উথোয়াই মারমা জয়, বান্দরবান প্রতিনিধি:জ্ঞান আহরণ। -তা তো মানুষ নামক জীবে করে, তাও আবার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে। যার সাথে রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পদ্ধতি! এর সঙ্গে আবার যুক্ত হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক্স মাধ্যমের বিভিন্ন ডিভাইস ও ইন্টারনেট। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে আপনার হাতের মুঠোয় পেতে পারেন পৃথিবীর সব খবর।
কিন্তু এতসব প্রযুক্তি থাকা আর প্রযুক্তি ব্যবহার জেনেও একটা বিপজ্জনক প্রশ্নের উত্তর কি আমরা পাচ্ছিঃ “পাগলা ষাঁড়ে করলে তারা কেমন করে ঠেকাবে তায়?” আবার হাসছেন? ভাবছেন আমার মাথাটা ঠিক ‘ইয়ে’ আছে কিনা! কোথায় মারমা চেতনার বিপ্লব, তথ্য প্রযুক্তির (Information Technology) বিজয়-নির্ঘোষ আর কোথায় তুচ্ছ প্রমত্ত ষন্ত! এদের আদৌ মেলানো যায় কি? যত সব আজগুবি কথা!
মেলাবেন, তিনি(অর্থাৎ-প্রকৃত দেবী) ঠিকই মেলাবেন! অগ্রগতির ঘোড়া হাওয়া এবং আমাদের সযত্নলালিত সংস্কারের মাচাং বাড়ির দরজা-এক অপরের সঙ্গে সুন্দরভাবে মিলে যাবে। আর যাবে বলছিই বা কেন, প্রতি নিয়তই তো যাচ্ছে। আমরা অন্ধ বলেই তো আমাদের চারপাশের প্রলয় বন্ধ থাকছে না। বহিরঙ্গ উন্নতি এবং অন্তরঙ্গ সমস্যা পরস্পর প্রতিযোগীতা করে বেড়েই চলেছে। তথ্য প্রযুক্তির (Information Technology) যুগে প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়তে হয়না, সামাজিক যোগাযোগ সাইট ও অনলাইনে প্রবেশ করলেই প্রমাণ মিলবে ভুরিভুরি। সামান্য কয়েকটা ভয়ঙ্কর উদাহরণ দিচ্ছি, শুনুন-
-বিশ্লেষকদের মতে, প্রতি পনেরো দিনে একটি করে ভাষা হারাচ্ছে পৃথিবী থেকেঃ আন্তর্জাতিক ভাষাগবেষণা ইনস্টিটিউট। মারমা ভাষাও কি এর অন্তর্ভূক্ত?
-মারমা ভাষার ব্যবহার বাড়ছে না কি হারিয়ে যাচ্ছে?
-পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ম্লান হয়ে যাচ্ছে দেশের মারমা জাতির প্রাচীনতম ভাষা।
-বর্ণমালা থাকা সত্ত্বেও মারমা ভাষা মুখে মুখে।
-ভাষার দেশে মারমা আদিবাসী গোষ্ঠীর মাতৃভাষা।
-আদিবাসী শিশুরা মাতৃভাষায় পড়বে কবে?
-আদিবাসী গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারের আন্তরিকতা নেই বা কেন?
– আদিবাসী গোষ্ঠীর ভাষাচর্চা কোন পথে?
-আদিবাসী সম্পর্কে ভুলে ভরা-বাংলাপিডিয়া।
আরো উদাহরণ দেবার প্রয়োজন আছে কি? প্রতিদিনের সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুক, টুউটার, খবরের কাগজে, অনলাইন নিউজ, টিভি-তে বয়ে আনছে এই ধরনের অসংখ্য ভয়ঙ্কর খবর। মারমা ভাষা সত্যিই কি তাহলে ক্রমস হারিয়ে যাচ্ছে? আমরা কি তাহলে ভাষা বর্ণমালা হারানো জাতিতে পরিণত হচ্ছি?
“প্রত্যেক আদিবাসীর নিজস্ব ভাষা (কথ্য ও লেখ্যরুপ) থাকলেও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রতিকূলতার কারণে কথ্য রূপটাই টিকে আছে। লেখ্য রূপটা হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমান শিক্ষিত প্রজন্মতো নয়ই, এমনকি এর আগের প্রজন্মের সিংহভাগ শিক্ষিতরাও নিজস্ব ভাষার বর্ণমালার সাথেও পরিচিত নন। আধুনিক সমাজের অগ্রায়ন ঘটে সামাজিক, সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের আদান-প্রদান ও বিনিময়ের মাধ্যমে। এতে সংস্কৃতি ও জাতির উন্নতি হয় আর কিছুই হারায় না। কিন্ত আদিবাসীদের ক্ষেত্রে তার উল্টোটা।
আদিবাসীরা অন্য সংস্কৃতির উপাদানগুলো গ্রহণের সাথে সাথে নিজ সংস্কৃতির উপাদানগুলো চর্চা করা, সংরক্ষণ করছে না আর এমন উদ্যোগও নিচ্ছে না। এমন করেই নিজ ভাষার লিখিত রূপ চর্চা আমরা আদিবাসীরা করছি না। আর এভাবেই আমাদের ভাষার লিখিত রূপ হারিয়ে যাচ্ছে। এতে কোন সন্দেহ নেই।”
এবার মারমা প্রসঙ্গঃ আমরা মারমারা শুরু করি, শেষ করি না। হয়তো আমার কথাটা সকলের কাছে পছন্দ নাও হতে পারে। তাই মার্জনা চাইছি। তবে জীবনের এই পর্যন্ত অভিজ্ঞতা থেকে এমনটিই মনে হয়েছে আমার।
কম বেশি ৮০ এর দশকে শুরু হয়েছিল মারমা চেতনার বিপ্লব। আমাদের অর্থনৈতিক এবং সার্বিক উন্নতির প্রথম প্রচেষ্টা। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল মারমা ঐক্য পরিষদ, মারমা সংস্কৃতি সংস্থা, মারমা ইউনিটি ফোরাম, মারমা কালচার সোসাইটি, মারমা কল্যাণ সংস্থা, মারমা উন্নয়ন সংস্থা, মারমা পরিষদ, মারমা ষ্টুডেন্টস ফোরাম, মারমা ষ্টুডেন্টস ইউনিটি অর্গানাইজেশন, বাংলাদেশ মারমা ষ্টুডেন্টস কাউন্সিল (বিএমএসসি)সহ অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠান। গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান ছাড়া আজ কোথায় তাদের অস্তিত্ব! নানাবিধ স্ব-অর্ন্তঘাতই এক এক করে বিনষ্ট করেছে এমনি সব সোনার প্রতিষ্ঠানকে। প্রত্যেকটি সংগঠনে রয়েছে গঠনতন্ত্র। আর গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে অধিকার, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ জাতির বিভিন্ন উন্নয়নের কথা।
সব কাজেই আমরা সবার আগেই উদ্যোগ নিই আর পিছিয়েও পরি সবার আগে। হতাশ হয়, হতাশ করিও অন্যকে! এই হতাশাই আমাদের সর্বনাশের মূল। হতাশ হবার আগে আমরা কখনো একটি বার ভেবে দেখিনা আমরা কেন পারি না? কেন আমি বা আমরা অসফল হলাম? তা জানতে পারলেই কিন্তু এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হতো। আমরা কিছু কাজ খুব পারি- অন্যকে উস্কানি দিতে, হুমকি দিতে, অন্যের কাজে বাধা দিতে, অন্য কারো সেবামূলক কাজের প্রাপ্ত অর্থ ডাকাতি করতে, বিহার উন্নয়নের বরাদ্ধ অর্থ নিজের পকেটে ভারী করতে, গঠনমূলক কাজে অশংগ্রহণ না করা আর ভাষা বর্ণমালা শেখার ক্ষেত্রে অন্যকে উৎসাহিত না করা ইত্যাদি। এসব কিছু থেকে যদি আমরা বেড়িয়ে আসতে পারি তাহলে মনে হয় কিছুটা সমস্যা সমাধান হবে।
প্রতিটি সংগঠনের উচিত একে অপরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা। উদ্দেশ্য ভিন্ন হতে পারে বিন্তু সমাজ ও ভাষা সংস্কৃতি রক্ষায় সবাইকে একযোগ হয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে নিজস্ব মাতৃভাষা বর্ণমালা শেখার বিষয়ে।
আমরা নিজেরাও শিখি না, অন্যকে উৎসাহিতও করি না। আমাদের মধ্যে সবসময় একটা উগ্রপন্থি নেগেটিভ ভাব কাজ করে আর সেটি হল “আমার চাইতেই সে শিখে ফেলবে”। এটাই হলো আমাদের মূল সমস্যা। এ উগ্রপন্থি সাথে যোগ হয়েছে অসচেতনতা।
আমরা যদি এই ধরনের নেগেটিভ চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি, তাহলে আমার বিশ্বাস মারমা জাতি আর কলুসিত হয়ে থাকবে না। পিছিয়ে থাকবে না নিজ মাতৃভাষা থেকেও।
সচেতনতা প্রয়োজন নেই বরং বাস্তবে প্রয়োগ ঘটানো দরকার। কেননা সচেতনতার কথা সবাই বলছে, শুধু আমি নয়।
মারমা ভাষার বর্ণমালা জানতে আর শিখতে পারেন-
https://marma-pedia.blogspot.fr/?m=1