ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী: আজ সেই ভয়াল ২৯ সেপ্টেম্বর। ২০১২ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে সাম্প্রদায়িক উগ্রপন্থি তথা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ঝলসে দিয়েছিলো কক্সবাজারের রামু, উখিয়া বৌদ্ধ পল্লী। পুড়ে ছাই হয় হাজার বছরের পুরনো, বৌদ্ধ বিহার, ঐতিহ্য, বৌদ্ধ পাণ্ডুলিপি। লুট হয় প্রাচীন ও দুর্লভ অনেক বুদ্ধ মূর্তি। এভাবে এক এক করে প্রায় ১২ টি ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ বিহার ও অর্ধ শতাধিক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ভাংচুর করা হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘর। বিভীষিখাময় সেই রাতে আগুনের লেলিহান শিখা থেকে প্রাণে বাঁচতে দিগবেদিক ছুঁটাছুটি করেছিল অসহায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হাজারো শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, নারী-পুরুষ।
পরদিবস ৩০ সেপ্টেম্বর, দিনের আলোয় চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার লাখেরা, কোলাগাঁও গ্রামে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এ দু’দিনের সাম্প্রাদায়িক হামলায় ভেঙ্গে যায় শত শত বছরের সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য। প্রিয় আরাধনার স্থান ভেঙ্গে ধংসস্তুপে পরিণত হয়।
ঘটনার সূত্রপাত হয়, উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুক প্রোফাইলে অন্যের ট্যাগ করা একটি পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননাকর ছবির অভিযোগ হতে। প্রকৃতপক্ষে ছবিটি নিছক ইস্যুমাত্র। কেননা, ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা যেকোন কেউ চাইলে একে অন্যকে ছবি ট্যাগ করতে পারে!
ভাবতেই অবাক লাগে, এদেশে আমরা যারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তাদের ধর্ম, জীবন, সম্পদ, বিশ্বাস ইত্যাদি কী এতই ঠুনকো যে, নিছক একটি ছবি ট্যাগকে কেন্দ্র করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, ধর্মীয় উপাসনালয়, বসতবাড়ি; লুটপাট করা হয় অর্জিত সকল সম্পদ! সে রাতে প্রশাসনও ছিল নির্বিকার। বারবার তাদের সাথে যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এভাবে ধ্বংস হয়ে যায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অতি মূল্যবান বুদ্ধের পবিত্র ধাতু, তাল পাতায় লিখা হাজার বছরের প্রাচীন পবিত্র ত্রিপিটক গ্রন্থ, ধ্বংস হয়ে যায় শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বিহার, বুদ্ধমূর্তি, ঐতিহাসিক তথ্যচিত্র ইত্যদি।
সে কালো রাতের বিভীষিকার দৃশ্য দেখে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ, পণ্ডিত প্রবর শ্রীমৎ সত্যপ্রিয় মহাথেরো আক্ষেপ করে বলেন- “Even in 1971, I did not see this grotesque brutality on us, Muslim men and women had taken refuge in my monastery in 1971 to escape the wrath of the Pakistani Army,” “… I have saved so many Muslim souls from the brutal persecution of the Pakistanis. Today I feel defeated. My civilization is lost. My lifetime of worshipping has gone in vain. I am a lost man ans lost I will be,… Please save my future generation! Please!” (ডেইলি স্টার, ২.১০.২০১২) [‘১৯৭১ সালেও আমাদের ওপর এ ধরনের হয়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রোশ থেকে বাঁচানোর জন্য আমি বহু মুসলমান নর-নারীকে আশ্রয় দিয়েছি আমার বিহারে। বহু মুসলিম জীবনকে আমি রক্ষা করেছি। আজ আমি পরাজিত। আমার সভ্যতা হারিয়ে গেছে। ব্যর্থ হয়ে গেছে আমার আজীবনের সাধনা-উপাসনা। আমি হেরে গেছি, হারিয়ে গেছি। দয়া করে আমার ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচান। দয়া করুন…। ’] এবার চিন্তা করুন, সেদিনের ধ্বংসযজ্ঞ কী রকম ভয়ানক ছিল। এখনো পর্যন্ত সে বিভৎস কালো রাতের কথা মনে করে আঁতকে উঠেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়।
ঘটনার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ। কিন্তু এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে মূল হোতাদের অনেকেই! তাই এখনো শংকা কাটছে না বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তবে কিছুটা স্বস্তির কারণ হল, সরকার ক্ষতিগ্রস্থ ও পুড়ে যাওয়া বৌদ্ধ বিহার এবং বসতবাড়ি আধুনিক নকশা ও শৈলীতে দৃষ্টি নন্দন করে সংস্কার আর পুনঃ নির্মাণ করে দিয়েছেন। কিন্তু সেই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য, সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতি কী আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে? জানি এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই, তবুও স্মৃতির অতলে হাতরে বেড়ায় এবং স্বপ্ন দেখি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সোনার বাংলাদেশের।
কখনো চাইব না মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সহ সকল ধর্মের মানুষের ঐক্যের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এ স্বাধীন বাংলাদেশ আফগানিস্তান, পাকিস্থানের মত রাষ্ট্র হয়ে উঠকু! কখনো চাইব না এ দেশ হয়ে উঠুক বিশেষ কোন এক ধর্ম সম্প্রদায়ের। এদেশ সকল ধর্মাবলম্বী ও জনগোষ্ঠীর। তাই, সাম্প্রদায়িক শক্তির অপচষ্টাকে রুখে দিয়ে আমাদেরকে সম্প্রীতি-সহাবস্থান সমুন্নত করতে হবে। এতে দেশের সকল নাগরিক, সম্প্রদায়, সর্বোপরি সরকার ও প্রশাসনকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
পরিশেষে, বলব ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রীষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি।’ – এই আমাদের পরিচয়। আমরা এ পরিচয়ে বাঁচতে চাই। তাই প্রার্থনা – ধ্বনিত হোক সর্বজনে মৈত্রী-প্রশান্তির জয়গাথা এবং সম্প্রীতির মেলবন্ধনে আমরা হই একাত্মা। জাগ্রত হোক মনুষ্যত্ব, দূর হোক সাম্প্রদায়িকতার কালো ছোঁয়া।