট আছে। মাত্র ২৯ বছরের টগবগে তরুণ গৃহত্যাগ করলেন জগতের চরম সত্যকে জানার জন্য। এই সিদ্ধার্থকে আজ আমরা জানি গৌতম বুদ্ধ হিসেবে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা।
তার প্রচারিত বাণীর মূল অর্থ হচ্ছে অহিংসা পরম ধর্ম। জগতের সকল জীবের প্রতি দয়া, বিশৃঙ্খলা নৈরাজ্য থেকে বিরত থাকতে বলেছেন বুদ্ধ। তার বাণীর সুশীতল ছায়ায় এসে হয়ত আপনার মন প্রশান্তিতে ভরে উঠতে পারে। বুদ্ধ মূর্তির নিচে এসে দাঁড়ালে হয়ত একটু থমকে দাঁড়াবেন। ভাবতে বাধ্য হবেন। কিছুক্ষণ হয়ত জগতের সকল নিষ্ঠুরতা থেকে বুদ্ধ মূর্তিটি আপনাকে দিতে পারে খানিক চিন্তার অবকাশ। তবে এজন্য আপনাকে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না একদমই। আমাদের প্রাণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলেই দেখা মিলবে বুদ্ধের। হয়ত ভাবছেন, কিভাবে?
জগন্নাথ হলের গেটের ভেতরে ঢুকলেই এর উপাসনালয়ের উত্তর পশ্চিম দিকে দেখা মিলবে ৩০ ফিট লম্বা বুদ্ধ মূর্তির। সামনে যেতে যেতে হয়ত চমকে উঠতে পারেন আপনি। হয়ত কেউ আপনাকে ডাকছে,
“হে পথিক! দাঁড়াও একটিবার। নিজেকে জানো, চেনো?
মূর্তিটি নিরাপদের রাখতে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ২৪টি স্টিল পাইপ বসিয়ে চারধারে টানিয়ে দেয়া হয়েছে শিকল। নিচের বেজমেন্টে রয়েছে আরো ২৪টি স্টিলের পাইপ। চারপাশে শক্ত চারটি কংক্রিটের থামের ওপর ছয় ইঞ্চি এমএস পাইপে বসানো হয়েছে ৪০ ফিট উচ্চতার ছাউনি। পৃথিবীর নানা দেশে বুদ্ধের যেসকল ভঙ্গিমার মূর্তি দেখা যায়, তাদের মধ্যে পাঁচটি ভঙ্গিমা বা ‘মুদ্রা’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই মুদ্রার মাধ্যমে বুদ্ধের দেয়া নানা শিক্ষা এবং অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
জগন্নাথ হলে যে বুদ্ধ মূর্তিটি রয়েছে, তাকে বলা হয় রক্ষাকর্তা বুদ্ধ বা ভয়হরণকারী বুদ্ধ (Protection Buddha/ Overcoming fear Buddha). এর মানে হচ্ছে বুদ্ধ তার অনুসারীদের সর্বদা রক্ষা করে চলেছেন এবং তাদের মনে যদি কোন ধরণের ভয়ভীতি থেকে থাকে, তা থেকে জাগ্রত হবার কথা বলছেন। জগন্নাথ হলের এই বুদ্ধ মূর্তিটির মুদ্রার সাথে যেন এই হলের শিক্ষা, কৃষ্টি ও দর্শনের কথাও মিলে যায়। একইসাথে বুদ্ধমূর্তিটি যেন রক্ষা করে চলেছেন এখানকার মননশীল শিক্ষার্থীদের। প্রেরণা দিচ্ছেন সামনে এগিয়ে যেতে, বাঁধাহীনভাবে।
এবার এই মূর্তিটি যিনি তৈরি করেছিলেন, তার কিছু কথায় আসা যাক। অবাক হলেও সত্যি, ২০০৬ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু করা হলেও দীর্ঘ নয় বছর পর জগন্নাথ হলে বুদ্ধ অবশেষে আলোর মুখ দেখতে পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন, বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি প্রফেসর ডক্টর সুকোমল বড়ুয়ার উদ্যোগে এই বুদ্ধ মূর্তিটি তৈরির স্বপ্ন দেখা হয়। ৩০ ফিট দীর্ঘ এই বুদ্ধ মূর্তিটির নির্মাণে আর্থিক সহায়তা করেছেন বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি ঢাকা অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক স্বপন বড়ুয়া চৌধুরী। মূর্তিটির নির্মাতার সন্ধানে জন্য তারা চষে বেড়িয়েছিলেন খাগড়াছড়ি, পটিয়া, চান্দগাঁও সহ নানা বৌদ্ধবিহারে। অবশেষে ৫৩ বছর বয়স্ক শিল্পী মং খি মং দায়ত্ব নিলেন এই মূর্তিটি তৈরি করবার। সাথে সাহায্য করেন অনেক খুঁজে বের করা হলো ড. শামীম শিকদার, অধ্যাপক হামিদুর রহমান, অধ্যাপক রোকেয়া সুলতানা ও আর্কিটেক্ট প্রদীপ বড়ুয়াকে। মং মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, মিজোরামে বেশ কয়েকটি বুদ্ধ মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। মূর্তিটি তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা। অবশেষে ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল দীর্ঘ ন’বছর পর আলোর দেখা পেল জগন্নাথ হলের বুদ্ধ মূর্তিটি।
খানিকপরই দেখা হয় এই হলেরই অধিবাসী শিক্ষার্থী দীপক চন্দ্র রায়ের সাথে। কিছুটা ভাবালু হয়েই তাকিয়ে আছেন বুদ্ধ মূর্তিটির দিকে। প্রশ্ন করতেই উত্তর দেন, “প্রতিদিনই তো রুমে ফেরা হয় মূর্তিটার সামনে দিয়ে। সময় পেলেই খানিক তাকিয়ে থাকি বুদ্ধের দিকে। যা শিক্ষা তিনি রেখে গিয়েছেন, তা কতটুকু দেখছি এই সমাজে?”
উত্তরটা ভাবিয়ে তোলে। তবে খুব বেশি অবকাশ হয়ে ওঠে না। দ্রুত ঘরে ফেরার তাড়া থাকে। আরেকবার পলক ফেলি বুদ্ধের নিষ্প্রাণ জ্বলজ্বলে মূর্তির দিকে। এই বুঝি কানে এসে বাজল তার অমোঘ কণ্ঠ, “দাঁড়াও পথিক! কতটুকু চেন নিজেকে?”