বেশ আলো ঝলমলে। গ্রিল দেয়া বুদ্ধ মূর্তির সামনে থরে থরে সাজানো পানির বোতল, প্লেটে রঙিন ফুলের গুচ্ছ। এর সামনেই প্রার্থণারত কয়েকজন নারী–পুরুষ। পানি এবং ফুলগুলো সব এসব পূজারিদের দেয়া। ধর্ম–বর্ণ, নির্বেশেষে অনেকেই এই মন্দিরে আসেন মনবাঞ্চা পূরণের বাসনায়। এটি পরিচিত ‘বুড়াগোঁসাই মন্দির’ নামে। এভাবেই জানালেন
বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির চেয়ারম্যান অজিত রঞ্জন বড়ুয়া। তাঁর কাছ থেকে জানা গেছে মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে।
১৯০৩ সালে আন্দরকিল্লা রংমহল পাহাড়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণের জন্য মাটি খননকালে একটা পুরোনো বুদ্ধ মূর্তি পাওয়া যায়। বিহারের সে সময়ের অধ্যক্ষ অগ্গমহা পন্ডিত উ–ধম্মবংশ মহাথেরের তৎপরতায় মূর্তিটি বঙ্গীয় সরকার এ বিহারে প্রদান করে। বিহারের মূল ভবনটির পাশেই অপর একটি মন্দিরে এই মূর্তিটি স্থাপন করা হয়।
বর্তমানে থাইল্যান্ড থেকে আনা গৌতম বুদ্ধের দুই প্রধান শিষ্য অগ্রশ্রাবক ধর্ম সেনাপতি ‘সারিপুত্র’ এবং ঋষিশ্রেষ্ঠ ‘মহামোগলায়ন” মহাস্থবিরের অষ্টধাতুর নির্মিত মূর্তি বুড়া গোঁসাই মন্দিরে স্থাপন করা হয়েছে বলে জানা যায়।
শনিবার ছুটির দিন সকাল থেকেই রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা এসে থামে বৌদ্ধ বিহারের প্রবেশ মুখে। কেউ এসেছেন পরিবার পরিজন নিয়ে, আবার কেউ একাই আসেন প্রার্থনার উদ্দেশ্যে। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বয়সে নবীন।
নগরীর নন্দনকাননে অবস্থিত চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্য। প্রায় ১৩০ বছর পূর্বে নির্মিত এই বিহার বাংলাদেশের বৌদ্ধদের অন্যতম পূণ্যস্থান হিসাবে বিবেচিত। এটি পরিচালিত হয় বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির মাধ্যমে।
জানা যায়, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির (তৎকালীন চট্টগ্রাম বৌদ্ধ সমিতি) প্রথম সভাপতি উ. গুনামেজু মহাথের এবং সাধারণ সম্পাদক নাজির কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী বিহার স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। প্রাথমিকভাবে ভক্ত এবং পূজারীদের আর্থিক সহযোগিতায় ভবনটির একতলা নির্মিত হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির বর্তমান মহাসচিব সুদীপ বড়ুয়া বলেন, ‘১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধ শাস্ত্রে পন্ডিত উ. গুনামেজু মহাস্থবির ও বৌদ্ধ সমাজের অবিসংবাদিত নেতা নাজির কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরীর নেতৃত্বে তৎকালীন সমাজ সচেতন ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ সমিতি (আজকের বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সমিতির অস্থায়ী কার্যালয় চট্টগ্রাম শহরের তামাকুম–ী লেনে। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে তামাকুমন্ডী লেন অস্থায়ী কার্যালয়ে উ. গুনামেজু মহাস্থবিরকে বিহারাধ্যক্ষ নির্বাচিত করে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করে বিহারের কার্যক্রম শুরু করেন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে নাজির কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী পরলোক গমন করলে বৌদ্ধ নেতা জেলডাক্তার ভগীরথ চন্দ্র বড়ুয়া সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে উ. গুনামেজু মহাস্থবির পরলোক গমন করলে বৌদ্ধরত্ন হরগোবিন্দ মুৎসুদ্দি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পদাধিকারবলে জেলডাক্তার ভগীরথ চন্দ্র বড়ুয়া চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা কমিটির সম্পাদক ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের জন্য ১৪–০১–১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে এক কানি পাঁচ গন্ডা জমি ক্রয় করে ক্রয়কৃত জমিতে ধীরে ধীরে বিহার নির্মাণ করেন।
গৌতম বুদ্ধের কেশধাতু : জানা যায়, চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের সংগ্রহে রয়েছে এক মহামূল্যবান নির্দশন। আর তা হলো, গৌতম বুদ্ধের কেশগুচ্ছ। এর কিছু অংশ আবার এখান থেকেই সরকারিভাবে থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ও জাপানে সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির চেয়ারম্যান অজিত রঞ্জন বড়ুয়া বলেন, ‘ ত্রিশের দশকে আচার্য শাক্য লামা নামে তিব্বতের এক সন্ন্যাসী চট্টগ্রাম ভ্রমণে আসেন। তিনি কিছুদিনের জন্য বৌদ্ধ বিহারে অবস্থান করেন এবং বিহারের অধ্যক্ষ অগ্গমহাপন্ডিত–উ–ধম্মবংশ মহাথেরকে বুদ্ধের কেশধাতু প্রদান করেন। অতি দুর্লভ এই কেশধাতুর কিছু অংশ ১৯৫৮ সালে শ্রীলংকায়, ১৯৬৪ সালে জাপানে, ১৯৭৯ সালে থাইল্যান্ডে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদান করা হয়। শ্রীলংকার সরকার ২০০৭ সালে আবারো বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বৌদ্ধ সমিতি থেকে কেশধাতু গ্রহণ করে। প্রতি বছর বুদ্ধ পূর্ণিমার সময়ে গৌতম বুদ্ধের কেশধাতু সর্ব সাধারণের দর্শনের জন্য খুলে দেয়া হয়।’
বোধিবৃক্ষ ও বোধিমন্ডপ : বিহারের ভেতরে একপাশে একটি বিশাল গাছের নিচে নির্মাণ করা হয়েছে বোধিমন্ডপ। বৃত্তাকার এই মন্ডপের চারপাশে রয়েছে ছোট ছোট বুদ্ধ মূর্তি। পুণ্যার্র্থীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থণা করেন সেখানে। জানা যায়, শ্রীলংকার সরকারের দেয়া গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিধন্য বোধিবৃক্ষের একটি চারা ১৯৮০সালের ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে রোপণ করা হয়। ১৯৯১সালে বোধি বৃক্ষের নিচে বোধিম–প নির্মাণ করা হয়। বোধিবৃক্ষের চারাটি শ্রীলংকার অনুরাধাপুর থেকে পাঠানো হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির চেয়ারম্যান অজিত রঞ্জন বড়ুয়া।
ছোট বুদ্ধ মূর্তিগুলো পাওয়া যায় কর্ণফুলী থানার জুলধা বড় উঠান ইউনিয়নে পুকুর খননের সময়ে মাটির নিচে পাওয়া যায়। সেখান থেকে এগুলো সংগ্রহ করে আনা হয়।
চিন্তামনি গ্রন্থাগার : জানা যায়, চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে বিভিন্ন দুর্লভ পান্ডুলিপিসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার আছে। শাস্ত্রীয় সাহিত্য এবং তালপাতায় রচিত শিল্পকর্ম এই গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করেছে। এর নাম চিন্তামনি গ্রন্থাগার। এখানে তালপাতার পা–ুলপি, পালি ভাষা, বর্মী ভাষা, সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন ধর্মীয় শাস্ত্র সংরক্ষিত আছে।
২০০৫সালে বিহারে প্রবেশের দুই পাশে অধ্যক্ষ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাথের এবং অধ্যক্ষ অধ্যাপক শীলাচার শাস্ত্রী মহাস্থবিরের স্মৃতিমন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও বিহারের মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় গৌতম বুদ্ধের আসনের নিচে দুইপাশে পন্ডিত উ–ধম্মবংশ মহাথের এবং দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাথের এর আবক্ষ মূর্তি রয়েছে।
বিহার ভবনে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তরের ফলক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ২৮ মার্চ এই ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির মহাসচিব সুদীপ বড়ুয়া জানান, সময়ের প্রয়োজনে বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি কর্তৃক নির্মিত চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার বৌদ্ধ শিল্পকলার আঙ্গিকে পুনঃনির্মাণ ও সম্প্রসারণের মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পূজারিদের জন্য খোলা থাকে।
সুত্র: দৈনিক পূর্বকোন