ইলা মুৎসুদ্দী:
চক্রবালের সমস্ত প্রাণীগণ সুখ চায়, শান্তি চায়। এ সুখ শান্তি চাইলেই যে পাওয়া যায় তা নয়। এজন্য প্রত্যেককে অবিরাম কাজ করতে হয়। সে কাজ কি? তা হলো ঃ দান, শীল ও ভাবনাদি পুণ্যকর্ম। এ ত্রিবিধ পুণ্য কর্মই যে সুখের একমাত্র উৎস তা প্রদর্শনার্থে ভগবান বুদ্ধ ”ধম্মপদ” নামক গ্রন্থে বলেছেন—
পুঞ্ঞং চে পুরিসো কযিরা কযিরাচেন পুনপ্পুনং,
তমিহ্ ছন্দং কযিরাথ সুখো প্ঞুস্স উচ্চযো।
যদি কোন ব্যক্তি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করেন, তা তাঁর পুনঃ পুনঃ করা উচিত। বার বার তা করার জন্য ইচ্ছা উৎপন্ন করা উচিত। কেননা পুণ্যই সকল সুখের উৎস।
প্রতিটি সত্ত্বগণের পুণ্যের প্রয়োজন। সেজন্যই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সবসময় পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে অর্জিত পুণ্যরাশিগুলো জগতের সকলৈ সত্ত্বগণের মঙ্গল কামনায়, সুখ কামনায় দান করা একান্ত কর্তব্য। পুণ্যদান করলে তা কখনো কমে না, বরং তা উত্তরোত্তর বর্ধিত হয়। যেমন বিদ্যাদানে বিদ্যা বর্ধিত হয়। ভগবান মহাকারুণিক সম্যক সম্বুদ্ধ পুণ্যদানের উপকারিতা প্রদর্শন করে পাটলী গ্রামবাসীদিগকে যে মূল্যবান ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন নীচে দীঘর্ নিকায়ের ”মহাপরিনির্বাণ সূত্র” থেকে তা উদ্ধৃত করা গেল।
১. যস্মিং পদেসে কপ্পেতি বাসং পন্ডিতজাতিকো
সীলবন্তেত্থ ভোজেত্বা সঞ্ঞতে ব্রক্ষ্মচারিযো।
যে প্রদেশে পন্ডিত লোক বসবাস করেন, তিনি শীল কায়-মনো-বাক্য সুসংযত ব্রক্ষ্মচারিদিগকে ভোজন করিয়ে পুণ্য সঞ্চয় করেন।
২. যা-তত্থ দেবতা অস্সু তাসং দক্ন্মিাদিসে,
তা পূজিতা পূজযন্তি মানিতা মানযন্তি নং।
তদ্বারা তথাকার দেবগণকে পূজা করে থাকেন, সে দেবগণ পুণ্যফল লাভ করে পূজিত হয়ে পুণ্যদানকারীদের বহুবিধ উপকার করে থাকেন। তাঁদের দ্বারা সম্মানিত হয়ে পুনঃ তাঁদের সম্মানিত করে থাকেন। অর্থাৎ সমস্ত আপদ-বিপদে থেকে সযতেœ রক্ষা করেন।
৩. ততো নং অনুকম্পোতি মাতা পুত্তং ব ওরসং,
দেবতানু কম্পিতো পোসো সদা ভদ্রানি পস্সতী’তি।
মাতা যেমন স্বীয় গর্ভজাত পুত্রকে সর্বদাঅনুগ্রহ করেন, সেরূপ দেবতারাও পুণ্যদানকারীদের প্রতি অনুগ্রহ করে থাকেন। দেবতার অনুগ্রহলাভী ব্যক্তি মাত্রই সবসময় মঙ্গল দর্শন করেন।
পুণ্যদানের মহতী ফল সম্পর্কে জাতক অর্থকথায় ত্তিক নিপাতের ’মঞ্জু রাজ’ জাতকে একটি উপমা পরিলক্ষিত হয়। নীচে তা সকলের জ্ঞাতার্থে প্রদর্শন করা হলো —
অতীতে বোধিসত্ত্ব এক ধনীর ঘরে জন্মগ্রহণ করে পরিণত বয়সে পিতৃসম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর একজন ছোট ভাই ছিলেন। যথাসময়ে পিতার মৃত্যুর পর দু’ভাই মিলে পিতার লগ্নী টাকা আদায়ের জন্য গ্রামে গিয়েছিলেন। গ্রাম থেকে তাঁরা মাত্র এক হাজার টাকা আদায় করে ফিরবার সময় গঙ্গাপারে নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে করতে গঙ্গাতীরেই পুটলীবদ্ধ ভাত খেয়ে নিলেন। ভোজনান্তে বোধিসত্ত্বের অংশ থেকে কিছু ভাত নদীতে মৎস্যকে দান করে সে দানের সঞ্চিত পুণ্যরাশি নদী দেবতাকে দান করলেন।
দেবতা তাঁর পুণ্যলাভ করে অধিকতর দিব্যশ্রী, সৌভাগ্যের অধিকারী হয়ে চিন্তা করলেন, কি কারণে তাঁর এ ফল লাভ হয়েছে? তা জানতে পারলেন। আহারের পর বোধিসত্ত্ব তাঁর চাদরটি মাটিতে পেতে শুয়ে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তাঁর ছোট ভাইটি চোর প্রকৃতির হওয়ায় দাদার ঘুমের সুযোগে চিন্তা করছিলেন কি করে দাদাকে ঠকিয়ে সমস্ত টাকা নিজে আত্মসাৎ করবেন। এ চিন্তা করতে করতে তিনি টাকার থলেটির ন্যায় অন্য একটি থলেতে পাথরের টুকরো ভর্তি করে রেখে দিলেন। এরপর নৌকা এলে উভয়ে নৌকায় আরোহন করে যখন নদীর মধ্যভাগে এলেন, তখন ছোটভাই নৌকায় হঠাৎ একটা লাথি মেরে পাথরের থলেটি জলে ফেলতে গিয়ে ভুলক্রমে টাকার থলেটি ফেলে দিলেন।
অতঃপর তিনি দাদাকে বলতে লাগলেন, ”দাদা, আমাদের হাজার টাকার থলেটি নদীতে পড়ে গেল। হায়! এখন কি করব? আমাদের তো সর্বনাশ হয়েছে। এ বলে কান্না করতে লাগলেন। তদুত্তরে বোধিসত্ত্ব ছোটভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন – ”উদকে পতিতায় কিং করিস্সাম, মা চিন্তযী’তি।” ”জলে পড়ে গেলে আর কি করব? এজন্য তুমি চিন্তা করো না।
এ অবস্থা দেখে নদী দেবতা চিন্তা করতে লাগলেন—”যাঁর পুণ্যদানের প্রভাবে আমি এত দিব্যশ্রী সৌভাগ্যের অধিকারী হলাম, তাঁর এ হারানো ধন আমাকে উদ্ধার করে দিতে হবে। দেবতা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এ হাজার টাকার থলেটি একটি মহাসুখ বিশিষ্ট বিরাট মাছের মুখে প্রবেশ করিয়ে তা রক্ষা করতে লাগলেন।
এদিকে শঠ, প্রতারক ছোট ভাইটি ঘরে এসে ” আজ দাদাকে ঠকিয়ে দিলাম” এ মনে করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। অতিশয় আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে থলেটি যখন খুলতে বসলেন, তখনি দেখতে পেলেন থলে ভর্তি সব পাথরের টুকরো। নিমিষেই চোখে মুখে বিষাদের ছাপ। অনুতাপানলে দগ্ধ হয়ে বালিশে চোখ গুঁজে শুয়ে পড়লেন।
সে সময় জেলেরা নদীতে জাল পাতলে মাছটি দৈবপ্রভাবে ধরা পড়ল। বিরাটাকার এ মাছটি পেয়ে জেলেরা খুবই আনন্দিত হয়ে তা বিক্রি করতে নগরে বেরিয়ে পড়ল। মাছটি দেখে নগরবাসীরা অতিশয় উৎসুক্যে তা কিনতে চাইলে জেলে মাছটির দাম বললো — ”এক হাজার টাকা এবং সাত আনা।” ইহা শুনে নগরবাসীরা জেলেকে উপহাস করে বললেন, ”এত টাকার মাছ তুমি কখনো দেখেছ কি?” ক্রমান্বয়ে ঘুরতে ঘুরতে জেলে মাছটি নিয়ে বোধিসত্ত্বের গৃহদ্বারে গিয়ে বোধিসত্ত্বকে বললেন—”মহাশয় আপনি মাছটি কিনে নিন, ”বোধিসত্ত্ব দাম কত তা জিজ্ঞাসা করলে সে জানাল—”অপরের বেলায় এক হাজার টাকা সাত আনা। কিন্তু আপনি নিয়ে কেবল সাত আনায় দিয়ে রাজি আছি।”
অতঃপর বোধিসত্ত্ব নির্ধারিত মূল্যে মাছটি খরিদ করে, স্ত্রীকে ডেবে মাছটি দিলে মাছের পেট কাটতে গিয়ে স্ত্রী দেখলেন যে পেটের ভিতরে স্বামীর হারানো হাজার টাকার থলেটি। ইহা দেখে অতীব বিষ্মিত হয়ে স্বামীকে ডেকে থলেটি দেখালেন। বোধিসত্ত্ব ভাল করে দেখে থলের চিহ্ন দেখে হারানো টাকা চিনে নিলেন। তখন বোধিসত্ত্ব ভাবতে লাগলেন জেলেটি হাজার টাকার কমে অন্যকে এ মাছটি দেয় নাই। অথচ আমাদের হাজার টাকা আছে বলে কেবল সাত আনায় দিয়ে গেল। কোন্ পুণ্যের ফলে হারানো টাকাগুলো হস্তগত হলো তা ভাবতে ভাবতে বোধিসত্ত্ব বিমোহিত হয়ে পড়লেন।
তখন নদী দেবতা অদৃশ্যভাবে দৈববাণী করে বললেন—
মচ্ছানাং ভোজনং দত্ব মম দক্খিণমাদিসি,
তং দক্খিনং সরঞ্জিযা কতং অপচিতিং তযা’তি।
আমি নদী-দেবতা, আপনি গঙ্গাতীরে ভোজন শেষে অবশিষ্ট ভাত নদীতে মাছদের দান করে পুণ্যরাশি আমাকে দান করেছিলেন। সে জন্য আমি আপনার সম্পত্তি রক্ষা করেছি। দেবতা ক্রমান্বয়ে ছোট ভাইয়ের কু-কীর্তির কথাও ফাঁস করে বললেন —
পদুট্ঠ চিত্তস্স ন ফাতি হোতি ন চাপি তং দেবতা পূজযন্তি,
যো ভাতরং পেত্তিকং সাপতেয্যং অবঞ্চযী দুক্কটকম্মকারী’তি।
সে দুষ্টমতি এখন অনুতাপানলে দগ্ধ হয়ে শুয়ে পড়ে আছে। দুর্বুদ্ধি পরায়ন মানুষের শ্রীবৃদ্ধি কখনো হয় না। আমি আপনার অপহৃত সম্পদ এনে দিলাম। সে চোরকে না দিয়ে সমস্ত সম্পদ আপনিই গ্রহণ করুন।”
বোধিসত্ত্ব চিন্তা করলেন—”কনিষ্ঠকে না দেওয়া আমার পক্ষে সুবিচার হবে না। কাজেই তা অসম্ভব জেনে কনিষ্ঠকেও অর্ধেক প্রদান করলেন। এ প্রকারে পুণ্যানুমোদনকারী দেবতা পুণ্যদান কারীকে নানা আপদে-বিপদে রক্ষার জন্য অনুগ্রহ করে থাকেন।