ড. এফ. দীপংকর মহাস্থবির:
এই জগতের মধ্যে শিক্ষিত- অশিক্ষিত, ধনী-গরীব, সাধু-সজ্জন প্রায় জনই মিথ্যার বেড়াজালে ও ভোগের মধ্যে ডুবে রয়েছে। এই ক্ষেত্রে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টান কেউ এই ব্যাধির বাইরে নয়। সবাই রয়েছেন এই শৃঙ্খলের মধ্যে।
আমি বিশ্ববিশ্রুত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ (অনার্স) প্রথম শ্রেনী, এম. এ. প্রথম শ্রেনীতে প্রথম (গোল্ড মেডেলিস্ট) এবং পি.এইচ.ডি. ডিগ্রী লাভ করে কোথাও সত্যবাদী ও ন্যায়বাদী না পেয়ে অবশেষে সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে ত্রি-চীবর ও একটি ভিক্ষাপাত্র মাত্র সম্বল নিয়ে- মহাদূর্গতিপূর্ণ চারি অপায় থেকে নিজেকে সুরক্ষা, দুঃখের সাগর অতিক্রম এবং সত্যের সন্ধানে বনে গমন করেছি।
সত্য সর্বার্থ-সাধক। সত্যের জন্য সাধনা-ভাবনা। সত্য বড়ই নির্মম ও নিষ্ঠুর। এটাই সত্যের স্বভাবধর্ম। সত্য লাভ করার জন্য আমার এত ত্যাগ স্বীকার। আমি সত্য ভাষণ করতে গিয়ে যদি কোন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ কিংবা কোন সম্প্রদায় আঘাত প্রাপ্ত হয় এবং আমার সত্য ভাষণের আঘাতে ক্রোধান্ধ কোন ব্যক্তি কিংবা সম্প্রদায় শুধু নয়, আমার সত্যের আঘাত সহ্য করতে না পেরে যদি সমগ্র পৃথিবীর মানব সমাজ আমার বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হয়, সেই দিনও আমি সত্য ভাষণ করব। তখনও আমি অকপটে সত্য ভাষণ করব এবং প্রয়োজনে সত্যকে বুকে আঁকড়ে ধরে হাসি-মুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করে নেব; তথাপি সেই মূহুর্তেও মিথ্যাবাদীদের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করবনা। তেমন মনের মানুষ আমি।
সবার বক্তব্য পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ বিদ্যমান। আমি কিন্তু আমার জ্ঞানচক্ষু দিয়ে দেখেছি- এই পৃথিবীতে মানুষ আছে অতি অল্প মাত্র। তবে মানুষের খোলস পরিধান করে অগণিত গরু-ছাগল, শৃগাল-কুকুর ও জন্তু জানোয়ারকে বিচরণ করতে দেখছি প্রতিনিয়ত।
অন্ধকার বিধ্বংসী পৃথিবীকে আলোদানকারী সূর্যের জ্যোতি সর্বপ্রাণীর জন্য কল্যাণকর হলেও পেঁচা তথা অন্ধকারে বসবাসকারী নিশাচর প্রাণীদের জন্য একান্তই কষ্টদায়ক। অনুরূপ ভাবে শিক্ষিত-অশিক্ষিত অসংখ্য অগণিত জ্ঞানহীন মূর্খদের জন্য মহাকল্যাণকর সত্যবাক্য অসহ্য হয়ে থাকে। এমনতর হলেও দিবাকরের ন্যায় মহাকল্যাণ জনক সত্য আমি তো ত্যাগ করতে পারি না। তাই আমার সত্য ভাষণ।
যাদের আত্নমর্যাদাবোধ, আত্নসম্মানবোধ নেই, স্বীয় ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরী ও স্ত্রী-পুত্র সেবাতে যাদের জীবন সীমাবদ্ধ- তেমন হীন মানবের দ্বারা দেশ, সমাজ ও বহুজনের কল্যাণ সম্ভব নয়। তারা প্রকৃতপক্ষে নিজের এবং অন্যজনের মহাঅনিষ্টকারী। তাদেরকে নিজের এবং অন্যদের শত্রুও বলা যায়।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের সুখ-দুঃখকে বাদ দিয়ে সে একাকী থাকতে পারে না। সমাজে বসবাস করেও যারা সমাজ ও দেশের কোন প্রকার দায়িত্ব-কর্তব্য প্রতিপালন করে না তাদেরকে উপলক্ষ করে মনীষী বেকন বলেছেন- “A man is a social being. He can’t live alone. Who lives alone is a god or a dog” – “মানুষ সামাজিক প্রাণী। সে একাকী বাস করতে পারে না। যে একাকী বাস করে সে দেবতা কিংবা পশু”।
সাধু সন্যাসীরা সত্যের সন্ধানে সমাজ জীবন থেকে অনেকটা বিছিন্ন হয়ে বনে জঙ্গলে একাকী বসাবাস করে। তাই তাঁরা বিষয়-বাসনা ও কামভোগে মদমত্ত সাধারণ গৃহীদের তুলনায় অনেক উর্ধ্বে; -দেবসম। তাঁরা মানুষ হলেও দেবমানব। আর যারা সমাজে থেকেও একাকী আপন সংসার নিয়ে বিভোর থাকে- তারা পশুমানব।
মানুষের সমস্ত অশান্তির মূল কারণ হচ্ছে- অজ্ঞানতা, অবিদ্যা, ভোগতৃষ্ণা আর বিষয় বাসনা। তৃষ্ণার নিবৃত্তিতেই সুখ, জ্ঞান ও মুক্তি। স্মৃতি সাধনের মাধ্যমে ভাবনাময় জ্ঞান লাভ করে তৃষ্ণার অন্ত-সাধন করতে পারলেই মুক্তি। মুক্ত ব্যক্তির চিত্তের চাঞ্চল্যতা নেই। তাঁর চিত্ত স্থির, তাঁর বাক্য স্থির এবং তাঁর কর্মও স্থির। সর্বদা অবিচল শান্তিতে তিনি বিরাজমান। শারীরিক কৃচ্ছসাধন ও নানা প্রকার বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান এগুলো মানুষকে মুক্তি দিতে পারেনা এবং আধ্যাত্মিক পথেও বেশীদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনা। মাথা নেড়া করে গেরুয়াবস্ত্র ধারণ করলে সন্যাসী বা ভিক্ষু হওয়া যায় না। তৃষ্ণাকে যে জয় করতে পেরেছে- ভিক্ষুধর্ম গ্রহণ কিংবা গেরুয়াবস্ত্র ধারণ তাঁকেই শোভা পায়।
প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করে যিনি উচ্চাবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন; তাঁর আত্ম-প্রচারের প্রয়োজন নেই। উদ্যানে মধু সম্প্রযুক্ত পুষ্প প্রস্ফুটিত হলে মধু আহরণকারী মৌমাছিকে খবর দিতে হয় না,- তারা স্বীয় স্বীয় প্রয়োজনে সেখানে গমণ করে। অনুরূপভাবে নিষ্পাপ, নিস্কলুষ, শীলবান, বিনয়ী ও আর্যপুরুষেরা যেখানে অবস্থান করে- নির্বাণকামী পুণ্যার্থীরা উক্ত স্থানে গমনা-গমণ করবেই। এটাই জগতের জাগতিক নিয়ম। যার বাসনার সম্পূর্ণ তৃপ্তি আর কর্মের বন্ধন ক্ষয় হয়নি- মৃত্যুর পর অতৃপ্ত বাসনার সূত্র ধরে আবার তাকে জন্ম নিতে হয়।
আবর্জনা রাশিতে প্রস্ফুটিত পদ্ম তার অনুপম শোভায় প্রফুল্ল হাসিতে পরিবেশের সমস্ত গ্লানিকে দূরীভূত করে। যে মানুষ জানে না কি তার কর্তব্য; কি তার লক্ষ্য; এবং কোনটা তার জন্য প্রকৃত পন্থা। জীবন দর্শন, সমাজ দর্শন এবং কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান নেই বলেই তারা কোনদিন দু:খের ক্ষেত্র অতিক্রম করতে পারে না। এদের মধ্যে যদি কেউ সত্য জ্ঞান লাভ করে থাকে- পঙ্কে উৎপন্ন পঙ্কজের ন্যায় তিনি হীন পরিবেশে থেকেও আপন গুণ মহিমায় শোভা পায়।
শাক্য সিংহ ধর্মরাজ বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর হতে দুঃশীল লজ্জাহীন ভিক্ষুদের কারণে বুদ্ধ শাসনের অবক্ষয় বা পরিহানী দেখা দিলে লজ্জাশীল ও বিনয়ী ভিক্ষুরা ত্রিরত্নে সুপ্রসন্ন রাজা-মহারাজা, ধনী ও ধার্মিক গৃহপতিদের সহায়তায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় বার বার সঙ্গায়ন বা সঙ্গীতির মাধ্যমে বুদ্ধ শাসনের পরিশুদ্ধতা বা ধর্ম-বিনয়কে সুরক্ষা করেছে। দুঃশীল, অবিনয়ী ও পাপী ভিক্ষুদের কারণে বুদ্ধ শাসনের শুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে। বর্তমানেও প্রায় ভিক্ষুরা নির্বাণ অভিমুখী সংবর্তনকারী ধর্ম বিনয়কে গুরুত্বারোপ না করে অর্হৎ ধ্বজা গেরুয়াবস্ত্রকে জীবিকার অস্ত্র হিসাবে ব্যবসায় পরিণত করেছে। এটাই আমার অবিজ্ঞতালব্ধ বাস্তব সত্য।
দাহিকাশক্তি সম্পন্ন অনল যেমন পানির সংস্পর্শে এসে নিভে যায় এবং দাহিকাশক্তি দুর্বল হয়ে যায়; অনুরূপভাবে মহাশক্তি সম্পন্ন চারি অপায় থেকে রক্ষা করে মার্গ দর্শনে সমর্থ বুদ্ধবচন শীল-বিনয়ও অবিনয়ী, দুঃশীল, লজ্জাহীন ও পাপী ভিক্ষুদের কাছে শক্তিহীন, দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যায়। এমতাবস্থায় ঐসব পাপী ভিক্ষুদের কারণে বুদ্ধশাসন, সমাজ জাতি ও বহুজনের উপকারের পরিবর্তে বর্ণনাতীত ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
বর্তমান সময়ে গৃহস্থ ও প্রব্রজিত প্রায় সকলেরই সদাচার, সংযম, নৈতিকতা ও শীল-বিনয় অন্তর্ধানের পথে। বর্ষার সমাগমে বারিধারার ন্যায় অনর্গল উত্তম উপদেশ গৃহী ও প্রব্রজিত অনেকের মুখে শোনা যায়; কিন্তু সদাচার শীল-বিনয় ও নৈতিকতা বিশ্লেষণে দেখা যায়- সুন্দর সুন্দর রস সম্প্রযুক্ত উত্তম ভাষণ প্রদানকারী বক্তার জীবন অন্তঃসার শুন্য;- রূপশ্রী বিমন্ডিত কাইন্দা ফলের ন্যায় পরিভোগের অযোগ্য। যার কারণে তাদের এতগুলো মধুর বচন বাস্তবে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবন গঠনে ব্যর্থ। আদর্শ বিহীন ব্যক্তির উপদেশের সারাংশ এমনই হয়। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবন গঠন ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আদর্শহীন ব্যক্তির লক্ষ-কোটি উপদেশের চেয়ে আদর্শবান ব্যক্তির একটি আদর্শই যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা পালনে সক্ষম।
যারা সরল, অতিসরল, কোমল স্বভাব, নিরভিমানী, নিরহংকারী, যথালাভে সন্তুষ্টচিত্ত, মিতাহারী, অল্পে তুষ্ট, ইন্দ্রিয় সমূহ শান্ত, প্রজ্ঞাবান, চাঞ্চল্যহীন ও গৃহস্থদের প্রতি অনাসক্ত- তাঁদেরকে দান দেওয়া, তাঁদের মুখে ধর্ম শ্রবণ করা উত্তম মঙ্গল। যারা গৃহস্থ জীবনের প্রতি আশ্রিত, পাপেচ্ছা ও পাপ সংকল্প পরায়ণ, পাপাচার প্রকৃতি সম্পন্ন, রমণীর প্রতি আসক্তি পরায়ণ- সেরূপ প্রব্রজিতকে তুচ্ছ জিনিস ও আবর্জনা নিক্ষেপের ন্যায় বর্জন করা উচিত। পাপেচ্ছার অধীন, পাপাচার-গোচর সম্পন্ন, কুমতলবী, মুখে এক-মনে অন্য, প্রব্রজ্যার গুণধর্ম না থেকেও যারা নিজেদেরকে ভিক্ষু-শ্রমণ বলে মনে করে তেমন শ্রেণির প্রব্রজিতদেরকে ধূলি-ময়লার ন্যায় বর্জন করা উচিত। নচেৎ মানব সমাজের কল্যাণ কোথায়!!
যে মূর্খ,- ধর্ম উত্তম রূপে উপলব্ধি না করে পন্ডিত অভিমানী হয়ে আস্ফালন করে, বহুশ্রোত-শাস্ত্রজ্ঞ ও ধর্মকথিকদের কাছে ধর্ম ব্যাখ্যা না শুনে- নিজেই মূর্খ ও সন্দেহ পরায়ন হয়ে অবস্থান করে,- এমতাবস্থায় সে কি করে অপরকে ধর্মে ও জ্ঞান মার্গে উত্তীর্ণ করবে? যে গভীর তীব্রস্রোত নদীতে নেমে স্রোতের গতিবেগ সামলাতে না পেরে নিজে স্রোতের অনুকূলে ভেসে চলে যাচ্ছে- সে কি উপায়ে পরকে উদ্ধার করতে সক্ষম হবে? অনুরূপভাবে যে প্রব্রজিত ও গৃহস্থ কামনা-বাসনা ও লোভ লালসায় ডুবে রয়েছে- সে পরকে কি করে মুক্তি ও ত্যাগ মার্গে উদ্বুদ্ধ করবে? এই পরিস্থিতিতে তারপরও যদি তারা অন্যজনকে উদ্ধারের আশ্বাস বাণী শুনিয়ে থাকে- তাহলে তাদের এই আশ্বাসবাণী ব্যক্তি, সমাজ, জাতি ও দেশের সাথে প্রতাড়ণা ও প্রবঞ্চনা ব্যতীত আর কি হতে পারে!
ছিদ্রযুক্ত তরী যেমন অপর তীরে যেতে অক্ষম, তদ্রুপ ভোগাসক্ত দুঃশীল প্রব্রজিতরাও দুঃখময় ভব সাগর উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ। ছিদ্রযুক্ত তরী যেমন সমস্ত যাত্রীকে নিয়ে মাঝ নদীতে জলের গভীরে তলিয়ে যায়- ঠিক দুঃশীল প্রব্রজিতদেরকে যারা অনুসরণ ও অনুকরণ করে তারাও কূল-কিনারা বিহীন চারি অপায়ে পতিত হয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ ভোগ করে। চন্দ্র যেমন নক্ষত্রকে অনুসরণ করে- অনুরূপভাবে নির্বাণকামী নর-নারীও শীলবান, সৎপুরুষ ও আর্যপুরুষদেরকে অনুসরণ করা উচিত। তেমন পুরুষদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ, দান-ধর্ম ও সেবা-পূজা করলে ইহ-পরকালে উভয় কূলেই জীবন ধন্য হয়। শুধু তাই নয়; এতে তাদের জীবন দুঃখ থেকে মুক্তির সোপান মার্গলাভের সৌভাগ্য ও ঘটে থাকে। এই জন্য ক্ষেত্র বিশষে শীলবান, সৎপুরুষ ও আর্যপুরুষেরা মাতা-পিতার চেয়েও অনেক বেশী কল্যাণকারী।
যিনি সাধনায় উর্ত্তীণ, শুদ্ধজীবি, বিমুক্ত এবং যাঁর মনস্তাপ প্রশমিত, শীল-বিনয়ে সুসমাহিত; তেমন শুদ্ধচারীকে অন্ন-পানীয় দ্বারা পূজা করা উত্তম মঙ্গল। যিনি গৃহীর সকল বন্ধন ছেদন করে তৃষ্ণা স্রোতকে অতিক্রম পূর্বক আর্যমার্গে উপনীত হয়েছেন- তেমন শুদ্ধচারীকে দান ও সেবা- পূজায় বর্ণনাতীত কল্যাণ সাধিত হয়। কারণ, এটাই পূণ্যাকাংঙ্খীদের একমাত্র উপযুক্ত পূণ্যক্ষেত্র।
অষ্টমী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা ইত্যাদি তিথির মধ্যে তিথি সম্রাট হচ্ছে পূর্ণিমা। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ইত্যাদি ঋতুর মধ্যে ঋতুরাজ হচ্ছে বসন্ত। তিথি শ্রেষ্ঠ পূর্ণিমা ও ঋতুরাজ বসন্তের মধ্যে বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্বলাভ ও মহাপরিনির্বান, পর পর তিনটা ঘটনা সংঘটিত হয়। একই পূর্ণিমা তিথিতে পর পর তিনটা ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় জগতের মধ্যে বুদ্ধের অসদৃশ্য ও অদ্বিতীয়ত্ব ঘোষিত হল। বুদ্ধ রাজপুত্র হয়েও তাঁর জন্ম বৃক্ষতলে, বুদ্ধত্বলাভ বৃক্ষতলে এবং মহাপরিনির্বান লাভ; তাও বৃক্ষের নিচে- এই ঘটনাও জগতের মধ্যে বুদ্ধের অসদৃশ্য ও অদ্বিতীয়ত্ব ঘোষিত হল। রাজপুত্র হয়েও বুদ্ধের জন্ম লুম্বিনী বনে, বুদ্ধত্ব লাভ উরুবেলা বনে এবং মহাপরিনির্বান কুশিনারা মল্লরাজাদের শালবনে- এই ঘটনাও জগতের মধ্যে বুদ্ধের অসদৃশ্য ও অদ্বিতীয়ত্ব ঘোষিত হল।
আত্মহিত- পরহিত এবং দুঃখে নিপীড়িত ও অসংখ্য অগণিত প্রাণীদের ত্রাণের নিমিত্ত এবং সর্বপ্রাণীর হিত-সুখের জন্য রাজপুত্র হয়েও প্রাণসম মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র এবং সর্বজন আকাঙ্খিত রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করে সত্যের সন্ধানে বনে গমন, ঋষি প্রব্রজ্যা গ্রহণ, বৃক্ষতল, উন্মুক্ত খোলা আকাশ ও শ্মশানে তৃণ শয্যায় শয়ন তদুপরী অতি সাধারণ ভিক্ষান্নে জীবন-যাপন, এই ঘটনা ও জগতের মধ্যে বুদ্ধের অসদৃশ্য ও অদ্বিতীয়ত্ব ঘোষিত হল।
পৃথিবীতে যুগে যুগে কালে কালে বহু মহামানব জন্মগ্রহণ করেছেন এবং দুঃখ হতে মানব জাতিকে মুক্ত করার জন্য তাঁরা নানা প্রকার উপায় উদ্ভাবন করেছেন। সাধারণত সেই উপায়কে ধর্ম নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই ভাবে পৃথিবীতে নানা ধর্মের সৃষ্টি বা উৎপত্তি হয়েছে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক নয় বলে- সেসব ধর্ম সংস্থাপকদের জ্ঞান, স্থান ও কালের তারতম্য হেতু- তাঁদের আবিস্কৃত ধর্মের মধ্যেও নানা প্রকার পার্থক্য বিদ্যমান। অনেকের মুখে শোনা যায়- সকল ধর্ম একই কথা বলে এবং সকল ধর্ম সমান। প্রকৃতপক্ষে- তারা ধর্মের অর্থ যেমন বোঝে না এবং ধর্মের ইতিহাসও জানে না তাই তাদের এমনতর মন্তব্য। সকল ধর্মের উদ্দেশ্য ও আদর্শ যেমন এক নয় সকল ধর্ম প্রবক্তাদের চরিত্র গুণও এক নয়।
স্বীয় স্বীয় ধর্মের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ধর্ম প্রবক্তাগণ কেউ কেউ নিজেকে অদৃশ্য ঈশ্বরের অবতার, পুত্র কিংবা প্রেরিত পুরুষ রূপে এবং তাঁদের মতবাদকে মহাকরুণাময় সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের বাণীরূপে প্রচার করেছেন। সেই হেতু তাদের প্রচারিত ধর্মের উৎপত্তির মূল ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর একান্তই অবাস্তব ও অলৌকিক। ঐসব ঈশ্বর ভিত্তিক ধর্মের অনুসরণকারীরা আপন আপন ধর্মকে সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের বানীরূপে বিশ্বাস করে সময়ে সময়ে পরস্পরের মধ্যে বাদ-বিবাদ ও বহুবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। আবার কখনও কখনও নিরীশ্বরবাদীদের উপর অস্ত্রও তুলে ধরেছেন এবং নররক্তে রাজপথও রঞ্জিত করেছেন। সেক্ষেত্রে কিন্তু ঈশ্বরবাদীদের মহাকরুণাময় ঈশ্বরের নিরব ভূমিকাও পরিলক্ষিত হয়েছে। বর্তমানেও পৃথিবীর মানচিত্রে একই চিত্র দৃষ্টিগোচর হয়।
এই পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে- প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে রক্তপাত ব্যতীত কোন ধর্ম এক কদমও এগিয়ে যেতে পারেনি। ব্যতিক্রম শুধু বুদ্ধ ও তাঁর ধর্ম। পৃথিবীতে অন্য সব ধর্ম ঈশ্বর ভিত্তিক। তাই ঐসব ধর্মের আরম্ভ একান্তই অলৌকিক। বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শন একান্তই বাস্তব ও লৌকিক। এই ধর্ম ঈশ্বর ভিত্তিক নয়- কর্ম ভিত্তিক। অন্যসব ধর্ম ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই প্রচারিত হয়েছে। ঈশ্বরের ডাকে সাড়া দিয়েই ঐসব ধর্ম প্রবক্তাগণ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং ধর্ম প্রচার করেছেন। এই ক্ষেত্রে মানুষের সুখ-দুঃখের চেয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছে সর্বক্ষেত্রে। তাই বাস্তবের সাথে ঐসব ধর্মের কোনরূপ সম্পর্ক নেই।
ধর্মরাজ গৌতম বুদ্ধ কিন্তু কোন ঈশ্বরের ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবীতে আসেনি। দুঃখে নিপীড়িত প্রাণিদের দুঃখ বিমোচনের জন্য তাদের কাতর ধ্বনি শুনে বুদ্ধ রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে বনবাসী হয়েছেন। দুঃখমুক্তির জন্য বুদ্ধ যে ধর্মের আবিস্কার করেছেন- তা অন্যান্য ধর্মের তুলনায় বহুঅংশে ভিন্ন। বুদ্ধ কর্তৃক আবিস্কৃত এই অভিনব ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মে স্বীকৃত সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কোনরূপ সম্পর্ক নেই। প্রাণিদের দুঃখ বিমোচনের জন্য যেই ধর্মের জন্ম হয়েছে সেই ধর্ম প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে একবিন্দু পশুরক্তে বুদ্ধের ধর্ম মন্দির কখনো অপবিত্র হয়নি এবং একবিন্দু নররক্তে ধরণী কখনো কলংকিত হয়নি। এই কারণেও বুদ্ধ এবং তাঁর ধর্ম পৃথিবীতে অসদৃশ্য ও অদ্বিতীয়ত্ব ঘোষিত হল। বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগেও বৌদ্ধধর্ম পৃথিবীর আনাচে-কানাচে প্রচার-প্রসার হওয়ার এটিও একটি মূল কারণ।
কারো কারো মতে বুদ্ধ হিন্দুদের দেবতা বিষ্ণুর নবম অবতার। তাদের এই ধারণা ও মতবাদ সম্পূর্ণ ভুল ও প্রমাদের বহিঃপ্রকাশ। কারণ বুদ্ধ অবতার নয়;- তিনি মহামানব। অবতার বাদীরা জানে না যে বুদ্ধবাদ আর অবতারবাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। অবতারবাদের ধর্মতা বা সূত্র হল ক্রমবিবর্তনবাদ বা বারে বারে একই ব্যক্তি ভিন্নরূপ ধারণ করে ধরা-ধামে অবতীর্ণ হওয়া। কারণ- মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অংশ বিশেষ শ্রীমৎ ভগবৎ গীতায় বিষ্ণুর অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-“যুগে যুগে আমি ধরাধামে অবতীর্ণ হব।’’ তার মানে তিনি তৃষ্ণামুক্ত নন। তিনি জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মরণ ধর্মের অধীন।
মানবপুত্র বুদ্ধ ত্রিপিটকের অন্তর্গত ধম্মপদে বলেছেন- “জন্মগ্রহণের যে উপাদান তা আমি ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছি। আমি সমূদয় তৃষ্ণার ক্ষয় সাধন করে জন্ম-মৃত্যুর ওপারে উত্তীর্ণ হয়েছি। আমার তৃষ্ণা নির্বাপিত। আমি আর জন্মগ্রহণ করব না,- এটা আমার শেষ জন্ম।’’ বুদ্ধ যে অবতার নয় এই উক্তি থেকে এটা মেঘমুক্ত আসমানের ন্যায় পরিস্কার। বুদ্ধ অবতার যেমন নন,- তেমন নিজের মুক্তিবলে স্বেচ্ছায় অন্যজনের রক্ষাকারী মুক্তিদাতা বা ত্রাণকর্তাও নন। সকল ধর্মগুরুরা বলেছেন- আমার শরণ গ্রহণ করলে কিংবা আমার কাছে আত্মসমর্পন করলে আমি তোমাদেরকে মুক্তি দেব।
ধর্মস্বামী মানব শ্রেষ্ঠ বুদ্ধ বললেন- কেউ কাউকে মুক্তি দিতে পারে না। শুদ্ধি- অশুদ্ধি উভয় যেমন নিজের উপর নির্ভর করে এবং মুক্তি লাভও নিজের উপর নির্ভর করবে। তাই বুদ্ধ মুক্তি লাভের মিথ্যা প্রলোভন না দেখিয়ে শিষ্যদেরকে উপদেশ দিলেন- “You yourselves must strive; the Buddhas only point the way. Those meditative ones who tread the path are released from the bonds of Mara” – তোমাদেরকে মুক্তির জন্য উদ্যমী হতে হবে। তথাগতগণ মুক্তির পথ প্রদর্শক মাত্র। যারা এই মার্গ অবলম্বন করেন, তেমন ধ্যান পরায়ন ব্যক্তি মারের বন্ধন হতে মুক্ত হন।
অন্যান্য ধর্মপ্রবক্তাগণের ন্যায় গীতার মধ্যে শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন- “সর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমাকে আশ্রয় কর। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ হতে মুক্ত করব”। বুদ্ধ শিষ্যদের বললেন- তোমরা মুক্তির জন্য আত্ম নির্ভরশীল হও। আত্ম প্রচেষ্টার মাধ্যমে তোমরা মুক্তি লাভ করতে পারবে। মুক্তির জন্য কারো উপর নির্ভরশীল হতে হবেনা। তিনি বললেন- মুক্তির জন্য পরনির্ভরতা বিপরীত এবং স্বনির্ভরতা সম্যক উপায়। অপরের উপর নির্ভরতার অর্থ হচ্ছে আত্মপ্রচেষ্টা ও স্বীয় শক্তিকে বিসর্জন এবং বলি দেওয়া। বুদ্ধ আরো বললেন- তোমরা নিজেই নিজের দীপ হও। নিজেই নিজের আশ্রয় হও. অন্যের মধ্যে আশ্রয় অন্বেষণ করো না। এমনই আত্ম নির্ভরশীলতার শিক্ষা দিয়েছেন গৌতম বুদ্ধ।
হিন্দুদের ধর্মগুরু পুরোহিত ব্রাহ্মন- বিবাহিত গৃহী, মুসলমানদের ধর্মগুরু মৌলবী- বিবাহিত গৃহী ও খৃস্টানদের ধর্মগুরু প্রোটেস্টান্ট পাদবী- বিবাহিত গৃহী। কিন্তু বৌদ্ধদের ধর্মগুরু সংসারত্যাগী- সন্যাসী। বৌদ্ধধর্ম ব্যাতিত অন্যান্য ধর্মে সন্যাস ধর্ম নেই, ব্যাতিক্রম শুধু বৌদ্ধধর্ম। বৌদ্ধধর্মেই একমাত্র সন্যাস ধর্ম বিদ্যমান। জলে প্রষ্পুটিত পদ্মের ন্যায়- মানব সংসারে বিচরণ করেও সংসার থেকে আলাদা। সুতরাং বৌদ্ধদের ধর্মগুরু ও অন্যান্য ধর্মগুরুর মধ্যে শীল ও আচার ব্যবহার এবং পবিত্রতার কত যে পার্থক্য তা বিজ্ঞজন মাত্রই ওয়াকিবহাল।
বৌদ্ধ ভারতের যে বিপর্যয় তার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ- বিদেশী মুসলিম রাজাদের আক্রমন ও বৌদ্ধধর্মে বিদ্বেষী হিন্দুরাজা ও ব্রাহ্মন্যবাদের অত্যাচার। তাতে তিষ্ঠিতে না পেরে বৌদ্ধভিক্ষুর অভাবে কোটি কোটি ভারতীয় বৌদ্ধদেরকে ইসলাম ও হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে হয়েছে। যারা অন্যধর্ম গ্রহণ করেনি তেমন বৌদ্ধরা ধর্মগুরু ভিক্ষুর অভাবে দীর্ঘকাল ধর্ম ঠাকুরের মূর্তি তৈরী করে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষা করেছিলেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুর অভাবে ঐসব বৌদ্ধদেরকে পরবর্তী সময়ে বর্ণহিন্দুরা নানাভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন ও পদদলিত পূর্বক অস্পৃশ্য হরিজনে পরিণত করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘৃণ্য- কুকুরের ন্যায় জীবন-যাপন করতে বাধ্য করেছিল।
সুদীর্ঘকাল পর নির্যাতিত অস্পৃশ্য হরিজনদের ভাগ্যাকাশে দুঃখের ঘনান্ধকার বিদূরীত করে সুখের অরুনোদয় হল,- অর্থাৎ বোধিসত্ত্ব বাবা সাহেব ড. বি. আর. আম্বেদকরের জন্ম হল। বিশাল হিন্দু সমাজ কর্তৃক নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিঃগৃহীত ও অত্যাচারিত কোটি কোটি দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে ঐ অভিশপ্ত নারকীয় দুঃখ থেকে মুক্তির রাস্তায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য দলিত সমাজের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে বর্ণহিন্দুদের দ্বারা নানা প্রকার বর্ণানাতীত অমানুষিক অত্যাচার ও দুঃখ-কষ্টকে বরণ করতে হয়েছে ড. বি. আর. আম্বেদকরকে। বোধিসত্ত্বদের এটাই ধর্মতা।
ভারতের সংবিধান প্রণেতা মহাকরুনাবান বোধিসত্ত্ব বাবা সাহেব ড. বি. আর. আম্বেদকরের অনুপ্রেরণায় নির্যাতিত ও নিপীড়িত অন্ধকারে নিমজ্জিত কোটি কোটি অস্পৃশ্য দলিত সম্প্রদায়ের হিন্দুরা (পুরানো বৌদ্ধরা) দীর্ঘকাল পর আপন মহান ধর্মকে পুনরায় বরণ করে নেন। তাই বর্তমানে ভারতে যাদেরকে New Buddhist কিংবা নব বৌদ্ধ বলা হয়- প্রকৃতপক্ষে তারা নতুন বৌদ্ধ নয়। তারা পূর্বে বৌদ্ধ ছিল, বিভিন্ন কারনে মাঝপথে রাস্তা হারিয়ে বিপথে চলে যায়। দীর্ঘকাল পর আবার স্বমহিমায় আপন ধর্মে ফিরে আসে। হারিয়ে যাওয়া সন্তান যেমন দীর্ঘকাল পরে স্বীয় গৃহে প্রত্যাবর্তন করে ঠিক তাই। এই হচ্ছে ড. আম্বেদকরপন্থী বৌদ্ধদের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত।
বুদ্ধের শিক্ষামতে কর্মকে বাদ দিয়ে ঈশ্বর আর আত্মা- এই দুইটিতে বিশ্বাস হচ্ছে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও মিথ্যাদৃষ্টি। ঈশ্বর হচ্ছে পুরোহিতদের উদ্ভাবিত একটি কুসংস্কার মাত্র। পুরোহিতদের কথামতো যদি সত্যিই কোন একজন ঈশ্বর থাকেন- তাহলে জগতে এত দুঃখ কেন? এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে এত ফারাক বা বৈষম্য কেন? যেমন- কেউ বিদ্বান- কেউ মূর্খ, কেউ ধনবান, কেউ নির্ধন, কেউ সুশ্রী, কেউ কুৎসীত- বিশ্রী কদাকার চেহারা, কেউ সাত- তলায়, কেউ গাছ তলায় পর্নকুঠির কুড়ে ঘর। কারো মুখে স্বর্ণের চামচে করে রাজভোগ, আর কারো মুখে পঁচা, বাসী, ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে অস্বাস্থ্যকর দুর্গন্ধময় খাবার। কেউ ম্যানেজার- কেউ পিয়ন- দারোয়ান! এগুলো বিচার করলে দেখা যায়- তিনিও তো দেখছি আমাদের মতো কার্য- কারণ শৃঙ্খলের অধীন। যদি তিনি কার্য কারণের অতীত হন তাহলে সৃষ্টি করেন কিসের জন্য। কর্মের কারণেই যদি প্রাণীদের জীবনে এত তফাৎ তাহলে এখানে ঈশ্বরের ভূমিকা অনুপস্থিত। সুতরাং এই রকম অদৃশ্য ঈশ্বর মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এই পর্যন্ত ঈশ্বর বিশ্বাসীরা ঈশ্বর সম্পর্কে কোন তথ্য বা ঠিকানা জানাতে পারেনি। অজানা কোন এক গোপন জায়গায় বসে একজন শাসক তাঁর আপন মর্জি অনুযায়ী দুনিয়াকে শাসন করছেন এবং পৃথিবীতে সবাইকে দুঃখের আগুনে ফেলে রেখে দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলছেন! কারো দিকে করুনায় ফিরে তাকাবার এক মূহুর্তও তাঁর সময় নেই। মানবের সমগ্র জীবনটাই এক প্রকার নিরবচ্ছিন্ন দুঃখের; কিন্তু তাও যথেষ্ট শাস্তি নয়- মৃত্যুর পরও আবার অজানা নানা স্থানে ঘুরতে হবে এবং আরো অন্যান্য শাস্তিভোগ করতে হবে। তথাপি মূঢ়তা বশত অজ্ঞজনেরা অদৃশ্য ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য কতই না যাগ-যজ্ঞ-ক্রিয়া- কান্ড ও পাপকাজ করে চলছে। বুদ্ধ বললেন- পৃথিবী ও অন্যান্য যত গ্রহ (লোক) আছে- তন্মধ্যে সমস্ত প্রাণী কার্য-কারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ। কর্মতত্ত্বের আবর্তনে সবাই ঘুর্ণায়মান। কর্মের কারনেই যখন এত তফাৎ- তখন ঈশ্বরে বিশ্বাস নিষ্প্রয়োজন ও অবান্তর। তাই বুদ্ধের শিক্ষায় ঈশ্বরতত্ত্ব নেই- আছে কর্মতত্ত্ব। এই কারনে বৌদ্ধধর্ম কর্মবাদ- ঈশ্বরবাদ নয়।
সত্য আঁকা-বাকা পথে চলে না- সোজা পথে চলে। তাই সত্যবাদীরা কাউকে ভয় করে না। সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে তারা সত্য কথাই বলে। ন্যায় পরায়নদের জীবনে সত্য কেমন সম্পদ তা প্রকাশ করতে গিয়ে এক ইংরেজ মনীষী বলেছেন- “Truth is above reasons. The object of reasons is to attain the truth. For truth we should work, live and be ready if necessary to die”- সত্য যুক্তিবিচারের উর্ধ্বে। সত্য- লাভের জন্যই যুক্তি বিচার। সত্যের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে; বাঁচতে হবে এবং প্রয়োজন হলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
যেসব মনীষী নানা ধর্ম নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই বিজ্ঞান ভিত্তিক ও জ্ঞান প্রধান বৌদ্ধধর্মকে সর্বোচ্চে স্থান দিয়েছেন।