ডাক্তারকে মানুষ বলে সেকেন্ড গড। কারণ ডাক্তার মানুষের সেবা করে। তবে মানুষের সেবা করতে চাইলে পুলিশের মতো ভালো চাকরি আর নেই। কেউ এখনই বিপদে পড়েছে, তাৎক্ষণিক আপনি তাকে সাহায্য করতে পারবেন যদি সেই মানসিকতা থাকে। কিন্তু অন্য পেশায় সেই সুযোগ সীমিত।’ পেশা হিসেবে পুলিশকেই কেন বেছে নিলেন-এমন প্রশ্নে এভাবে জবাব দেন পুলিশ পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা। বর্তমানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিশনের (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ে কর্মরত আছেন আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সূত্রবিহীন মামলা তদন্তে ব্যাপক সাফল্য পাওয়ায় গত ১৮ জুলাই পিবিআইয়ের বার্ষিক সম্মেলনে চট্টগ্রাম মেট্রোকে দেশের সেরা ইউনিট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়; এসব মামলায় রহস্যের জট খোলার নেপথ্যে রয়েছেন পিবিআইয়ের ‘প্রাণ’ সন্তোষ কুমার চাকমা। অতি কৌশলী অপরাধীও সন্তোষের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনা। তার হাতে ধরা পড়েছে অসংখ্য চোর, ডাকাত, খুনি, অটোরিকশা চোর, ছিনতাইকারী, জঙ্গিসহ বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্তরা। জঙ্গি দমনেও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নগরের সদরঘাটে একে-২২ রাইফেলের গুলিতে দুই ছিনতাইকারী (পরে শনাক্ত হয় জেএমবি) এবং এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত হন। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় অস্ত্র-গুলি। কিন্তু তাৎক্ষণিক ঘটনার সূত্র বের করা যায়নি। পরে পুলিশ উদ্ঘাটন করে তহবিল সংগ্রহের জন্য জঙ্গিরা ছিনতাইয়ে নেমেছিল। এ ঘটনার পর ৬ অক্টোবরে নগরের কর্ণফুলীর খোয়াজনগর থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাটহাজারীর আমানবাজারে টানা অভিযান চালিয়ে অস্ত্র-গুলি, গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক নথিপত্রসহ জঙ্গি নেতাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। একই সময়ে উদ্ঘাটিত হয় আকবর টিলা এলাকায় ‘ল্যাংটা ফকিরের মাজারে’ জোড়া খুনের রহস্য। সেসব অভিযানে সাহসী ভূমিকা রাখেন তৎকালীন গোয়েন্দা পুলিশের এসআই সন্তোষ চাকমা।
স্মৃতি হাতড়ে সন্তোষ বলেন, ‘সদরঘাটে জঙ্গিদের হতাহতের ঘটনাটি আমাকে প্রথম জানান তৎকালীন গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার বাবুল স্যার। সেদিন আমার ছোট ছেলের বয়স ছিল চার দিন। অসুস্থতার জন্য বাচ্চা তখন রয়েল হাসপাতালের এনসিইউতে। ছেলের এমন কঠিন অবস্থায়ও থেমে থাকার সুযোগ ছিল না। টানা ১৩ দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে সফলতা পাই।’
চট্টগ্রাম অঞ্চলে সূত্রবিহীন যেকোনো ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে ডাক পড়ে সন্তোষের। তিনি চিন্তাভাবনায় যেমন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তেমনি কাজের ক্ষেত্রেও করিতকর্মা। কাজের প্রতি তিনি এতটাই একাগ্র ও একনিষ্ঠ যে অনায়াসেই রহস্যের কিনারায় পৌঁছে যেতে পারেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে পিপিএম (সেবা) পদক অর্জন করেছেন সন্তোষ। আইজিপি র্যাংক ব্যাজ পেয়েছেন ২০১৪ ও ২০১৭ সালে।
কর্মজীবনের কোনো কাজটা বিশেষভাবে মনে আছে? এর জবাবে সন্তোষ বললেন, ‘কোনটা রেখে কোনটা বলি! অনেকগুলোই তো মনে পড়ছে। ২০১২ সালে হ্যাচারি ব্যবসায়ী রতন হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করে সব আসামি ধরেছিলাম। কাজটি অনেক কঠিন ছিল। তখন এ ধরনের জটিল মামলা তদন্তে অভিজ্ঞতা কম ছিল। এখন তো এ ধরনের মামলা তদন্ত করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অর্থদাতা কে, কারা কিলিং মিশনে ছিল-সবই বের করে ফেলেছিলাম।’ ‘নোয়াখালী থেকে রতনের লাশ উদ্ধার হয়। নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে টানা ১৫ দিন অভিযান চালিয়ে আসামিদের গ্রেফতার করেছিলাম। সে সময় রমজান মাস ছিল। কাজের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমার সহকর্মীরা সেহরি পর্যন্ত খেতে পারেনি, পানি খেয়ে ইফতার করেছিল। এই রকম কঠিন অবস্থা ছিল। সেই দিনগুলো আমি ভুলতে পারব না।’
এত সফলতার গোপন রহস্য কী জানতে চাইলে সন্তোষ কুমার চাকমা উত্তর দেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তিকে আমি সোর্স বানিয়ে নিয়েছি। সোর্স হিসেবে মানুষ অনেক সময় মিথ্যা বলে। আত্মরক্ষা বা অন্যকে বাঁচানোর স্বার্থেও মানুষ মিথ্যা বলে। কিন্তু প্রযুক্তি মিথ্যা বলে না। এ ছাড়া দারুণ কিছু মানুষকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। মাথার ওপর ছায়া হিসেবে আছেন ঊর্ধ্বতন স্যাররা।’
সন্তোষ চাকমার কাজে সন্তুষ্ট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার; ‘সন্তোষ খুব ভালো কাজ করছে। কোনো দায়িত্ব দিলে সে সফল হয়েই ফিরে। পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের কর্মকান্ডে আমি সন্তুষ্ট।’
২০০৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে উপপরিদর্শক (এসআই) পদে যোগ দেন সন্তোষ কুমার চাকমা। ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত পাঁচ বছর কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে; এরই মধ্যে সিআইডি, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানা, কোতোয়ালি থানা ও পিবিআইয়েও কাজ করেন। গত বছরের ২০ জুলাই সন্তোষ চাকমা পদোন্নতি পান পরিদর্শক পদে। এরপর ঢাকায় সিআইডিতে এক মাস কর্মরত থেকে বদলি হন পিবিআইয়ে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটে কর্মরত আছেন নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠা সন্তোষ চাকমা।
বোমা নিষ্ক্রিয়করণ, সাইবার অপরাধ, আর্থিক অপরাধসহ পেশাগত নানা বিষয়ে দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সন্তোষ। বোমা নিষ্ক্রিয়করণের ওপর ২০১১ সালে সাত সপ্তাহের ও ২০১৩ সালে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। চলতি বছরের মার্চে ভারতের সিবিআই একাডেমিতে আর্থিক অপরাধ-সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান হিসেবে একসময় দায়িত্ব পালন করেছিলেন সন্তোষ কুমার চাকমা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেন রাঙামাটির সন্তান সন্তোষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) কার্যক্রমে যুক্ত হন। বিএনসিসির নেভাল উইংয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্যাডেট আন্ডার অফিসার (সিইউও) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি নৌ শাখার সাবেক ক্যাডেটদের সংগঠন ‘অ্যাংকর সিইউ’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বর্তমানে কাজ করছেন সন্তোষ কুমার চাকমা। বিএনসিসি ও পুলিশের কাজের মধ্যে মিল খুঁজে পান সন্তোষ, ‘স্বেচ্ছাসেবকের কাজই বিএনসিসির কর্মকা-। পুলিশের কাজও এক প্রকার স্বেচ্ছাসেবকের। এভাবেই বিএনসিসি থেকে আমার পুলিশ হয়ে ওঠা। তবে এটা সত্য, এটা থ্যাংকসলেস জব!’
সুত্র: প্রতিদিনের সংবাদ