ভাষান্তর – সুব্রত বড়ুয়া
অন্য লোকেরা আপনার ওপর মাঝেমধ্যে রেগে যেতে পারে, এমনকি আপনার প্রিয়জনরাও। এটি আমাদের সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। কিছু মানুষ এমনকি বুদ্ধের ওপরও রেগে যান। তাহলে, অন্যজনের রাগের লক্ষ্য যদি আপনি হন তখন আপনি কী করতে পারেন? এই প্রশ্নের উত্তর নিচের গল্পটিতে পাওয়া যাবে।
এক মহিলার স্বামী একদিন কাজের শেষে বিকেলে বাড়িতে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ব্যস্ত ছিলেন রাতের খাবার তৈরি করার কাজে। তিনি দেখলেন যে, রান্নার জন্য যা দরকার সে পরিমাণ ডিম বাড়িতে নেই।
‘ওগো শুনছো,’ তিনি বললেন, ‘তুমি কি বাজারে গিয়ে আমাকে আর কয়েকটা ডিম এনে দেবে?’
‘নিশ্চয়, সোনা বউ আমার,’ তিনি বেশ সুখী সুখী ভাব নিয়ে বললেন।
এদিকে হয়েছে কি, মহিলার স্বামী এর আগে কোনোদিন বাজারে যাননি। তাই তাঁর বউ তাঁকে কিছু টাকা আর একটা থলে দিয়ে বাজারের মাঝামাঝি জায়গায় যে ডিমের দোকান আছে সেখানে কিভাবে যেতে হবে তা বুঝিয়ে দিলেন। খুব একটা দূরে নয় সে জায়গাটা।
স্বামী লোকটি যখন বাজারে ঢুকলেন, তখন একটি যুবক সরাসরি তাঁর কাছে এসে চিৎকার করে বলল, ‘এই যে উটমুখো!’
‘কী!’ চমকে গিয়ে বলে উঠলেন লোকটি। ‘আমি তোমাকে মোটেই চিনি না! তুমি কাকে উটমুখো বলছ?’
কিন্তু তাঁর কথাগুলো উল্টো যুবকটিকে যেন আরো উৎসাহিত করে তুলল। সে আরো বেশি খারাপ খারাপ গালাগাল দিতে লাগল, ‘এই যে তুমি, দুর্গন্ধওয়ালা মুখের মানুষ! আজ সকালে দাঁড়ি কাটার পর তুমি কী আফটার শেভ হিসেবে কুকুরের মল মেখেছো মুখে? তোমার বগলে বুঝি রাস্তার কুকুরের গায়ের পোকাগুলো আস্তানা গেড়েছে!…’ সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো, বাজারের মাঝখানে চিৎকার করে একগাদা লোকের সামনে এসব গালাগাল দেওয়া হচ্ছিল তাঁকে। অথচ তিনি কোনো অন্যায়ই করেননি। তিনি এতটাই হতবিহ্বল আর লজ্জিত হয়ে পড়লেন যে তক্ষুণি যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজার থেকে বেরিয়ে গেলেন।
‘তুমি তাড়াতাড়িই ফিরে এসেছো,’ লোকটিকে ফিরতে দেখে তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘ডিম এনেছো তো?’
‘না’ রাগান্বিত স্বরে বললেন মহিলার স্বামী, ‘আর, মনে রেখো, ভবিষ্যতে আমাকে কখনো ওই অসভ্য ইতর, অভদ্র লোকদের বাজারে পাঠাবে না!’
এখন কথা হলো, সুখী ও স্থায়ী দাম্পত্য জীবনের গোপন কথাটি হচ্ছে― আপনার স্বামী/স্ত্রীর সঙ্গে খুব বাজে একটা ব্যাপার ঘটে যাওয়ার পর, তাকে কিভাবে শান্ত করতে হবে সে ব্যাপারটা জানা থাকা। এবার মহিলাটি তাঁর স্বামীকে রাগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে সান্তনা দিতে লাগলেন। তারপর তিনি ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন সেই যুবকটি দেখতে কেমন ছিল।
তাঁর স্বামীর মুখটা বিরক্তিতে বাঁকা হয়ে গেল। বার কয়েক থুথু ফেলতে ফেলতে তিনি সেই যুবকটির চেহারার একটা বর্ণনা দিলেন।
‘ও! সেই ছেলেটা!’ যুবকটিকে চিনতে পেরে স্ত্রী বললেন। ‘সে তো সবার সঙ্গেই এমনটা করে। ছেলেবেলায়ও পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিল। এতে ওর মগজের বেশ ক্ষতি হয়ে যায়। আর তখন থেকেই ও এরকম পাগলামি করছে। বেচারা, ও কখনো স্কুলে যেতে পারেনি, বন্ধুদের সঙ্গে কোনো সময় খেলতেও পারেনি। কোথাও কোনো কাজও পায়নি সে। কখনো কোনো সুন্দরী একটি মেয়েকে বিয়ে করে একটি সুখের সংসারও করতে পারবে না সে। এই দুর্ভাগা যুবকটি আসলে একটা পাগল। সে যে-কাউকে এভাবে গালাগাল করে, বলতে পারো সবাইকে। তুমি ওর ব্যবহারে কিছু মনে করবে না। ওই ছেলেটির তো মাথা খারাপ।’
মহিলার স্বামী এসব কথা শোনার পর, তাঁর মনের মধ্যে যে রাগটা ছিল তা গলে পানি হয়ে গেল। এখন তাঁর মনে ছেলেটির জন্য করুণার উদ্রেক হলো।
স্বামীর মনের এই পরিবর্তনটা স্ত্রী লক্ষ করলেন। তিনি বললেন, ‘শোনো, ডিম কিন্তু আমার লাগবে। তুমি কি আবার…?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই যাব,’ বলে মহিলার স্বামী তক্ষুণি আবার বাজারে ফিরে গেলেন।
সেই যুবকটি এবারও তাঁকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘এই যে দেখো কে আসছে! সেই উটমুখো মানুষটা আবার এসেছে। ওর মুখে কী গন্ধ! তোমরা সবাই নাক চেপে ধরো। ওর পায়ে লেগে আছে কুকুরের পায়খানা আর সেটা চলে এসেছে আমাদের বাজারে।…’
এবার কিন্তু মহিলার স্বামী বিরক্ত হলেন না। তিনি সোজা চলে গেলেন ডিমের দোকানে। তাঁর পেছন পেছন এলো সেই যুবকটা। আর সারাক্ষণ নানান খারাপ খারাপ কথা বলছিল সে।
‘ওর কথায় কান দিও না,’ যে মহিলাটি ডিম বিক্রি করছিলেন তিনি বললেন। ‘ও সবার সঙ্গে এই রকমই করে। পাগল আর কি। ছেলেবেলায় ওর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।’
‘হ্যাঁ। আমি জানি। বেচারা,’ ডিমের দাম মিটিয়ে দিতে দিতে স্বামী ভদ্রলোকটি বললেন। তাঁর কণ্ঠে সত্যিকারের করুণা।
বাজার থেকে ফেরার সময় সেই যুবকটি খারাপ খারাপ কথা বলতে বলতে লোকটির পেছন পেছন বাজারের শেষ মাথা পর্যন্ত এলো, কিন্তু মহিলার স্বামী এবার মোটেই রেগে গেলেন না, বিরক্তও হলেন না। যুবকটি তো আসলে পাগল।
এই গল্পটা যদি আপনি বুঝতে পেরে থাকেন, তাহলে এবার থেকে কেউ যদি আপনাকে খারাপ খারাপ নাম ধরে কিছু বলে, কিংবা আপনার সঙ্গী যদি আপনার ওপর রেগে যান, তাহলে আপনি ভাববেন, ওদের মাথায় নিশ্চয় আজ গ-গোল দেখা দিয়েছে অথবা সাময়িকভাবে মাথার মগজটা বিগড়ে গেছে। কারণ, বৌদ্ধধর্মে বলা হয়, অন্যের ওপর রেগে যাওয়া ও তাদের অপমান করা হলো, ‘সাময়িক উন্মাদনা’।
অতএব, আপনি যখন বুঝতে পারবেন যে, আপনার ওপর রেগে যাওয়া হচ্ছে সাময়িক পাগলামি, তাহলে আপনি শান্তভাবে ও এমনকি করুণার সঙ্গে তার মোকাবেলা করতে পারবেন… ‘আহা বেচারা!’