বিশুদ্ধিমার্গ (অাচার্য বুদ্ধঘোষ);
অনুবাদ: জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু:
ভগবান হচ্ছে গুণের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সকল সত্ত্বের মধ্যে উত্তম হিসেবে তার প্রতি গৌরব ও সম্মান প্রকাশের অন্য নাম। তাই প্রাচীনেরা বলেছেন-
ভগবান শব্দটি শ্রেষ্ঠ, ভগবান শব্দটি উত্তম;
এটি গৌরব ও সম্মানযুক্ত, তাই ভগবান বলা হয়ে থাকে।
অথবা, চার প্রকার নাম আছে: অবস্থাভিত্তিক, লক্ষণভিত্তিক, অর্জনভিত্তিক, স্বতঃস্ফুর্ত। জগতে ব্যবহারিকভাবে স্বতঃস্ফুর্ত নাম হচ্ছে ইচ্ছেমতো দেয়া নাম। এখানে বাছুর, দম্য, বলদ, ইত্যাদি হচ্ছে অবস্থাভিত্তিক। দণ্ডধারী (দণ্ডী), ছাতাধারী (ছত্রী), চূড়াধারী (সিখী), শুঁড়ধারী (করী) ইত্যাদি হচ্ছে লক্ষণভিত্তিক। ত্রিবিদ্যাধর, ছয় অভিজ্ঞাধর ইত্যাদি হচ্ছে অর্জনভিত্তিক। সৌভাগ্যবর্ধক, ধনবর্ধক ইত্যাদি কথার অর্থ না খুঁজে এমনিতেই দেয়া নাম হচ্ছে স্বতঃস্ফুর্ত। কিন্তু এই ভগবান নামটি অর্জনভিত্তিক। সেটা মহামায়ার দেয়া নাম নয়, শুদ্ধোধন মহারাজের দেয়া নয়, আশি হাজার জ্ঞাতির দেয়া নয়, অথবা সক্ক, সন্তুষিত প্রভৃতি দেবপুত্রের দেয়া নয়। ধর্মসেনাপতি কর্তৃকও বলা হয়েছে, “এই ভগবান নামটি মায়ের দেয়া নয় … এটি হচ্ছে বিমোক্ষ নির্দেশক, যা বুদ্ধ ভগবানদের এবং তাদের বোধিবৃক্ষের গোড়ায় সর্বজ্ঞতাজ্ঞান লাভ ও উপলদ্ধির প্রকাশ” (মহানি.৮৪)।
যেসব গুণের অর্জনে এই নাম, সেই গুণগুলোকে প্রকাশের জন্য এই গাথা বলা হয়েছে–
অধিকারী (ভগী), বিভাজনকারী (ভজী), ভাগী (ভাগি), বিভক্তকারী (ৰিভত্তৰা);
ভেঙে ফেলেছেন বলে তিনি সম্মানিত এবং ভাগ্যবান।
বহু উপায়ে তিনি নিজেকে সুদক্ষ করে তুলেছেন।
তিনি ভবের অন্তে চলে গেছেন বলে তাকে ভগবান বলা হয়।
মহানির্দেশে (মহানি.৮৪) উল্লেখিতভাবে এখানে উপরোক্ত পদগুলোর অর্থ বুঝে নিতে হবে।
আরেকভাবে বলা যায়-
ভাগ্যবান, যোগ্য ভগ্নকারী, ভাগ্যযুক্ত, বিভক্তকারী;
অভ্যস্ত, ভবগুলোতে গমন পরিত্যক্ত তিনি ভগবান।
এখানে তিনি লৌকিক লোকোত্তর সুখদায়ী দান, শীল ইত্যাদিতে পরিপূর্ণতাপ্রাপ্ত হওয়ায় ভাগ্যবান। কিন্তু কোনো একটা বর্ণ এসে বসা, বর্ণ লোপ পাওয়া ইত্যাদি ভাষাগত বৈশিষ্ট্যগুলো গ্রহণ করে অথবা ব্যাকরণগতভাবে পিসোদর ইত্যাদি নিয়মে শব্দের মধ্যে বর্ণ ঢুকিয়ে দেয়ার বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে এখানে ভাগ্যবান বলা উচিত হলেও ভগবান বলা হয়ে থাকে বলে জানতে হবে।
আবার যেহেতু তিনি পাপে নির্লজ্জতা ও অসংকোচ, ক্রোধ ও শত্রুতা, অন্যকে নিচে ফেলা ও আক্রোশ, ঈর্ষা ও কৃপণতা, মায়া ও শঠতা, একগুঁয়েমি ও হঠকারীতা, মান ও অহংকার, মত্ততা ও প্রমত্ততা, তৃষ্ণা ও অবিদ্যা; তিন প্রকার অকুশল মূল, তিন প্রকার দুশ্চরিত্রতা, এভাবে তিন প্রকার করে কলুষতা, মল, বিসম সংজ্ঞা, বিতর্ক, ও প্রপঞ্চ; চার প্রকার বিপরীত অন্বেষণ, আসৰ, গ্রন্থি, প্লাবন (ওঘ), সংযোগ (যোগ), অগতি, তৃষ্ণা থেকে উপাদান; পাঁচটি চিত্তের অকর্মণ্যতা (চেতোখিল), বন্ধন, নীবরণ, অভিনন্দন; ছয় বিবাদ মূল, ছয় তৃষ্ণাপুঞ্জ, সপ্ত অনুশয়, আটটি মিথ্যাত্ব, নয়টি তৃষ্ণামূল, দশটি অকুশল কর্মপথ, বাষট্টি মিথ্যাদৃষ্টি, একশ আট প্রকার তৃষ্ণা, এভাবে সব মিলিয়ে শত হাজার কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা ও ক্লেশকে, অথবা সংক্ষেপে পঞ্চমার, অর্থাৎ ক্লেশমার, স্কন্ধমার, অভিসংস্কারমার, দেবপুত্রমার ও মৃত্যুমারকে ভেঙে ফেলেছেন। সেকারণে এসমস্ত বিপদগুলোকে ভগ্ন করার মাধ্যমে ভগ্নকারী (ভগ্গৰা) বলা উচিত হলেও ভগবান (ভগৰা) বলা হয়ে থাকে। এখানে আরও বলা হয়েছে-
ভগ্ন লোভ, ভগ্ন দ্বেষ, ভগ্ন মোহ, আসবহীন;
ভগ্ন তার পাপ ধর্মগুলো, তাই তাকে বলা হয় ভগবান।
ভাগ্যবান হওয়ার নিদর্শন হিসেবে তার শতপুণ্যলক্ষণধারী রূপকায়সম্পত্তিকে দেখানো হয়। ভগ্নদোষ হওয়ার নিদর্শন হিসেবে তার ধর্মকায় সম্পত্তিকে দেখানো হয়। সেরূপই তার লৌকিকভাবে খুব সম্মানিতভাব, গৃহী ও প্রব্রজিতদের তার উপর নির্ভরতা, তার উপর নির্ভরশীলদের দৈহিক ও মানসিক দুঃখ অপনোদন করে দিতে তার সামর্থ্য, পার্থিব দান এবং ধর্মদানের দ্বারা উপকারিতা, লৌকিক ও লোকোত্তর সুখে সংযুক্ত করে দিতে তার সামর্থ্যকেও দেখানো হয়।
আবার, জগতে আধিপত্য, ধর্ম, যশ, শোভা, কাম্যবিষয় (কাম), প্রযত্ন এই ছয়টি বিষয়ে ভাগ্য শব্দটি প্রচলিত। নিজ চিত্তের উপরে তার আছে পরম আধিপত্য, অথবা সুক্ষ্মতা (নিজের দেহকে একদম ক্ষুদ্র করা), লঘুতা (নিজেকে হালকা করে আকাশে গমন) ইত্যাদি লৌকিক হিসেবে বিবেচিত ক্ষমতাতে সকল দিক দিয়ে তার পরিপূর্ণ আধিপত্য। সেরূপই হচ্ছে লোকোত্তর ধর্মে। আর তার আছে ত্রিলোকে পরিব্যাপ্ত, যথাযথ সত্য গুণের দ্বারা অধিগত, অত্যন্ত পরিশুদ্ধ যশ। তার রূপকায় দর্শনে উৎসুক জনতার নয়নকে পরিতৃপ্ত করতে সমর্থ সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের শোভা। তার যা যা ঈপ্সিত, প্রার্থিত, নিজের বা অপরের কল্যাণের জন্য, তা সেভাবেই সিদ্ধ হয়, সফল হয়। এভাবে ঈপ্সিত বিষয় উৎপাদনই হচ্ছে তার কাম্যবিষয়। তার সারা জগতে সম্মানিতভাব প্রাপ্তির কারণ হিসেবে সম্যক প্রচেষ্টা নামে পরিচিত প্রযত্নও আছে। এভাবে এসব দিক দিয়ে ভাগ্য দ্বারা সংযুক্ত হওয়ার কারণে তার ভাগ্য (ভগ) আছে এই অর্থে ভগবান (ভগৰা) বলা হয়।
আবার যেহেতু তিনি কুশল ইত্যাদি ভেদে সকল বিষয়কে; অথবা স্কন্ধ, আয়তন, ধাতু, সত্য, ইন্দ্রিয়, প্রতীত্য সমুৎপাদ ইত্যাদি কুশল বিষয়গুলোকে; অথবা পীড়ন, আবির্ভাব, সন্তাপ ও পরিবর্তনশীলতা অর্থে দুঃখ আর্যসত্য; পুঞ্জীভূত হওয়া, উৎস, সংযোগ ও বাধা বা উপদ্রব অর্থে সমুদয় বা উৎপত্তি; নিঃসরণ, পৃথক হওয়া, অসংস্কৃত বা অনাবির্ভাব ও অমৃত্যু অর্থে নিরোধ; মুক্তিদায়ী, হেতু, দর্শন ও আধিপত্য অর্থে মার্গ বা পথে বিভক্তকারী, অর্থাৎ তিনি এগুলোকে বিভক্ত করেছেন, উন্মোচন করেছেন, দেখিয়ে দিয়েছেন বলে বলা হয়, সেকারণে তাকে বিভক্তকারী (বিভত্তৰা) বলা উচিত হলেও ভগবান (ভগৰা) বলা হয়ে থাকে।
আবার যেহেতু তিনি দিব্য অবস্থান (দিব্বৰিহার), ব্রহ্ম অবস্থান (ব্রহ্মৰিহার), আর্য অবস্থান (অরিযৰিহার), কায়ৰিৰেক, চিত্তৰিৰেক ও উপধিৰিৰেক, শূন্যতা বিমোক্ষ, অনাকাঙ্খা (অপ্পণিহিত) বিমোক্ষ, নিমিত্তহীন (অনিমিত্ত) বিমোক্ষ এবং অন্যান্য লৌকিয় ও লোকোত্তর উচ্চতর মানসিক বিষয়গুলো (উত্তরিমনুস্সধম্ম) ভজনা করেছেন, সেবন করেছেন, বার বার অভ্যাস করেছেন, সেকারণে অভ্যস্ত (ভত্তৰা) বলা উচিত হলেও ভগবান বলা হয়ে থাকে।
আবার যেহেতু এই ত্রিভবে তৃষ্ণা নামে আখ্যাত “গমন” তার দ্বারা পরিত্যক্ত (ৰন্ত) হয়েছে, সেকারণে তাকে “ভবগুলোতে গমন পরিত্যক্ত (ভৰেসু ৰন্তগমনো)” বলা উচিত। তবে জগতে যেমন “গোপনাঙ্গের (মেহনস্স) স্থানের (খস্স) মালা (মালা)” বলা উচিত হলেও সেটাকে কোমরবন্ধনী (মেখলা) বলা হয়, ঠিক সেভাবে এখানে “ভবগুলোতে গমন পরিত্যক্ত (ভৰেসু ৰন্তগমনো)” বলা উচিত হলেও ভৰ শব্দটি থেকে ভ এবং গমন শব্দটি থেকে গ নিয়ে, ৰন্ত শব্দটি থেকে ৰ দীর্ঘ আকারে গ্রহণ করে ভগৰা (ভগবান) বলা হয়ে থাকে।
[সূত্র: বিশুদ্ধিমার্গ (অাচার্য বুদ্ধঘোষ); অনুবাদ: জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু]