ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের:
বরুয়া বা বড়ুয়া পদবীধারী এক বড়ো আকারের জনগোষ্ঠী ভারত-উপ-মহাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চল জুড়ে প্রাচীকাল থেকে বসতি করে আসছে। তন্মধ্যে ‘অহোমী বরুয়া’ বলতে বর্তমান ভারতের আসাম রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ট বৈষ্ণব জনগোষ্ঠী এবং ‘ বড়ুয়া’ বলতে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীকে বুঝায়। তবে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বৈষ্ণব ধর্ম কোনদিন আসামী ‘বরুয়া’ জন গোষ্ঠীর আদি ধর্মমত ছিল না। আসামের মধ্যযুগীয় নাম প্রাগজ্যোতিষপুর। সেই মধ্যযুগীয় অহোম সভ্যতার অন্যতম কীর্তিস্তম্ভ ‘কামাখ্যা-মন্দির’টি ১৯৮১ খৃস্টাব্দে আমি যখন প্রথম দর্শনে যাই; তখনো পাষাণময় মন্দির গাত্রে যত্রতত্র দেখতে পেয়েছি তান্ত্রিক বৌদ্ধদের অসংখ্য উপাস্য দেব-দেবী; এবং বোধিসত্ত্বগণের খোদাই করা মূর্তি। তবে আমি দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলাম যে, মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ কর্তৃপক্ষ, সজ্ঞানে সেই বৌদ্ধ স্মৃতি চিহ্ন সমূহ মুছে দেয়ার কার্যক্রম বেশ জোরে-শোরে তখন শুরু করেছেন। তারা বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের মূর্তিগুলোর মাথা ভেঙ্গে দিয়ে তথায় প্রতিস্থাপন করছেন বিষ্ণু, মহেশ্বর,শিব, এসকল হিন্দু উপাস্যগণের মুখাবয়ব। এই ভারতবর্ষ সহ বিশ্বের বহু স্থানে, আড়াই হাজার বছরের অক্লান্ত অবিরাম সাধনায়, তিলে তিলে গড়ে তোলা বৌদ্ধ শিল্প ভাস্কর্যের অনুপম স্মৃতি-স্মারকগুলো, কালের বিবর্তনে এভাবেই মুছে যাচ্ছে।
আসাম রাজ্যের রাজা কুমারিল ভট্ট বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন খৃস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে। বিশেষ করে তাঁরই প্রভাবে অহোমী বরুয়ারা, বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণবী হয়ে পড়েন। মগধ অঞ্চলের বৈশালী তথা বৃজিরাজ্যের বজ্জী জনগোষ্ঠীর একাংশ ছিলেন এই আসামী বরুয়ারা। সেই বজ্জী জনগোষ্ঠীরা আসামে করে এসেছিলেন তা পরে বলা যাবে। তবে বৈশালীর বজ্জী জাতির অপর এক অংশ খৃষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে মগধরাজ অজাত শত্রু কর্তৃক বৈশালী আক্রান্ত হওয়ার সময় কাল থেকেই বর্তমান উত্তর বঙ্গ ও পশ্চিম বঙ্গ অঞ্চলেও বসতি স্থাপন শুরু করেছিলেন। তাঁরা বাংলার উগ্র ব্রাহ্মণ্য বাদী রাজা শশাঙ্খের দ্বারা উপদ্রুত অত্যাচারিত হয়ে বুদ্ধ-প্রেমের টানে, সেখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। বলেছি যে, বুদ্ধ-প্রেমের টানেই তাঁদের এই দূর্গম পথে পাড়ি জমানো। কারণ ইতিপূর্বে মগধ অঞ্চলের আর এক ক্ষত্রিয় বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী আকিয়াব অঞ্চলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, তারা ক্রমান্বয়ে ইরাবতী নদের বিশাল অববাহিকা সহ পদ্মা-মেঘনার অববাহিকা পর্যন্ত স্থল ও নৌপথে অধিকার করে বসেন। তাঁদের এই বিশাল ভূ-খণ্ডের নাম ছিল আরকান-সম্রাজ্য। খৃষ্টীয় তৃতীয় শতক থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ছিল এই রাজ্য বিস্তার ও সংকোচনের ইতিহাস। খৃষ্টীয় অষ্টম নবম শতাব্দীর দিকে উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের রাঢ় ও বরেন্দ্র অঞ্চলের বড়ুয়া বৌদ্ধরা যখন দলে দলে আরাকান সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত রমনীয় এই চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে শুরু করলে, ,ক্রমে এ অঞ্চলে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতায়, ধর্ম ও দর্শনের চর্চা এক স্বর্ণযুগের জন্ম দেয়। পাহাড়ে পর্বতে এমনকি সমতলের গ্রাম-গঞ্জেও বিহার ও চৈত্য-মন্দিরে এক অপূর্ব নয়ানাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা হয় সে সময়ে। দেশ-বিদেশাগত মানুষের বিমুগ্ধ হৃদয় হতে তখন স্বতঃ উচ্চারিত হয়ে এ অঞ্চলের নামকরণ হয়ে গেলো চেতিয়া গ্রাম, তথা চৈত্যগ্রাম। এই চৈত্যগ্রামই কালে শব্দান্তরের এই সূত্র ধরে চেতিয়গ্রাম >চৈত্যগ্রাম >চট্টগ্রাম। চট্টলা >চাটিগাঁ > চিটাগং হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম যখন ত্রিপুরার বৈষ্ণব রাজাদের অধিকারে যায় তখন নামকরণ হয় ‘চট্টলা’। যখন মোগল অধিকারে আসে তখন সেই চট্টগ্রাম তাদের মুখে উচ্চারিত হয়েছিল ‘চাটিগাঁ’; আর বৃটিশ অধিকারে আসলে ইংরেজদের মুখের উচ্চারণে হয়ে গেল ‘চিটাগং’। দেশ বিভাগের পরে,ঘুরে ফিরে আজ আবার আমরা ব্যবহার করছি এ ভূমির আদিবাসী বড়ুয়া বৌদ্ধ-জনগোষ্ঠীর প্রদত্ত সেই প্রাচীন নাম-‘চট্টগ্রাম’কে। এক সময়ে সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার নজর কেড়ে নেয়া খৃষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীর বিশাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেই ‘পণ্ডিত বিহার এর জন্মদাতাও ছিলেন এতদঞ্চলের ‘বড়ুয়া বৌদ্ধরা’। সেই কীর্তিধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ও প্রধান আচার্য ‘আনম্পা পুংগ্রী ও আরিপা পুংগ্রীর বংশধরগণ এখনো তাঁদের অভিজাত্য রক্তের ধারা বহন করে চলেছেন এ পবিত্র মাটিতে। বিংশ ও একবিংশ শতাব্দির স্বনামধন্য ভদন্ত কৃপাশরণ, দ্বাদশ সংঘরাজ ভদন্ত ধর্মসেন, ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ, ডক্টর ভদন্ত জ্ঞানরত্ন, ডক্টর ভদন্ত বোধিপাল প্রমুখ কীর্তিমান ভিক্ষুরা পুণ্যময় আনম্পা পুংগ্রী বংশ জাত সন্তান।
বরেন্দ্র অঞ্চলীয় ‘বড়’ ব্রাহ্মণেরা খৃষ্টীয় তেরোশ শতাব্দী পর্যন্ত ‘বড়ু’ উপাধিতে পরিচিত ছিলেন। সেই বড়ুয়াদের খ্যাতনামা কবি ‘বড়- চণ্ডীদাস’ কর্তৃক লিখিত পদাবলী মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অমূল্যরত্নে পরিণত হয়ে বড়- চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ নামে অদ্যাবধি বাংলা-ভাষা ও সাহিত্যে গবেষকগণের কাছে পরম আদরে সংরক্ষিত হচ্ছে। ‘বড়- চণ্ডীদাস’ যে এক কালে বৌদ্ধ দেবী বাসুলীর উপাসক ছিলেন বাংলা সাহিত্য গবেষকগণও তা এক বাক্যে স্বীকার করেন। বর্তমান হিন্দু সমাজে বন্দোপাধ্যায় উপাধিধারী ব্রাহ্মণ বংশধরটি সেই বড়> বাড়-> বাড়-জ্যে> বন্দোপাধ্যায় এভাবে রূপান্তরির হয়েছে। বর্তমান চট্টগ্রামী বড়ুয়ারাও সেই বজ্জী/বৃজী> বড়-> বড়ুয়াতে রূপান্তরিত অবস্থায় আছে।
বর্তমান আসামী বরুয়া ও চট্টগ্রামী বড়ুয়া জাতির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ প্রদর্শন করতে গিয়েই আমার উপরোক্ত ভূমিকাটির অবতারণা। এই উভয় বরুয়া বা বড়ুয়া জনগোষ্ঠীর দুই ভিন্ন চরিত্র নিয়ে কিছু আলোচনার উদ্দেশ্যে এই নিবন্ধটির অবতারণা। আসামরাজ্যের বরুয়ারা তথাকার মোট জন সংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশী। তাঁরা শিক্ষায়-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রতিপত্তিতে আসামের অন্যান্য সমপ্রদায় হতে অগ্রগণ্য। তাই আসামী আদিবাসীদের অধিকার ও স্বাধীনতার দাবীতে বিশাল ভারত সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে ‘উল্ফা’ নামক সংগঠনটির মাধ্যমে যেই সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার নেতৃত্বে রয়েছেন ‘গোলাপ বরুয়া’ প্রমূখ অনেক বরুয়া সন্তান।
আসামের আদি জাতি গোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ, এই বরুয়া উপাধির লোকেরা আসাম রাজ্যের বাইরে তেমন চোখে পড়ে না । কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলের বর্তমান ‘বড়ুয়া’ বৌদ্ধরা চট্টগ্রাম থেকে উৎসারিত হয়ে বাংলাদেশের ঢাকা, কুমিল্লাসহ প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ নগরে; এবং ভারতের সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা,আসাম, মেঘালয় এবং উত্তর প্রদেশে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে; ইদানিং একই ভাবে তারা ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াদি পশ্চিমা দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর-নগরেও ছড়িয়ে পড়ছেন।
আসামী বরুয়ারা স্বভাব-চরিত্রে ও আচার ব্যবহারে আদিবাসীর রক্ষণশীলতা এখনো বজায় রেখেছেন। তাঁদের ভাষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও আচার ব্যবহারে তাঁরা এখনো স্বীয় স্বাতন্ত্র্য বিসজর্ন না দিয়ে, একটি সুনিদির্ষ্ট ভৌগলিক অধিকার ও অক্ষুণ্ন রেখেছেন। অথচ, এই চট্টগ্রামী বড়ুয়ারা যাযাবর প্রবৃত্তির স্বভাব চঞ্চলতায়; তাঁরা কোন সুনির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমায় এক স্থানে দলবদ্ধ হয়ে বসতি করলেন না, সুদীর্ঘ কাল ধরে। এমনটি না থাকার কারণেই তারা ক্রমে আপন ভাব-ভাষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য; একে একে সব কিছুই হারিয়ে বসলো। এই যে আপন স্বকীয়তা; তা ধরে রাখার জন্যে তাঁদের হৃদয়ে আকর্ষণের কি কোন ঘাটতি ছিল? না,একথা মোটেই চলে না। আপন স্বকীয়তা হারানোর; বেদনায় তাঁদের অনেকের মধ্যে বিবেকের তাড়না, হৃদয়ের ক্রন্দন, এখনো শোনা যায়। কিন্তু তাঁদের বিচ্ছিন্ন বসতির প্রবণতাই অতীত এবং বর্তমানের যাবতীয় দুর্ভাগ্যের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হয় ভবিষ্যতে তাঁদের অস্থিত্বের বিলুপ্তিকে ত্বরান্বিত ও করতে পারে তাদের এই বিচ্ছিন্নবাদী প্রবণতা নাম অভিশাপটি; যদি না তারা ইহুদী জাতির মতো আত্ন-গ্লানি মুক্তিতে একদিন কারো না কারো নেতৃত্বে আত্মসমর্পন করে, একতা বদ্ধ হতে চেষ্টা না করেন; এবং কোন নির্দিষ্ট ভূ-খন্ড তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা করে না নিতে পারেন। বড়ুয়াদের অস্থি-মজ্জাগত বিচ্ছিন্ন থাকার স্বভাবটি নিয়ে স্ব সমাজে দু’টি প্রবাদ, সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আছে ‘‘যুদা ভাত হুদাও ভাল’’ এবং “কানা গরুর যুদা বাতাস’’।
বড়ুয়া মানসিকতায় কেবল এই বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রবৃত্তিই প্রবল নহে, তাঁদের সুদীর্ঘ কালের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করে যে, তারা আত্ম-মর্যাদা,আত্ম-সম্ভ্রমতা বোধেও ভীষণ ভাবে দুর্বল। ফলে তারা স্ব সমাজে জন্ম নেয়া গুণী-জ্ঞানীদের প্রতি বরাবরই উদাসীনতা, অবজ্ঞা আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতা প্রদর্শন করে থাকেন। অথচ, অপর সমাজে বা ভিন্ন-সমাজের অনেক কম গুণবানকেও হিমালয় পর্বত মনে করে থাকেন। বাঙালী বড়ুয়ার প্রাণে আনুষ্ঠানিকতার ক্ষণিক আবেগ খুবই প্রবল। তাই দীর্ঘ মেয়াদি কোন কর্মপরিকল্পনা, তা প্রাজ্ঞ-দূরদর্শীতা প্রসূত কোন উদ্যোগ যতই কল্যাণপ্রদ হোক না কেন; তার বাস্তবায়ন এবং সংরক্ষণে, সেই ধৈর্য্য ধারণ করার মন-মেজাজ, তাঁদের চলমান ইতিহাসে অতিবিরল।
পরিশেষে এ কামনাই করবো, বড়ুয়ারা, তাঁদের হারানো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সচেতন হোক, নবতর প্রেরণায় ত্যাগদীপ্ত হোক! মহাকারুণিক বুদ্ধ বৈশালীর বজ্জী জাতিকে খৃষ্ট পূর্ব ৫ম শতকে যেই সপ্ত আপরিহানীয় নীতি ধর্মে দীক্ষা দান করেছিলেন, তাঁদের সেই বংশধর এখানকার বড়ুয়ারা তাঁদের পূর্ব পুরুষের সেই দীক্ষাকে আপন জীবনে পুনঃধারণ করে অনাগত বংশধরগণকে পরম আশীর্বাদে ধন্য করুন। বড়ুয়াদের চিরস্থিতি লাভ হোক!
পণ্ডিত প্রজ্ঞাবংশ মহাস্থবিরের রচনাটা খুবই ভাল লাগল ।
খুবি ভালো লাগলো লিখাটা!
ভান্তে আপনাকে বন্দনা!😍😍😍😍😍😍👏👏👏👏👏
Thank you Bhante, received an answer for a long awaited question.