সুলেখা বড়ুয়া:
তথাগত ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধ পরম শান্তি পদ নির্ব্বাণ গমনের, চরম মুক্তি লাভের যে ঋজুপথ আবিস্কার করেছেন তাহা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে অভিহিত । এই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের সম্যক বাক্য নিয়ে আমার এহেন প্রয়াস । সম্যক বাক্য – বাক্য প্রধানত চার প্রকার,
অকুশল কুশল : ১/ মিথ্যা বাক্য ১/ সত্য বাক্য ২/ পিশুন বাক্য ২/ মিলন বাক্য ৩/ পরুষ বাক্য ৩/ মধুর বাক্য ৪/ সম্প্রলাপ বাক্য ৪/ অর্থপূর্ণ বাক্য
১/ মিথ্যা বাক্য – মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যাকে সত্য বলিয়া প্রকাশ করা । ২/ পিশুন বাক্য – দুইজন বন্ধুর মধ্যে পরস্পর ভেদমূলক কথা বলা। ৩/ পরুষ বাক্য – অপর জ্ঞাতকে ভেদ করিয়া কথা বলা। যেমন – জ্ঞাতি, কুল, সংস্থিতি অর্থাৎ কানা ও বোবার বংশে প্রভৃতি, তুচ্চ কথা ও হীন কর্ম্মাদি বলে কর্ম নিন্দা, এরুপ কর্কশ কথা বলা । ৪/সম্প্রলাপ বাক্য – চিন্তা পূর্বক লিখিত রাম জাতক ও ভারত জাতক এরুপ জাতক এবং উপন্যাস নাটক ও প্রহসনাদি গল্প কথা দ্বারা সম্যক জ্ঞান লাভ হয় না, সেই রুপ অজ্ঞানতা বিষয়ক কথা বলা ।
কুশল বাক্যের মধ্যে সত্য বাক্য, মিলন বাক্য, মধুর বাক্য এবং অর্থপূর্ণ বাক্য সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত । এই সম্যক বাক্য লঙ্ঘন করিলে বাক্যজনিত পাপ হয়, এই বাক্যজনিত পাপের ফল কেমন হতে পারে তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি ।
২০০৩ সালে মুৎসুদ্দী পাড়া “প্রজ্ঞাতিষ্য ভাবনা কেন্দ্রে” ১০ দিনের কোর্সে বিদর্শন ভাবনা চলাকালীন অষ্টম দিনে বিদশনাচার্য্য বাক্যজনিত পাপের ফল কি হতে পারে, সে বিষয়ে দেশনা করেছিলেন, সেই দেশনাটি আমার মনে খুব দাগ কেটেছিল, তাই সবার উদ্দেশ্যে আমার সীমিত জ্ঞানে যেটুকু ধারণ করতে পেরেছি তা পুনরাবৃত্তি করছি মাত্র ।
তথাগত বুদ্ধ পরিনির্বাণের সম্ভবত পাঁচশত বছর পরে সে সময়ে এক শ্রেষ্ঠী ভিক্ষু সংঘকে ফাং করেছিল পিন্ডদান এবং প্রাণভরে ধর্মীয় দেশনা শুনবে বলে, শ্রেষ্ঠী গৃহে যথাসময়ে সমস্ত আয়োজন সুচারুরূপে সম্পন্ন করে রেখেছেন, কিন্তু পুজনীয় ভিক্ষুগণ আসছেন না কেন, সেজন্য চিন্তা হচ্ছে বেশ শ্রেষ্ঠীর । টেনশনে শ্রেষ্ঠী পায়চারী শুরু করে দিলেন, পায়চারী করতে করতে এক সময় মুখ ফসকে বের হয়ে গেল একটি বাক্য… “ভন্তে শুধু খাওয়ার জন্য আসবে দেশনা করবে না মনে হয় ।”
এর কিছুক্ষণ পর ভন্তেরা এসে দাঁড়াল শ্রেষ্ঠীর গৃহের দ্বারে, শ্রেষ্ঠী ভন্তেদেরকে দেখে খুব খুশি হয়ে পা ধৌত করতে যাচ্ছে ভন্তেকে, এমন সময় পুজনীয় ভন্তে বললেন, শ্রেষ্ঠী এ জল দিয়ে আমি পা ধৌত করব না । তা হলে কেমন জল দিয়ে পা ধৌত করবেন ভন্তে ? শ্রেষ্ঠী তোমাদের সামনের পুকুরের ঠিক মধ্যখানে ডুব দিয়ে একদম নীচে পাঁচ পুকুর আছে যেখানে, সেখান থেকে জল নিয়ে আসলে, সেই জল দিয়ে আমি পা ধৌত করব । পাঁচ পুকুরের একটু বর্ণনা দিই – কৈশোরে আমার একবার দেখার সুযোগ হয়েছিল, যখন আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনের পুকুর সংস্কার করার সময়কালে, পুকুরের একদম তলদেশে একটি আয়তক্ষেত্র বিশিষ্ট, ওটাই নাকি পাঁচ পুকুর, এর নীচের মাটিগুলো নাকি খুবই শক্ত ।
শ্রেষ্ঠী আর কালবিলম্ব না করে পাত্র নিয়ে পুকুরে ডুব দিল এবং জল নিয়ে এসে ভিক্ষুর পা ধৌত করে দিলেন, তারপর ভিক্ষুগণ পিন্ডদান শেষে ভোজনপর্ব শেষ করলেন, অতঃপর ভিক্ষু দেশনা শুরু করলেন, দেশনার শুরুতে ভন্তে বলল, ভিক্ষুর আশ্রমের একটা ছেলে খুবই অসুস্থ ছিল বিধায় আসতে একটু বিলম্ব হলো । দেশনা শেষে ভিক্ষু শ্রেষ্ঠীকে জিজ্ঞেস করল, পাঁচ পুকুরের জল আনতে গিয়ে সেখানে কি কিছু দেখেছিলেন, শ্রেষ্ঠী বলল হ্যাঁ ভন্তে, আমি দেখেছি মনোরমভাবে সুসজ্জিত একখানা রথ, কিন্তু রথের একখানা খুঁটি ভেঙ্গে পড়ে আছে, যার কারণে সুসজ্জিত রথটি বাঁকা হয়ে আছে, কারণটা কিছুই বুঝলাম না, অনুগ্রহ করে এর কারণটা একটু ব্যাখ্যা করবেন ভন্তে ?
ভন্তে আসার আগে শ্রেষ্ঠী কি কিছু বলেছিলেন ? শ্রেষ্ঠী সলজ্জে বললেন, হ্যাঁ ভন্তে ঐ বাক্যজনিত অকুশল কর্মের প্রভাবে সুসজ্জিত রথের একটি খুঁটি ভেঙ্গে গিয়েছিল । তবে শ্রেষ্ঠীর কষ্টে আনা জল দিয়ে ভন্তের পা ধৌত করার কারণে রথের খুঁটি আবার আগের মত হয়ে গেছে ।
তারপর ভন্তে বললেন, এই রথটি আপনার জন্য তৈরি হয়ে আছে শ্রেষ্ঠী, আপনি যখন এই ধরাধাম থেকে চিরবিদায় নেবেন, ঠিক তখন ঐ সু-সজ্জিত মনোরম রথে করে চর্তুমহারাজিক স্বর্গে গমন করবেন, অকুশল এবং কুশল কর্মের বিপাক কায়ের দ্বারা, বাক্যের দ্বারা, মনের দ্বারা সৃষ্টি হয় ও জমা হয় । পানির দ্বারা তৈরি ময়লা গায়ে লাগলে যেমন পানি দ্বারা ধৌত করতে হয়, তেমনি কায়ের দ্বারা কর্মের প্রভাব জমাকৃত বিপাক কায়ের দ্বারাই আলম্বনের মাধ্যমে শরীর থেকে নিরোধ করতে হয়।
এখানে ভন্তে প্রজ্ঞাবান এবং শ্রেষ্ঠী পুণ্যবান সত্তা, তাই ভন্তে শ্রেষ্ঠীর প্রতি করুণা বশতঃ শ্রেষ্ঠীকে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দিয়েছিল । তাহলে অনুধাবন করুন, বাক্যজনিত পাপে আমাদের কেমন ক্ষতি হতে পারে, প্রতিনিয়ত অকুশল কর্মের প্রভাবে কত কর্মবিপাক করে চলছি আমরা ।
মহামানব বুদ্ধের ভাষায় সম্যক বাক্য দ্বারা বিদর্শন ভাবনা পরিচালনায় নির্বাণ লাভ সম্ভব হয়, নতুবা নয় । বুদ্ধের সেই নির্বাণের ক্ষেত্র সম্যক বাক্য ছাড়া আচরণ পঙ্গু । সম্যক বাক্য ব্যবহার ব্যতিক্রম হলে নির্বাণ সুদূর পরাহত, সম্যক বাক্যই নির্বাণ প্রাপ্তির একমাত্র প্রধান ও প্রথম ক্ষেত্রের আচরণ ।
দুর্লভ এ মানব জীবনে সবাই আচরণে শুদ্ধতা লাভ করুক। চক্রবালবাসী সুখী হউক ।