1. pragrasree.sraman@gmail.com : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী
  2. avijitcse12@gmail.com : নিজস্ব প্রতিবেদক :
বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০২:৫০ অপরাহ্ন

তথাগত, জানাই প্রণতি

প্রতিবেদক
  • সময় বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৭
  • ৪৯১ পঠিত

ডা:ভাগ্যধন বড়ুয়া : ‘সমস্তই ক্ষণিক,/ সমস্তই দুঃখময়,/ সমস্তই স্বলক্ষণ, এবং/ সমস্তই শূন্য।’ —আপনি বললেন। (বুদ্ধের সঙ্গে সংলাপ/রণজিৎ দাশ)
চারদিকে অস্থিরতা, অবিশ্বাস, মূল্যবোধের অবক্ষয়ে দিনক দিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যেভাবে কঠিন হয়ে পড়েছে, সেখানে বুদ্ধ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন মানবিক চেতনা জাগরণের। পঞ্চশীলের (প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা, চুরি থেকে বিরত থাকা, ব্যভিচার থেকে বিরত থাকা, মিথ্যা থেকে বিরত থাকা, মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা) মাধ্যমে সৎ ও সঠিক জীবনযাপনের। মানুষ প্রকৃত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে বিচারবুদ্ধির সঠিক প্রয়োগ করে নিজের ও অন্যদের মুক্তির পথ দেখাতে পারে। বুদ্ধের অহিংসার বাণী ও মৈত্রীর সমন্বয় ঘটালে অস্থিরতার বিপরীতে গড়ে উঠতে পারে একটি সুন্দর সমাজ। বুদ্ধ বলেছেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে নিজেকে শুদ্ধ করে তোলার অনন্ত সম্ভাবনা। এই শুদ্ধ মন নিয়ে মানুষের কল্যাণ করতে হলে থাকতে হবে বুদ্ধের নির্দেশিত মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা—এই চারটি গুণ:
১। মৈত্রী—জগতের সবকিছুর ভেতর দিয়ে বয়ে চলা জীবনকে ভালোবাসা। ২। করুণা—জগতের সব জীবের প্রতি দয়া। ৩। মুদিতা—জগতের সব জীবনের প্রতি সহানুভূতি। ৪। উপেক্ষা—জগতের সব অস্থিরতার ওপরে উঠে মনটাকে শান্ত ও অবিচল রাখা।
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেস তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতার বই সেভেন নাইটস-এ বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘বৌদ্ধধর্মে রয়েছে অসাধারণ সহিষ্ণুতা, যা বিচ্ছিন্ন করে না।’ এই সহিষ্ণুতার মাধ্যমে বিভিন্ন জাতিতে, বর্ণে, গোত্রে—সবাইকে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করে অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব।
ফকির লালন সাঁই তো বলেই গেছেন, ‘এমন মানব জীবন আর কি হবে’। মানবজীবনে স্বীয় কর্মসাধনের দ্বারা মানুষের উপকার করার মধ্যেই নিহিত আছে ক্ষণস্থায়ী মানবজীবনের শ্রেষ্ঠত্ব। তাই নিজের বিচারবুদ্ধির প্রয়োগে জেনে নিতে হয় ঠিক ও বেঠিক কোনটি। বুদ্ধ স্বয়ং বলেছেন, ‘এসো, বিচার করো, গ্রহণীয় হলে গ্রহণ করো।’ বংশানুক্রমে কোনো ধর্ম বা মত পেয়েছ বলে তাকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। নিজের জ্ঞান, বুদ্ধি, যুক্তি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে সঠিক পথ বের করা প্রাজ্ঞতার লক্ষণ। বুদ্ধ সম্পর্কে দার্শনিক রাধাকৃষ্ণনের একটি মন্তব্য পড়া যাক এখানে—
‘বুদ্ধের ধারণায় ধর্মের প্রেরণা, ন্যায়পরায়ণতা, সদাশয়তা, পরোপকারিতার প্রেরণা সব জিনিসেই সক্রিয় রয়েছে। এগুলোর ফলপ্রদ সক্রিয়তা ও কর্মতৎপরতার পরিণাম হয় বিশৃঙ্খলা, নিষ্ঠুরতা, নিপীড়নের হ্রাস—বুদ্ধের মধ্যে রয়েছে ধর্মের সারমর্ম, ক্ষণস্থায়ী প্রবাহকে ছাড়িয়ে বাস্তব সম্পর্কে দূরদর্শিতা, নিজেকে অতিক্রম করে এক বৃহত্তর সত্তার প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত কর্তব্যনিষ্ঠা, জগতের একধরনের শর্তহীন ও অসীম কর্মশীলতা।’
বৌদ্ধধর্ম বাস্তববাদী ও বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম। কোনো প্রকারের ভক্তিবাদ বা অন্ধবিশ্বাসের স্থান এই ধর্মে নেই। স্বাধীন চিন্তা, যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের কথাই প্রকাশ হয়েছে বেশি। মানবজীবনের চার আর্যসত্য—জ্বরা, ব্যাধি, দুঃখ ও মৃত্যু অবলোকন করে এসবের হেতু, হেতুর কারণ, হেতু নিবৃত্তি, হেতু নিবৃত্তির উপায়ের জন্য ছয় বছর কঠোর সাধনা করে বুদ্ধ দুঃখ বিমুক্তির পথ নির্বাণ আবিষ্কার করেছিলেন। চার আর্যসত্যের সঙ্গে মেলালে বোঝা যায় মানবজীবনে জন্মজন্মান্তর ধরে দুঃখ হচ্ছে রোগের মতো, দুঃখের কারণ হচ্ছে রোগের কারণসদৃশ, দুঃখ নিবৃত্তি হচ্ছে রোগ উপশমতুল্য এবং দুঃখ নিবৃত্তির উপায় হচ্ছে রোগ উপশমের উপায়ের মতো। এই দুঃখ নিবৃত্তির উপায় হচ্ছে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ যথা সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। অর্থাৎ সবকিছু সঠিকভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে চরিত্র নির্মল করতে পারবে, তাতে দুঃখমুক্তি ঘটবে। মানুষের আমিত্ব ও অহংবোধ যদি ক্ষয় হয় তখন সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং মানবধর্মের পথ উন্মুক্ত হবে। গৌতম বুদ্ধ তাঁর উপদেশে বলেছেন, ‘মা যেমন নিজের আয়ু দিয়েও আপন পুত্রের জীবন রক্ষা করে, সর্বভূতের প্রতি সে রকমই দয়া ভাব জন্মাবে।’
বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত দেশ। এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সবাই পাশাপাশি বাস করে। এখানে সবাই শান্তি চায়। শান্তিতে বসবাস সবার আরাধ্য। তাই শান্তি রক্ষা করা সব মানুষের, সব ধর্মানুসারীর কর্তব্য। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি কোনো ধর্মেই কাম্য নয়। তবু কিছু ধর্মান্ধ মানুষ স্বার্থান্বষণে বিভেদ ঘটাতে চায়; এদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধই পারে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে। ‘ধম্মপদে’ বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছেন—‘জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনো শত্রুতার উপশম হবে না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়, ইহাই সনাতন ধর্ম।’ জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অক্রোধের দ্বারা ক্রোধকে জয় করতে হবে এবং তাতেই পৃথিবীজুড়ে বিদ্যমান ক্রোধ, ঘৃণা, হিংসা, হানাহানি, রক্তপাত, সন্দেহ দূরীভূত হতে পারে।
সাম্প্রতিক বিশ্বে মানুষে মানুষে যে বিভাজন, ধনী-দরিদ্রে যে বৈষম্য, নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যে প্রতিযোগিতা, তাতে বুদ্ধের অহিংস বাণীর প্রচার খুবই প্রাসঙ্গিক। স্মৃতিবিজড়িত এই পবিত্র দিনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে লিখিত ‘বুদ্ধদেব’ প্রবন্ধের শেষ কয়টা লাইন উল্লেখ করেই সমাপ্ত করা যাক—‘তাঁরই শরণ নেব যিনি আপনার মধ্যে মানুষকে প্রকাশ করেছেন। যিনি সেই মুক্তির কথা বলেছেন, যে মুক্তি নঞর্থক নয়, সদর্থক; যে মুক্তি কর্মত্যাগে নয়, সাধুকর্মের মধ্যে আত্মত্যাগের; যে মুক্তি রাগদ্বেষ বর্জনে নয়, সর্বজীবের প্রতি অপরিমেয় মৈত্রী সাধনায়। আজ স্বার্থান্ধ বৈশ্যবৃত্তির নির্মম নিঃসীম লুব্ধতার দিনে সেই বুদ্ধের শরণ কামনা করি, যিনি আপনার মধ্যে বিশ্বমানবের সত্যরূপ প্রকাশ করে আবির্ভূত হয়েছিলেন।’
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।

Facebook Comments Box

শেয়ার দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো
© All rights reserved © 2019 bibartanonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazarbibart251
error: Content is protected !!