ভিক্খু প্রজ্ঞাশ্রী:
“চরথ ভিক্খবে চারিকং (হে ভিক্খুগণ, সম্মুখে এগিয়ে যাও), বহুজন হিতায-বহুজন সুখায-লোকনুকম্পযা (বহুজনের হিত-কল্যাণের জন্য, সুখের জন্য পৃথিবীর প্রতি অনুকম্পা পূর্বক), আত্ম হিতায সুখায দেবমনুস্সানং (নিজের, দেব-মানবের হিত, মঙ্গল, সুখের জন্য), দেসেত ভিক্খবে ধম্ম আদিকল্যানং, মজ্জকল্যানং, পরিযোসানকল্যানং (ধর্ম দেশনা করো যে ধর্ম আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ, অন্তিমে কল্যাণ)”।
সর্বজ্ঞ-সর্বদর্শী, দেব-মানবের শাস্ত্রা মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধের এরকম প্রেরণাদায়ী নির্দেশে অনুপ্রাণিত হয়ে সদ্ধর্ম্ম ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয়ে পূজনীয় মহান ভিক্খুসংঘ দিকে দিকে, গ্রামে-গ্রামান্তরে অদ্যাবধি ছুটে চলেন, বিতরণ করেন ধর্মসুধা, প্রার্থনা করেন বিশ্বশান্তি। আমরা অতিবাহিত করছি তেমনি একটি পবিত্র এবং গৌরবণীয় পূণ্যমাস ‘শুভ কঠিন চীবর দান’ মাস। পরম পূজনীয় ভিক্খুসংঘরা সমস্ত প্রাণীর কল্যাণার্থে ছড়িয়ে দিচ্ছেন মহানুভব তথাগত বুদ্ধের অমিয় সদ্ধর্ম্মসুধা। বসুন্ধরায় ধ্বনিত হচ্ছে অমিত শান্তির বাণী।
“গিরিরাজ সমং কত্বা সঙ্ঘে দেতি তিচীবরং, যো দেতি কঠিনং একং বিপুলা তস্স দক্খিণা” অর্থাৎ সুমেরু পর্বতের সমান রাশি করে ত্রিচীবর সংঘদান করলে, যেই ফল হয়, তার চেয়ে মাত্র একখানা কঠিন চীবর যে ব্যক্তি দান করে তার ফলই বিপুল। জগতে প্রচলিত যত প্রকার দানময় পুণ্যকর্ম রয়েছে তন্মধ্যে কঠিন চীবর দানই শ্রেষ্ঠ দানময় পুণ্যকর্ম। এ কঠিন চীবর দান বিশ্ব থেরবাদী বৌদ্ধদের একটি প্রধান ধর্মীয় আচার, উৎসব। যা একই মাসে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, চীন, জাপান, ভুটান, নেপাল, লাউস, তিব্বত, ভিয়েতনাম, মঙ্গোলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধ বিহার সমূহে একেক দিন একেক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই অনুষ্ঠানে মূলত ভিক্খুসংঘের চীবর নামক গেরুয়া পরিধেয় বস্ত্র দান করা হয়। ভিক্খুসংঘ কঠিন চীবর লাভ করে বিনয় সম্মত ভাবে ধর্মীয় কার্যাদি সম্পন্নের মধ্য দিয়ে ফাল্গুনী পূর্ণিমা পর্য্যন্ত এ কঠিন চীবর সাথে রেখে কঠিন স্কন্দ তথা বিনয়-নীতি অনুশীলন পূর্বক পরিশুদ্ধতা লাভ করেন।
বর্ষাব্রত এবং কঠিন চীবর দানের প্রবর্তনঃ
প্রথমে আমরা জেনে নিই ‘বর্ষাব্রত বা বর্ষাবাস’ প্রবর্তন সম্পর্কে। একদা মহাকারুণিক তথাগত সম্যকসম্বুদ্ধ দায়কগণের অভিযোগ এবং সকলের হিত-মঙ্গল কামনা পূর্বক উপলব্ধি করলেন যে, বর্ষা মৌসুমে ভিক্খুরা গ্রামাঞ্চলে পদব্রজে ভ্রমণ করতঃ শত শত ফসলের ক্ষতি এবং বন্যপ্রাণীর অপকার হতে পারে। আর তাই বুদ্ধ একটি নিয়ম প্রবর্তনের অনুজ্ঞা প্রদান করলেন যে, “হে ভিক্খুসংঘ, আমি নির্দেশ প্রদান করছি বর্ষা মৌসুমের তিন মাস তোমরা ভ্রমণ করবে না”। এ তিনমাস তোমরা এক স্থানে, একত্রে থেকে শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা অনুশীলন করবে। তখন থেকে ‘বর্ষাব্রত’ প্রথা প্রবর্তিত হয় এবং অদ্যাবধি পূজনীয় ভিক্খুসংঘ আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরদিন থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস সুচারুরূপে বর্ষাব্রত পালনের পর মহান প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপনের মধ্য দিয়ে সমাপন করেন বর্ষাব্রত বা বর্ষাবাস। বর্ষাবাস সময়কালিন ভিক্খুসংঘরা ধ্যান, ধর্মচর্চা, গবেষণা ও শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভিক্খু জীবনকে পরিশুদ্ধ এবং সম্যক জ্ঞান উপলব্ধিতে আত্ম নিয়োগ করেন। আর গৃহীরাও প্রত্যেক অষ্টমী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে অষ্টশীল প্রতিপালনের মধ্যদিয়ে আত্ম নিয়ন্ত্রণের সম্যক প্রচেষ্টায় আত্ম নিয়োগ করেন। একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, ভিক্খুসংঘের বেশীরভাগই বর্ষাব্রত সমাপন কালেই অরহত্ব মার্গফলে তথা বিমুক্তি লাভে সমর্থ্য হয়েছিলেন।
কঠিন চীবর দানের প্রবর্তনঃ
এবার আমরা ‘কঠিন চীবর’ দানের প্রবর্তন সম্পর্কে জেনে নিই। একদা গৌতম বুদ্ধ শ্রাবস্তীর নিকটে জেতবনে আনাথপিন্ডিক শ্রেষ্ঠীর নির্মিত বিহারে অবস্থানরত ছিলেন। সে সময় পবেয়্যকবাসী ত্রিশজন ভিক্খুসঙ্ঘকে উপলক্ষ করে দানশ্রেষ্ঠ কঠিন চীবর দানের প্রবর্তন করেছিলেন। সেই ত্রিশজন ভিক্খুসঙ্ঘ সকলেই অরণ্যবাসী ভিক্ষান্নজীবি, পাংশুকুল চীবর (তদানীন্তনকালে মৃত্য ব্যক্তিকে যে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে উন্মুক্ত শ্মশানে নিক্ষেপ করা হত) এবং ত্রিচীবরধারী ছিলেন। তাঁরা বুদ্ধকে দর্শন এবং বুদ্ধের নিকটে থেকে বর্ষাবাস উদ্যাপন করার প্রত্যয়ে নিজ নিজ বিহার থেকে রওনা হলেন। কিন্তু তাঁরা শ্রাবস্তীতে বুদ্ধের নিকট পৌঁছানোর পূর্বেই বর্ষাকাল সমাগত হল। ভিক্খুসংঘরা বুঝতে পারলেন এই বর্ষায় তাঁরা শ্রাবস্তী পৌঁছাতে পারবেন না। তাই তাঁরা অগত্যা পথিমধ্যে মহাশ্রেষ্ঠী ধনকুবের মেণ্ডক পুত্র ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর নির্মিত সাকেত নগরে বর্ষাবাস শুরু করলেন। ক্রমে বর্ষা শেষ হলে বিনয় বিধান অনুসারে প্রবারনা কর্ম সম্পন্ন করে ভিক্খুসংঘ পরম শ্রদ্ধাচিত্তে ধর্মপিতা, ধর্মাধিরাজ সম্যক সম্বুদ্ধকে পূজা-বন্দনা, দর্শন করার মানসে শ্রাবস্তীর উদ্দেশ্যে পুনরায় যাত্রা শুরু করলেন। কিন্তু রাস্তা ছিল কাঁদা দিয়ে পুরু, মেঘ থেকে তখনও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি এবং গাছ থেকে বৃষ্টির জমে থাকা জলবিন্দু ঝড়ে পড়ছিল। ভিক্খুসংঘ সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে দীর্ঘ পরিভ্রমণের পর কর্দমাক্ত এবং জবজবে চীবরে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে শ্রাবস্তীতে তথাগত সমীপে উপস্থিত হলে মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধ ভিক্খুসংঘকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন পূর্বক তাঁদের কুশলাকুশন জানার অভিপ্রায়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে ভিক্ষুগণ, তোমরা নিরুপদ্রপে ছিলে তো? সুখে দিন যাপন করেছ তো? নির্বিবাদে ও নির্বিঘ্নে বর্ষাবাস সমাপন করেছ তো? ভিক্ষান্ন সংগ্রহে কোন সমস্যা হয়নি তো?” ভিক্ষুগণ সবিনয়ে প্রত্যুত্তরে জানালেন, “ভগবান আমরা নিরুপদ্রপে ছিলাম, সুখে দিন যাপন করেছি, নির্বিবাদে ও নির্বিঘ্নে সুচারুভাবে বর্ষাবাস সমাপন করেছি। ভিক্ষান্ন সংগ্রহে কোন কষ্ট হয়নি”। পরে তারা পবেয়্যক প্রদেশ থেকে বুদ্ধ দর্শনে আগমনের বিড়ম্বনার কথা ব্যক্ত করে ছিন্ন চীবরে কর্দমাক্ত হয়ে আগমনের কারণ বর্ণনা করলেন। তখন ধর্মাধিরাজ বুদ্ধ ভিক্খুসঙ্ঘের এ দুদর্শা দেখে অতিরিক্ত একটি চীবরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতঃ একটি নিয়ম প্রবর্তনের আহ্বান করলেন। বুদ্ধ প্রজ্ঞাপন করেন, “হে ভিক্খুসংঘ, আমি নির্দেশ প্রদান করছি বর্ষাবাসকারী ভিক্খুগণ কঠিন চীবর আস্তৃত হবেন”। তখন থেকে কঠিন চীবর প্রথা প্রবর্তিত হয়।
কঠিন চীবর দান প্রণালীঃ
“পঞ্চানিসংস সহিতং পঞ্চদোস বিবজ্জিতং, হন্তি বজ্জং হি সঙ্ঘস্স তস্মা কঠিনমত্তমং” ভিক্খুসঙ্ঘের পঞ্চফল যুক্ত ও পঞ্চ দোষ বিবজ্জিত অর্থাৎ সঙ্ঘের দোষ হননকারী বলে কঠিন চীবর দান অতি উত্তম এবং শ্রেষ্ঠ দানময় পূণ্যকর্ম। আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরদিন থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস বর্ষাব্রত পালনের পর মহান প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বর্ষাব্রত বা বর্ষাবাস। বর্ষাবাস সমাপনান্তে প্রবারণা করার পর বর্ষাবাস সমাপক প্রত্যেক বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ তথা বৌদ্ধ ভিক্খুসঙ্ঘের প্রতি সংশ্লিষ্ট বিহারের দায়ক-দায়িকারা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে ও পাঁচটি আপত্তি (অপরাধ) যথা- ১) না বলে গমণ করা অর্থাৎ, পূর্বাহ্নের জন্য নিমন্ত্রিত ভিক্খু নিমন্ত্রণকর্তার গৃহ হতে সঙ্গী ভিক্খুকে জিজ্ঞাসা না করে অন্য গৃহে গমণ করা ২) ত্রিচীবরের সবকটি চীবর ব্যতীত বিচরণ করা ৩) গণভোজনে অংশগ্রহণ করা ৪) যথারুচি চীবর পরিভোগ করা তথা প্রয়োজন অনুসারে অধিক চীবর নিজের আয়ত্বে রাখা ৫) দায়কগণের দান করা চীবর বিহারবাসী ভিক্খুসংঘ ব্যতীত আগত অন্যান্য ভিক্খুদের সাথে বণ্টন না করে অধীনে রাখা ইত্যাদি হতে দোষ মুক্ত করে পুণ্যের অংশীদার হওয়ার জন্য কঠিন চীবর দান করা হয়। আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমার পর দিবস প্রতিপদের সূর্য্য উদয় হতে কার্ত্তিকী পূর্ণিমা অবসানের সূর্য্যোদয়ের পূর্বক্ষণ পর্য্যন্ত এই পূর্ণ এক মাসই হল কঠিন চীবর দানের একমাত্র উপযুক্ত সময়। আর এ সময়ের মধ্যে একটি বিহারে মাত্র একবার এ মহা পুণ্যময় দানশ্রেষ্ঠ কঠিন চীবর দান করা যায়। উল্লেখ্য যে, যে বিহারে এক বা একাধিক ভিক্খুসঙ্ঘ বর্ষাবাস সমাপন করেন না, সে বিহারে কঠিন চীবর দান করা যায় না। ত্রিচীবর (সংঘাটি, উত্তরাসঙ্গ, অন্তর্বাস) অথবা ত্রিচীবরের মধ্যে যেকোনো একটি চীবর দিয়ে কঠিন চীবর দান করা যায়। নিম্নোক্ত কঠিন চীবর দান বিবিধ প্রণালী জ্ঞাতব্য।
প্রথম প্রণালী- যেই দিন কঠিন চীবর দান করা হবে, সেই দিনের সূর্য্যোদয় হতে পরদিন সূর্য্যোদয়ের পূর্বক্ষণ পর্য্যন্ত এই ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা কেটে, সুতা বানিয়ে, কাপড় বুনা, সেলাই করা ইত্যাদি চীবর প্রস্তুতের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করে কাঁঠাল গাছের রং দ্বারা উপযুক্তভাবে রঞ্জিত করে দানকার্য্য সম্পাদন করতে হয়। এই প্রণালীতে দান করলে ত্রিদ্বারে (কায়িক, বাচনিক, মানসিক) অধিকতর পূণ্যসম্পদ লাভ হয়।
দ্বিতীয় প্রণালী- প্রমাণমত শ্বেতবস্ত্রে চীবর সেলাই ও রং করে দানকার্য্য সম্পাদন করতে হয়। এরূপ দানে কায়িক পরিশ্রম প্রথমোক্ত চীবর প্রস্তুতের চেয়ে সল্প পরিশ্রম হয় বিধায় কায়িক পূণ্য কম হয়।
তৃতীয় প্রণালী- আগের সেলাই ও রং করা চীবর দ্বারা কঠিন চীবর দানকার্য্য সম্পাদন করা। এরূপ কঠিন চীবর দানে চীবর প্রস্তুত জনিত কায়িক পরিশ্রম হয় না বিধায় দাতা কায়িক পূণ্য লাভ হতে বঞ্চিত হয়।
চতুর্থ প্রণালী- সেলাই ও রং না করে শ্বেতবস্ত্র কঠিন চীবরের উদ্দেশ্যে দান করা যায়। তবে সেই শ্বেতবস্ত্র চীবরে পরিণত করে পরদিন সূর্য্যোদয়ের পূর্বেই কঠিন চীবর করে নিতে হয়। এরূপ দানে কায়িক, বাচনিক, মানসিক এ ত্রিদ্বারে অতিরিক্ত পূণ্যসম্পদ সঞ্চিত হয় না। উক্ত চতুর্বিধ প্রণালীতে কঠিন চীবর দানের ইহাই বিশেষত্ব। তবে কঠিন চীবর দানের যে মহাফল তা এক সমানই হয়।
কঠিন চীবর দানের ফল বর্ণনাঃ
ভগবান বুদ্ধ একসময় পঞ্চশত ষড়াভিজ্ঞ অরহত ভিক্খুসংঘ সহ আকাশ-পথে হিমালয়ের ‘অনোবতপ্ত’ নামক মহাসরোবরে উপস্থিত হলেন। অনু্ত্তর ধর্মরাজ তথাগত বুদ্ধ সহস্রদল-পদ্মে উপবেশন করলেন এবং পঞ্চশত ভিক্খুসংঘ তারাগণের ন্যায় বুদ্ধকে পরিবেষ্টন করে শতদল-পদ্মে উপবেশন করলেন। এরূপে অরহত শিষ্য পরিবৃত তথাগত বুদ্ধ সূর্য্যের ন্যায় বিরোচিত হয়ে অরহতসংঘকে সম্বোধন করে বললেন- “হে ভিক্খুসংঘ, তোমরা কঠিন চীবর দানের মাহাত্ম্য শ্রবণ কর”। সে শুভক্ষণে বুদ্ধ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে অরহত নাগিত স্থবির কঠিন চীবর দানের মহাপুণ্যফল বর্ণনা পূর্বক স্বীয় কর্মফল প্রকাশ করলেন। অরহত নাগিত স্থবিরের প্রকাশ অনুসারে- আমি উত্তম গুণ-শ্রেষ্ঠ সংঘ ক্ষেত্রে কঠিন চীবর দানের ফলে এইকল্প হতে বিগত ত্রিশ কল্প পর্য্যন্ত দুর্গতি অনুভব করিনি, আঠার কল্প দেবলোকে দিব্যসুখ পরিভোগ ও চৌত্রিশবার দেবেন্দ্র হয়ে দেবকুলে রাজত্ব করেছি, সুরম্য দেবলোক ত্যাগ করে মানবকুলে উৎপন্ন হলেও মনুষ্যদের মধ্যে উত্তম-ধনাঢ্য বংশে, ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম পরিগ্রহ করেছিলাম। কখনও ভোগ-সম্পত্তির ঊনতা হয়নি, চক্রবর্ত্তী সুখও লাভ করেছি, দেব ও মনুষ্য এ দু’ভাবেই শুধুমাত্র জন্মগ্রহণ করেছি এবং সর্বদা সকলের প্রিয়ভাজন হয়েছি।
এভাবে স্বীয় কর্মফল বর্ণনা করতঃ তিনি আরও প্রকাশ করেন যে, ছোট বড় যত প্রকারের দান আছে, একখানা কঠিন চীবর দানের ফলের তুলনায় ঐ দান ষোল ভাগের এক ভাগ তুল্যও নয়। চুরাশী হাজার বিহার নির্মাণ করে দান করলে একটি ধাতুমন্দির দান পুণ্যের ষোল ভাগের এক ভাগ তুল্য নয় অনুরূপ অকনিষ্ট ব্রম্মলোক প্রমাণ উচ্চ সুবর্ণ নির্মিত ধাতুমন্দির নির্মাণ করে দান করলেও একখানা কঠিন চীবর দান পুণ্যের ষোল ভাগের এক ভাগ পুণ্য হয় না।
অরহত নাগিত স্থবিরের বর্ণনা সমাপ্ত হলে ভগবান বুদ্ধ নিজের অতীত জন্মের কথা বর্ণনা পূর্বক সিখী সম্যকসম্বুদ্ধকে কঠিন চীবর দান করতঃ যে মহা পুণ্যফল লাভ করেছিলেন তা ভাষণ করলেন- আমি চুরাশীবার মহাযশস্বী চক্রবর্ত্তী রাজা হয়েছি। তখন আমার প্রদেশ রাজ্য কত ছিল, তা সংখ্যাতীত। দেব-মনুষ্যলোকে সর্বদা সকলের প্রিয়ভাজন হয়েছি। আমি ইচ্ছা করলে সসাগরা পৃথিবী বস্ত্রে আচ্ছাদন করতে পারতাম। ইহাও কঠিন চীবর দানের ফল। লক্ষ কল্পাধিক কোন প্রকার দুর্গতি অনুভব করিনি। এভাবে বুদ্ধ স্বীয় কঠিন চীবর দানের ফল বর্ণনা করতঃ আরও প্রকাশ করেন যে, কঠিন চীবর দানের ফল অসংখ্য ও অপ্রেময়। সর্বদোষ অপনয়ন করে পবিত্রতা আনায়ন করে এবং সমস্থ দোষ হনন করে বলেই কঠিন চীবর উত্তম। এ কঠিন চীবর দানের ফল পৃথিবী কম্পিত হলেও কম্পিত হয়না, বায়ুর দ্বারা সুমেরু পর্বত চালিত হলেও চালিত হয়না, সুকঠিন বজ্র যেমন কিছুতেই ভগ্ন হয়না তদ্রুপ এ কঠিন চীবর দানের ফলও কিছুতেই ধ্বংস হয়না। বুদ্ধ, পচ্চেক বুদ্ধ ও তৎ শ্রাবকদিগকে দানাগ্র কঠিন চীবর দান করলে তা অতি শ্রেষ্ঠ ও উত্তম ফলদায়ক বলে সম্বুদ্ধ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে।
পরিশিষ্টঃ
শুধুমাত্র মহাকারুণিক গৌতম সম্যকসম্বুদ্ধ ও অরহত নাগিত স্থবির নয়, মহামুনি সিখী সম্যকসম্বুদ্ধ কর্তৃকও কঠিন চীবর দান ফল বর্ণনা করা হয়েছে। উক্ত বর্ণনা সমূহে এ পৃথিবীতে সর্বপ্রকার দান হতে সংঘকে প্রদত্ত কঠিন চীবর দানই শ্রেষ্ঠ বলে ভাষিত হয়েছে। শত বছর ধরে মহাপুণ্যপ্রদ অষ্টপরিষ্কার দান করলেও তার ফল কঠিন চীবর দানের ষোল ভাগের এক ভাগেরও সমান হয় না। যেই নরনারীগণ কঠিন চীবর দান দেয়, তারা সংসারে সংসরণ বা জন্ম গ্রহণ করার সময় কখনো স্ত্রীত্ব প্রাপ্ত হয়না। মনুষ্যলোকের মনুষ্যসম্পদ, দেবলোকের দেব সম্পদ এবং অন্তিমে পরম শান্তি নির্বাণ সুখ কঠিন চীবর দানে লাভ করা যায়। তাই প্রত্যেক বৌদ্ধ নরনারীগণ জীবনে অন্তত একবার হলেও এ কঠিন চীবর দানের মহাফল জ্ঞাত হয়ে এবং সে মহাফল আকাঙ্খায় সর্বসম্পত্তি সাধক সেই উত্তম কঠিন চীবর বিবিধ দানীয় বস্তুসহ দান করা একান্তই অপরিহার্য্য কর্তব্য। কঠিন চীবর দান দিবসে দায়কগণ কঠিন চীবর উপলক্ষে যা কিছু দান করুক না কেন, তা সমস্তই কঠিন চীবরে অন্তর্গত। তাতেও কঠিন চীবর দানের সমান পুণ্যসম্পদ লাভ হয়।