বিবর্তন অনলাইন ডেস্ক: মাটি আর কাদায় ভবন তৈরি হয়? তাও আবার ষোলতলা। হ্যাঁ এমন আশ্চর্যজনক সুউচ্চ প্যাগোডা নির্মিত হয়েছে ধীরে ধীরে। একেকটি তলার কাজ শেষ করে পরে তার ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি করা হয়েছে আরেক তলা। এভাবে পর্যায়ক্রমে ষোলতলা। মানে ষোলটি বুদ্ধ স্তূপা। যেখানে মানুষ উপাসনা করবে। যা দেখলে মনে হবে বুদ্ধ নীতি দাঁড়িয়ে আছে সবার উপরে। পাহারা দিচ্ছে কুনমিং-এর ত্বালি শহরকে। আর এটি শহরের যে কোনো স্থান থেকে চোখে পড়বে। এমন একটি নির্মাণশৈলী আধুনিক চীনে শত শত বছর ধরে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। সময় যত গড়িয়েছে বিস্ময় তত বেড়েছে এই স্থাপনা নিয়ে। এটি হলো চীনের থ্রি প্যাগোডা। বাংলায় বললে দাঁড়াবে তিন মঠ। ১৯শে সেপ্টেম্বর আমরা যখন ত্বালি শহরে প্রবেশ করি তখন থেকেই চোখে পড়ে থ্রি প্যাগোডা। অবশ্য এর একটি অনুকৃতি বা রেপ্লিকা আমরা দেখেছি কুনমিং-এ ন্যাশনালিটি ভিলেজে। ত্বালি পৌঁছে পরদিন ২০শে সেপ্টেম্বর নাস্তা পর্ব সেরে সকাল ঠিক ৯টায় আমরা পৌঁছে যাই থ্রি প্যাগোডায়। সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি ছিল। তুমুল বৃষ্টি নয়, এটি মেঘ-পাহাড়ের ধাক্কায় এক রোমান্টিক ভাবলুতায় আক্রান্ত বৃষ্টি। গাইড ই আমাদের এই প্রকৃতির খেলা মাথায় রেখে সবরকম প্রস্তুতি আগে থেকেই নিয়ে আসতে বলেছিল। যেমন বাধ্যতামূলক ছাতা আর রেইনকোট। এর বাইরে আমরা সেখানে নেমে দেখি পা আর জুতোর নিরাপত্তার জন্য বিক্রয় হচ্ছে মোড়ক। যা আমরা পাঁচ আরএমবিতে অনেকেই পরে নিলাম। তারপর টিকিট কাটার বিষয় সাইড সামলে নিল। আমাদের পুরো এলাকাটি ঘুরে দেখতে সময় দেয়া হলো দুই ঘণ্টা। চাংশান পাহাড় আর ইরহাই লেকের মাঝামাঝি অবস্থিত থ্রি প্যাগোডা আমাদের টানছিল জাদুটোনার মতোই। কোনো এক অদৃশ্য সুতোর টানে আমরা যেন সবাই ছুটছিলাম।
প্রবেশ মুখেই রয়েছে বিশালাকৃতির বেল টাওয়ার। মানে ঘণ্টাঘর। এক সময় ঘণ্টার আওয়াজ শহরকে জানান দিতো। ত্বালি শহরের অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ব্রোঞ্জের এই ঘণ্টার আওয়াজ পৌঁছে যেত। ৯০ ফুট উঁচু এই বেল টাওয়ারের ভেতরে থাকা এই ঘণ্টা প্যাগোডা নির্মাণের অনেক পরে নির্মিত হয়। থ্রি প্যাগোডা নির্মিত হয়েছে বারশ’ বছর আগে। ৯০৬ এবং ৯০৭ সালের মধ্যে। তখন ছিল নানঝো শাসকদের সময়। আর বেল টাওয়ার ও ঘণ্টা নির্মিত হয় মিং শাসনামলে। বলা হয়ে থাকে, এই ঘণ্টা নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যে আগুনে তা ধ্বংস হয়ে গেলে পরে ১৭৪৭ সালে এটি পুনঃনির্মাণ করা হয়। প্রথমদিকে এই ঘণ্টা লোহায় নির্মিত হলেও পরে আওয়াজ অনেক দূর পর্যন্ত যায় না বলে ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি হয়। আর ব্রোঞ্জের ঘণ্টা নির্মাণ নিয়েও রয়েছে নানান লোকশ্রুতি। এই ঘণ্টার কারিগর ছিলেন দেং। বছরখানেক চেষ্টা করেও সেই ঘণ্টার কাজ দেং পুরোপুরি নিখুঁতভাবে শেষ করতে পারেননি। বাবা কাজ শেষ করতে না পারলে রাজ দরবারের অপমান আর শাস্তি পাবে এবং উল্টো জরিমানা গুনতে হবে তা নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লো দেং-এর মেয়ে। উপায়ন্তর না দেখে বাবার সম্মান চিন্তায় মেয়ে ঢালাইয়ের দেবতাকে তুষ্ট করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তপ্ত কড়াইয়ে। গলিত ব্রোঞ্জের মধ্য থেকে শুধু একপাটি জুতো উদ্ধার করতে পারে তার পিতা। মেয়েটির মৃত্যু হয়। কথিত আছে, এরপরে ঢালাই কাজ সফলভাবে শেষ হয় এবং ব্রোঞ্জের সেই ঘণ্টার আওয়াজ ত্বালি শহরের আনাচে-কানাচে পৌঁছে। মেয়েটি যেখানে আত্মাহুতি দেয়, সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। সাধারণ মানুষের মনে সেই মেয়েটি ‘ঘণ্টা ঢালাইয়ের দেবী’ নামে পরিচিত হয়। আর প্রকৃতি যেদিন ভালো থাকে সেদিন স্পষ্ট ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়। কিন্তু বলা হয়, ঝড়ো সন্ধ্যায় বা বৈরী আবহাওয়ায় বাজানো ঘণ্টা নিঃসঙ্গ বিলাপের মতো শোনায়। এই মর্মন্তুদ গল্পটি আর তার জন্য নির্মিত সেই মন্দির পার হয়েই যেতে হয় মূল প্যাগোডার দিকে। আর তারপর থেকে শুরু হয় একের পর এক বুদ্ধ মন্দির, স্তূপা, প্রার্থনা হল।
থ্রি প্যাগোডার বেদিতে
দূর থেকে দেখে মনে হয় তিনটি সমান প্যাগোডা দাঁড়িয়ে আছে। একটি বাঁয়ে। একটি ডানে। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে ছাতা হাতে যতই কাছে যাচ্ছি জাদুকরি এই স্থাপত্য নকশার বিষয়ে ততই স্পষ্ট হচ্ছি। চংশেন টেম্পল বা চংশেন মন্দিরের এই তিনটি প্যাগোডা একই ধরনের হলেও দুটি সমান উচ্চতার আর একটি সর্বোচ্চ উচ্চতার। এর মধ্যে মূল প্যাগোডা নির্মিত হয় নানঝো শাসনামলে। আর বাকি দুটি ত্বালি কিংডমে। মূল প্যাগোডা ষোলতলা। ২২৭ ফিট বা ৬৯.১৩ মিটার লম্বা। এই প্যাগোডা চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়। আর এই প্যাগোডার প্রতিটিতে রয়েছে একেকটি গল্প। আর ত্বালি কিংডমে নির্মিত হওয়া দুটি প্যাগোডা একই সময়ে নির্মিত। ছোট দুটি প্যাগোডা একই মাপের। প্রতিটি দশতলা আর উচ্চতায় ১৪০ ফিট বা ৪২.১৯ মিটার। মূল প্যাগোডাকে বলা হয় চিয়ানশাং প্যাগোডা। এটি নির্মাণকাল ৮২৩-৪৪০ শতক। নানঝো কিংডমের রাজা ছিলেন তখন চুয়ান ফেংউ। ত্বালি কিংডমে নির্মিত দুটি প্যাগোডার একটি উত্তর পশ্চিমে আর অন্যটি দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। ১৯৭৮ সালে সংস্কার কাজের সময় প্রায় ৭০০টি বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়। যার মধ্যে বেশকিছু হাতে লেখা ত্রিপিটক, বইপত্র, খোদাই করা ব্রোঞ্জের তৈজসপত্র, ব্রোঞ্জের আয়না, সোনা-রূপা, ব্রোঞ্জ, লোহা, চিনামাটি, পাথর, নানান ঔষধি বৃক্ষ আর স্ফটিকের তৈরি বৌদ্ধমূর্তি। এই তিনটি প্যাগোডায় ংুসহবঃরপ ঃৎরধহমষব বা ত্রিভুজাকৃতি ধরনের। তিনটি প্যাগোডা নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি ও কাদা দিয়ে। ত্বালি শহরের পাহারার জন্য এই থ্রি প্যাগোডা নির্মাণ করেছিল রাজারা। তবে এর মধ্য দিয়ে ত্বালি বৌদ্ধ শাসনের জয়ের চিহ্নও আঁকা হয়েছে। থ্রি প্যাগোডা স্তম্ভ থেকে ত্বালি শহরকে ওয়াচ করা যায়। কিন্তু এই তিনটি প্যাগোডায় সব বিস্ময়ের শেষ নয়। এরপর থেকে শুরু হয়েছে একের পর এক মন্দির ও স্থাপনা। মাঝে-মধ্যেই রয়েছে পুকুর। আর ধীরে ধীরে পেছন দিকে যেতে যেতে এক সময় মনে হবে যে চাংশান পর্বতমালার ভেতর প্রবেশ করে যাচ্ছে মন্দিরগুলো। কখনও কখনও পাহাড় চূড়ার মেঘ ক্রমে ঢেকে দিচ্ছে মন্দিরের চূড়াকে। ৫.৬৮ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে চংশেন টেম্পল এবং থ্রি প্যাগোডার অবস্থান। চীনা স্টেট কাউন্সিল এই স্থাপনাকে জাতীয় সম্পদ এবং সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। থ্রি প্যাগোডা আর চংশেন টেম্পল উৎসুক পর্যটক, স্থাপত্যবিদ ও গবেষকদের জন্য গবেষণার উৎকৃষ্ট উপাদান। জাদুকরি এই স্থাপনা ত্বালিতে বুদ্ধ নিদর্শনের অন্যতম সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। বলা হয়ে থাকে, যদি সুখী হতে চাও তবে চংশেন টেম্পলে যাও এবং বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন কর।
থ্রি প্যাগোডায় সবমিলে ৪০টি স্থাপনা রয়েছে। যার মধ্যে ১১ নম্বরে রয়েছে থ্রি প্যাগোডা। এর মধ্য দিয়ে শুরু ভেতরে প্রবেশ। তারপর একের পর এক মন্দির আর নানা প্রার্থনা স্থান। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো হচ্ছে নানাঝো জিয়ানজি বেল টাওয়ার, ইথং অবলোকেসর্বা হল, বুদ্ধা গার্ডেন, থংখং গম্বুজ, চংশেন টেম্পল, ফরচুন গড হল, মেডিসিন বুদ্ধা হল, হ্যাভেনলি কিং হল, মৈত্রিয়া হল, প্রেয়ার হুইল, ইলেভেন ফেইস অবলোকিতসর্বা হল, হাজারি বুদ্ধা হল, মহাবীরা হল, বুদ্ধিজম একাডেমি এবং সর্বশেষ লেকভিউ টাওয়ার।
নেপথ্যের কথা
থ্রি প্যাগোডার সূচনা মাঙ্গলিক কারণে। এক সময় চীনের এ অঞ্চল বিশেষত ত্বালি ছিল অশুভ ড্রাগনদের দখলে। মানবসভ্যতার সূচনার আগ দিয়ে এইসব অশুভ ড্রাগনরা দাবড়ে বেড়াতো সর্বত্র। মানুষ তার সৃষ্টির পর থেকে বিশ্বাস করতো অনেক ড্রাগন প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। ড্রাগনদের এই ধ্বংসা লীলা থামাতে স্থাপন করা হয় থ্রি প্যাগোডা। ত্বালিতে থ্রি প্যাগোডা হচ্ছে সুন্দর ও স্বাভাবিকতার পথে ফেরার প্রতীক। হাজার বছর ধরে মানবসৃষ্ট সম্পদ সুরক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এই প্যাগোডা। এই প্যাগোডার মূল টেম্পল বলা হয়ে থাকে চংশেন মোনাস্ট্রিকে। চংশেন টেম্পল মূল প্যাগোডা নির্মাণের একই সময়ে নির্মিত হলেও পরে তা চিং ডায়নেস্টির সময় আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। পরে তা পুনঃনির্মাণ করা হয় ২০০৫ সালে। মিং ডায়নেস্টির সময় ১৫১৫ সালের ৬ই মে এক প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পে মূল চিয়ানশান প্যাগোডা ধ্বংস হয়ে যায়। কথিত আছে কয়েকদিন পর আফটার শক ভূমিকম্পে পুরো প্যাগোডা পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। অথচ সেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে ত্বালি শহরে মাত্র ১০০টি ভবন টিকে ছিল।