সুনীল বড়ুয়া: ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে যখন রামুর বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে হামলা হচ্ছিল তখন সেই উত্তম বড়ুয়ার ছেলে আদিত্যে ছিলো সাড়ে তিন বছরের শিশু। তখন বাবা-মায়ের কোলে চড়ে আদিত্য ঘুরে বেড়ালেও এখন প্রতিদিন হেঁটেই স্কুলে যায় সে। বয়সও হয়েছে প্রায় সাড়ে আট বছর।
আদিত্য এখন রামু খিজারী বামির্জ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। শুধু পড়েই না,ক্লাস ওয়ান থেকে আজ অবধি ক্লাসে প্রথম ছাড়া কোনোবার দ্বিতীয় হয়নি সে। বয়সের সঙ্গে শারীরিক অবয়ব যেমন বাড়ছে, এখন মেধায়-মননেও বড় হচ্ছে আদিত্য। যে কারণে আদিত্য এখন অনেক কিছুই বোঝে। অনুভব করতে পারে বাবা-মাকে। বাবার দীর্ঘ শূণ্যতাও এখন আদিত্য অনুভব করতে শিখেছে। তাই বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাবাকে দীর্ঘ সময় কাছে না পাওয়ার যন্ত্রানার ভাবনাও আদিত্যের মনে বাসা বেধেঁছে।
যার ফেসবুক ওয়ালে ছবি ট্যাগ করাকে কেন্দ্র করে রামু ট্রাজেডির মতো ঘটনা ঘটেছিলো,সেই উত্তম বড়ুয়ার ছেলে অদিত্য। কিন্তু উত্তম কি বেচেঁ আছে নাকি মারা গেছে পরিবারের কেউই জানেনা এ খবর। জানেনা বাবার আদর-স্নেহ বঞ্চিত সেই আদিত্যও। তাই বাবার দীর্ঘ অনুপস্থিতি আদিত্য যেভাবে অনুভব করছে,সেই অনুভব থেকেই হয়তো প্রিয় বাবার জন্য সন্তানের এই খোলা চিঠি। এই চিঠির অংশ বিশেষ হুবহু তুলে ধরা হল।
‘প্রিয় বাবা,জানিনা কেমন আছো ? কোথায় আছো ? আদৌ কি বেঁচে আছো। তবুও যেখানেই থাকো তোমার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি খানা লিখলাম। যদি কোনদিন পেয়ে থাকো পড়ে নিও। ’…..
‘আজ ২৯ সেপ্টেম্বর। প্রতি বছর এই দিনটি ফিরে আসে কিন্তু তুমি আমার জীবনে ফিরে আসনা। মায়ের কাছে শুনেছি ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এক বিভিষিকাময় কাল রাতে তুমি কোথাই যেন হারিয়ে গিয়েছ,আজ অবধি ফিরে আসনি। বাবা, আজ কতোদিন তোমাকে দেখিনা, তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু চাইলেও কোথাই পাই,কত দিন-রাত তোমার আসার পানে চেয়ে থাকি। হঠাৎ করে কোন একদিন এসে আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে। তোমার জন্য আমার খুব বেশি কষ্ট হয়।’
‘বাবা জানো? রামু খিজারী বার্মিজ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রতি বছর আমি ক্লাসে ফার্ষ্ট হই, কিন্তু তোমাকে রেজাল্ট দেখাতে পারিনা। শুনেছি তুমিও নাকি ঐ স্কুলে পড়ালেখা করেছো। সবার বাবারা যখন রেজাল্ট শুনে খুশি হয়ে,কোলে তুলে খুশিতে আত্মহারা হয়ে, কি কি কিনে দেয়,তখন আমি শুধু দেখে দেখেই অশ্রু বিসর্জন দিই। আমাকে কে কোলে তোলে (তুলে) আদর করবে,কিইবা কিনে দেবে ? আমার মা যতটুকু দেয়,তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কখনো খেয়ে স্কুলে যেতে হয়,কখনো না খেয়ে যেতে হয়। আবার কখনো কখনো উপোস থাকতে হয়। কেনই বা থাকতে হবে। আজ তুমি থাকলে আমাদের এতো অভাব অনটন থাকত না। আমার কোন প্রিয় খাবার অথবা কিছু লাগলে যখন চাইতাম তুমি এনে দিতে । আর এখন চাইলেও কোথাই পারো ?’
চিঠিতে আদিত্য আরো লিখেছে,‘জানো বাবা ? মায়ের খুব অসুখ। কখনো কখনো একা নিরবে কাঁদে। আমার এবং মায়ের কোন অসুখ হলে ভালো করে চিকিৎসা করাতে পারিনা। কেউ ভাল মতে দেখতেও আসেনা। আগে আমাদের বাড়িতে কত আত্মীয় স্বজন,তোমার বন্ধু-বান্ধব আসত, আর এখন আসা তো দূরের কথা একটু ভালো করে খোঁজ খবর পর্যন্ত নেয়না। আমরা একটা ছোট্ট ভাড়া বাসা নিয়ে কোন মতে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। আমার স্কুল ড্রেস,ব্যাগ পুরনো হয়ে গেলে,বই খাতা প্রয়োজন হলে (নিতে) খুব কষ্ট হয়। কখন যে আবার নতুন করে পাব সেই আশাতেই আমার দিন যায়। মাঝে মধ্যে সন্ধ্যে অথবা রাতে দরজায় দাড়িয়ে থাকি,তুমি যখন ছিলে তখনও নাকি আমি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তখন (নাকি)তুমি অনেক কিছু নিয়ে আসতে। আর এখন কেউ আসেনা।’
জানিনা বাবা, তুমি কখনো আর ফিরে আসবে কিনা। তবে তোমার ফিরে আসার পথ চেয়ে থাকবো। যদি কখনো এই চিঠিটা পড়ে থাকো তাহলে এটা ০১৮৪৯৬৭১৭৩৬ আমাদের নাম্বার। কল দিও। বাবা,আরো অনেক অনেক কিছু লেখার থাকলেও লিখতে পারছিনা,হয়ত পরের বার লিখবো। আমাকে আশির্বাদ করো। ভালো করে পড়ালেখা শিখে যাতে মানুষের মতো মানুষ হতে পারি। একদিন তোমাকে (খুজে) খোঁজে আনতে পারি। আমার মায়ের আদর ভালোবাসা নিও।
ইতি,তোমার প্রিয় ছেলে। আদিত্য বড়ুয়া,পিতা-উত্তম বড়ুয়া,মাতা-রিতা বড়ুয়া,গ্রাম-হাইটুপি,থানা-রামু ,ডাকঘর-রামু,জেলা -কক্সবাজার। তারিখ- ২৯.০৯.২০১৭ ইং
পাঠক, যেখানে বেঁচে-থাকা না থাকা নিয়ে সংশয়,সেখানে হারিয়ে যাওয়া বাবার কাছে প্রিয় সন্তানের এই খোলা চিঠি! হয়তো ছোট্ট শিশুটির অনুভবে যা,ভাবনায় যা, তাই লিখেছে সে। আমরাও চাই,আদিত্যের খোলা চিঠি ওর বাবা পড়ুক। হঠাৎ একদিন যেন হারিয়ে যাওয়া সেই বাবা এসে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নিক। ওর ভাবনা,ওর স্বপ্ন যেন সত্যিই সত্যি হউক।
সুত্র: আমাদের রামু ডট কম