ডঃ বরসম্বোধি ভিক্ষু:
পালি সাহিত্যে দু’প্রকারের ভিক্ষুর পরিচয় পাওয়া যায়। বিনয় পিটকে ভিক্ষুর যে সংজ্ঞা পাওয়া যায় তা সুত্র পিটকে ভিন্নতর। যেমনঃ ‘উপসম্পন্নেন ভিক্খূনা মেথুনো ধম্মো ন পটিসেবিতব্বো’ । (কম্মবাচা প্রথম অকরণীয় বর্ণনা) অর্থাৎ উপসম্পন্ন ভিক্ষু কর্তৃক মৈথুন (কাম ) সেবন করা উচিত নয়। এখানে যে ভিক্ষুর উল্লেখ করা হয়েছে তাঁরা অবশ্যই মুণ্ডিত মস্তক, দাড়ি-গোপহীন, কাসায় বস্ত্রধারী, গৃহত্যাগী এবং সংঘ কর্তৃক বিধি সম্মতভাবে জ্ঞপ্তি চতুর্থ কর্মবাচা পাঠের মাধ্যমে উপসম্পন্ন ভিক্ষু। এভাবে সমগ্র বিনয় পিটকে সমস্ত বিধি নিষেধ যা আরোপিত হয়েছে সমস্তই বিনয়ানুসারে উপসম্পন্ন ভিক্ষুর জন্যই।
আরেক প্রকারের ভিক্ষুর উল্লেখ সুত্র পিটকে দেখা যায়। এখানে উল্লিখিত ভিক্ষু বিনয় বিধিমতে উপসম্পন্ন হতে হবে তেমন বাদ্যবাদকতা নাই। যিনি গৃহত্যাগী বা গৃহবাসী হয়ে ধ্যান-ভাবনার মাধ্যমে নিরন্তর লোভ-দ্বেষ-মোহ ক্ষয়ের সাধনায় সংসার দুঃখ হতে মুক্তি তথা নির্বাণ লাভের প্রচেষ্টায় রত আছেন তিনিই ভিক্ষু। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে পাঁচজন ঋষিকে উপলক্ষ্য করে বারাণসীর সন্নিকটে সারনাথের ইসিপতনে বুদ্ধ যে তাঁর প্রথম ধর্ম ভাষন ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সুত্র’ দেশনা করেছেন তাঁরা কেহই দাড়ি-গোঁপহীন মুণ্ডিত মস্তক কিংবা বিনয় বিধি মতে উপসম্পন্ন ভিক্ষু ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন জটা ধারী ও দাড়ি-গোপ বিশিষ্ট গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী। কিন্তু দেশনার শুরুতেই বুদ্ধ তাঁদেরকে ভিক্ষু বলে আন্তরিক সম্বোধন করলেন এভাবে – ‘দ্বে’মে ভিক্খবে অন্তা পব্বজ্জিতেন ন সেবিতব্বা’ ।অর্থাৎ ভিক্ষুগণ! প্রব্রজ্যিতদের দ্বারা দু’টি অন্ত (চরম পথ) সেবন করা উচিত নয়। ধর্মচক্র প্রবর্তন সুত্রে বর্ণিত পাঁচজন ঋষিকে বুদ্ধ কেন ভিক্ষু সম্বোধন করলেন? ইহার তাৎপর্য কি? এ সম্পর্কে আমাদেরকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করে দেখতে হবে। সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ধর্মপদে ‘ভিক্ষু বর্গ’ নামে পৃথক একটি অধ্যায় রয়েছে। এ অধ্যায়ে সর্বমোট তেইশটি গাথা রয়েছে। সব ক’টি গাথায় বুদ্ধ ভিক্ষুর সংজ্ঞা প্রদর্শন করতে ইন্দ্রিয় সংযমী ও লোভ-দ্বেষ-মোহ ক্ষয়কারীকেই নির্দেশ প্রদান করেছেন।
ভিক্ষুবর্গের প্রথম গাথায় উক্ত হয়েছে-
চক্খুনা সংবরো সাধু, সাধু সোতেন সংবরো
ঘাণেন সংবরো সাধু, সাধু জিহ্বায় সংবরো
কায়েন সংবরো সাধু, সাধু বাচায় সংবরো
মনসা সংবরো সাধু, সাধু সব্বত্থ সংবরো
সব্বত্থ সংবুতো ভিক্খু সব্ব দুক্খা পমুচ্চতি (৩৬০-৩৬১)
চোখের সংযম সাধু (উত্তম), কানের সংযম সাধু, নাকের সংযম সাধু, জিহ্বার সংযম সাধু। কায়ের সংযম সাধু, বাক্যের সংযম সাধু, মনের সংযম সাধু। সমস্ত ইন্দ্রিয়ের সংযম সাধন উত্তম। ভিক্ষু যিনি সর্ব ইন্দ্রিয়ের সংযম অভ্যাস করেন তিনি সর্ব দুঃখ হতে মুক্ত হন। এখানে বুদ্ধ ভিক্ষু বলতে আগারিক বা অনাগারিক যাঁরাই সাধনা-ভাবনায় নিরন্তর রত আছেন তাঁদেরকেই বুঝিয়েছেন। ধর্মট্ঠ বর্গে বুদ্ধ আরো পরিস্কারভাবে ভিক্ষুর স্বরূপ বর্ণনা করেছেন এভাবে-
ন তেন ভিক্খু (সো) হোতি যাবতা ভিক্খতে পরে
বিস্সং ধম্মং সমাদায় ভিক্খু হোতি ন তাবতা।
যো’ধ পুঞ্ঞঞ্চ পাপঞ্চ বাহিত্বা ব্রহ্মচরিযবা
সঙ্খায় লোকে চরতি স বে ভিক্খু’তি পবুচ্চতি। (২৬৬-২৬৭)
কেহ ভিক্ষাজীবি হলেই কেবল ভিক্ষু হয়না। বিসম ধর্ম অর্থাৎ লোভ-দ্বেষ-মোহ এবং ক্লেশাদি যুক্ত চীবরধারী হলেও ভিক্ষু হয়না। যিনি সাংসারিক পাপ-পুণ্যের ঊর্ধে উঠে ব্রহ্মচর্য হন এবং সংস্কার সমূহ পূর্ণরূপে জ্ঞাত হয়ে সংসারে বিচরণ করেন তিনিই প্রকৃত ভিক্ষুরূপে অভিহিত হন। যিনি নিজেকে চীবরে আবৃত করে মুণ্ডিত মস্তক হয়ে ভিক্ষাজীবি হন তিনি ভিক্ষু হন না। ততাঁদের ভিক্ষুত্ব কেবল নামমাত্র। আচার্য বুদ্ধঘোষ তাঁর বিরচিত সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিসুদ্ধি মার্গের’ শীল নির্দেশে ভিক্ষুর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন-সংসার ভয়ং ইক্খতি’তি ভিক্খু’ অর্থাৎ যিনি সংসারের ভয়কে দর্শন করেন তিনিই ভিক্ষু। এখানে সংসারের ভয় সমূহ কি? জন্ম-বৃদ্ধত্ব-ব্যাধি-মৃত্যু-প্রিয়ের বিয়োগ-অপ্রিয়ের সংযোগ-কাম্য বস্তর অলাভ এবং সংক্ষেপে পঞ্চ স্কন্ধের প্রতি আসক্তি জনিত যে দুঃখের সূচনা হয় এ দুঃখ-ভয় হতে পরিত্রান কামনায় যিনি অকুশল মূল (লোভ-দ্বেষ-মোহ) ধ্বংসের চেষ্টায় সর্বদা রত আছেন তিনিই ভিক্ষু পদবাচ্যে ভূষিত হন। অতএব এ সংজ্ঞানুসারে পঞ্চ ঋষিদের বুদ্ধের ভিক্ষু সম্বোধন যথার্থ। কোণ্ডাঞ্ঞো, বপ্প, ভদ্দিয়, অস্সজি ও মহানাম-এ পঞ্চ ঋষিগণ প্রত্যেকেই সংসার দুঃখের অবসান কামনায় গৃহত্যাগ করে নিরন্তর সাধনায় রত ছিলেন।