২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামু উপজেলার বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে সাম্প্রদায়িক হামলার পর রামুতে ১২টি বৌদ্ধ বিহার দৃষ্টি নন্দনভাবে পুনঃনির্মাণ করা হলেও,এখনো যেন আলোর নীচে অন্ধকার রয়েই গেল। সেদিনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া পাঁচটি প্রাচীন বৌদ্ধ পূরাকীর্তি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ এবং উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে রেঙ্গুনী কারুকার্য খচিত,কাঠের তৈরি এসব বৌদ্ধ বিহারের এখন ভগ্নদশা।
শুধু তাই নয়,এসব বিহার থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান বুদ্ধমূর্তি, পিতলের ঘন্টাসহ প্রয়োজনীয় মালামাল। সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় উপজেলা অফিসের চর এলাকার লামার পাড়া গ্রামে অবস্থিত লামার পাড়া ক্যাং (বিহার),প্রায় দেড়’শ বছরের পুরনো হাজারীকুল রাখাইন বৌদ্ধ বিহার, শ্রীকুল সাংগ্রীমা ক্যাং,শ্রীকুল পুরাতন রাখাইন বৌদ্ধ বিহার এবং জাদীপাড়া পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপিত বিশালাকার চাতোপা চৈত্যটি (জাদী) বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পুরাকীর্তি চোখের সামনে নষ্ট হলেও এসব রক্ষায় সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। ফতেখারকুল ইউনিয়নের লামার পাড়া গ্রামে অবস্থিত থোয়াইংগ্যা চৌধুরীর ক্যাং। কিন্তু লামার পাড়া গ্রামে অবস্থিত বলে এলাকাবাসীর কাছে এটি লামারপাড়া ক্যাং নামেই পরিচিত। ১৮০০ সালে তৎকালীন রাখাইন জমিদার উথোয়েন অংক্য রাখাইন এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পাড়ার ভেতরের শান্ত নিথর কিছুটা পথ মাড়িয়ে এ ক্যাং পৌছলে এখনো চোখে পড়ে, আশ্চর্য হবার মতো বড় বড় দুটি পিতলের ঘন্টা। পিতলের তৈরি এগুলো দেশের সবচেয়ে বড় ঘন্টা। এখানে আরও সংরক্ষিত আছে অষ্টধাতু নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি এবং প্রাচীন শিলালিপিসহ ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্ন।রেঙ্গুনী কারুকাজে তৈরি প্রায় দুইশ বছরের প্রাচীন এ বিহারের নির্মাণ শৈলীও দারুণ, চমৎকার। কিন্তু উপযুক্ত পরিচর্যা এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে এ বিহারটির ভগ্নদশা। লামার পাড়া ক্যাংয়ের বিহারাধ্যক্ষ ইয়ালাতারা ভিক্ষু জানান, এক সময় এ বিহারে ছোট–বড় অন্তত বিশটি ঘন্টা ছিল। বুদ্ধমূর্তিও ছিল অনেকগুলো। সীমানা প্রাচীর (দেয়াল) না থাকায় দীর্ঘদিন বিহারটি অরক্ষিত থাকায় অনেক বুদ্ধমূর্তি, পিতলের ঘন্টাসহ প্রয়োজনীয় মালামাল চুরি হয়ে গেছে। ২০০২ সালে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে তিনি সীমানা প্রাচীর এবং ভেতরে হাঁটার পথ সংস্কার করেন। বর্তমানে চুরি বন্ধ হলেও সংস্কারের অভাবে দিন দিন বিহারটি জরাজীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সংস্কারের জন্য সাহায্য চেয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক আবেদন করা হলেও কোন সাড়া মেলেনি ।
কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, এক সময়ের বৌদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিলো অফিসের চরের লামার পাড়া ক্যাং। রেঙ্গুনী কারুকার্য মন্ডিত কাঠের তৈরী এ মন্দিরটি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থা।
এ মন্দিরে এখনো সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশের অষ্টধাতু নির্মিত সর্ববৃহৎ বৌদ্ধমূর্তি, পিতলের বড় বড় ঘন্টা, প্রাচীন শিলালিপিসহ ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্ন। রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশন রামু উপজেলার সভাপতি উথোয়েনছি রাখাইন জানান, দৃষ্ঠিনন্দন প্রাচীন এসব পূরাকীর্তিগুলো খুব সহজেই পর্যটকদের নজর কাড়ে। বর্তমানে কোটি টাকা খরচ করলেও এরকম একটি বিহার তৈরি করা সম্ভব হবেনা। কিন্তু কোটি কোটি টাকার এ সব সম্পদ চোখের সামনে ধ্বংস হলেও এগুলো রক্ষায় সরকারের কোন উদ্যোগ নেই। তিনি এসব পুরাকীর্তি রক্ষায় সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক(সুজন) রামু শাখার সভাপতি মো. আলম জানান, শুধু বৌদ্ধ বিহারই নয়, রামুতে আছে দেশের বৃহত্তম নারকেল বাগান, রাবার বাগান, হিমছড়ির ঝর্না, শাহসুজা সড়কসহ পর্যটনের জন্য সম্ভাবনাময়ী বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। নতুন বিহারের পাশাপাশি পুরনো বৌদ্ধ বিহারগুলো সংস্কার এবং এসব স্থানগুলোকে জন্য ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে রামুও পর্যটন শিল্পের জন্য অপার সম্ভাবনাময়ী স্থান ।
রামু ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মোশতাক আহমদ বলেন, এসব বৌদ্ধ বিহারগুলো শুধু রামু–কক্সবাজার রক্ষায়, বাংলাদেশের গৌরবময় কীর্তি। এসব পুরাকীর্তি দেশের পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। সরকারের উচিত এসব পুরনো বিহার বিহারগুলোও সংরক্ষণে এগিয়ে আসা। রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম বলেন, রামুতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক সহযোগিতায় ১২টি বৌদ্ধ বিহার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে।