অশোক বড়ুয়া
সমন্বয়ক, বাংলাদেশের সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ
যে কারণে বাংলাদেশের সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ এ বছর ফানুস না ওড়ানোর জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি দেশে- বিদেশে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। তবুও এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কিছু ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, যা মোটেই কাম্য নয়।
বাংলাদেশের সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ ফানুস ওড়ানোর পরমাত্মিক ও পার্থিব দুটো দিকই গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছে। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা দেশের মহান ভিক্ষুসংঘের নেতৃত্বদানকারী দু’ নিকায়ের সংগঠন- বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা এবং বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভা এঁর সঙ্গে পূর্বে আলাপ আলোচনা করেছে। উভয় নিকায় সংঘের অনুজ্ঞা নিয়েই এ ঘোষণা প্রকাশ করেছে। কেবল সংঘ নয়, সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ দেশের নেতৃত্বদানকারী বৌদ্ধ সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, সমাজের প্রাজ্ঞ, প্রবীণ ও আলোকিত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে, এমনকি নবীন নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও আলোচনায় ঐক্যমত্য হয়ে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।
এ সিদ্ধান্ত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানবগোষ্ঠীর অনুভূতিকে ধারণ করে, দেশের বৌদ্ধ নাগরিকদের সার্বিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের কথা ভেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ, ফানুস ওড়ানোকে ঘিরে বৌদ্ধ যুব মানসে যে আনন্দ, আবেগ ও অনুভূতির সৃষ্টি হয় তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে। ফানুস ওড়াতে না পারার কষ্ট যুবাদের সঙ্গে সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজেরও রয়েছে।
তথাপি বুদ্ধের জীবন ও বাণীর শিক্ষায় তাঁরা ত্যাগের মহিমাকে সমুন্নত রাখতে এবার এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যা অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের, বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে। যার কৃতিত্বের দাবীদার সমগ্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়।
যুব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলি,ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতির অবশ্যই মূল্য আছে, তবু আমাদের বৃহত্তর সমাজের নিরাপত্তা ও কল্যাণের দিকটাকে প্রাধান্য দিতে হবে সর্বাগ্রে। বিবেচনা করতে হবে সময় ও পরিস্থিতির কথা। কথায় বলে, সেইফ্টি ফার্স্ট।
পূজনীয় ভিক্ষুসংঘ হলেন সদ্ধর্মের ধারক ও বাহক। তাঁরা হলেন আমাদের প্রকৃত অভিভাবক। সেই মহান সংঘের অনুজ্ঞা নিয়ে মানবতার স্বার্থে ও সম্প্রদায়ের স্বীয় আত্মরক্ষার্থে সংঘ ও প্রবীণ সমাজ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, এর প্রেক্ষাপট নবীনদের নেতৃবৃন্দদের সাক্ষাতে জানানোর পর তারা তা উপলব্ধি করে এ সিদ্ধান্তে সহমত পোষণ করেছে।
তবে হ্যাঁ, সিদ্ধান্ত ঘোষণার পূর্বে প্রান্তিক পর্যায়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো। তবু, সব কিছু খুলে বলা যায় না, সময়ের জরুরী তাগিদে তাদেরকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে।
মনে রাখতে হবে, আমাদের আবেগ যেন বুদ্ধিকে না ছাড়িয়ে যায়। জ্ঞান ও প্রেমের সমন্বয়ে বৌদ্ধ ধর্ম।
সবিনয়ে বলি, বৌদ্ধ সমাজের অস্তিত্ব রক্ষায় আজ যেটি সর্বাগ্রে প্রয়োজন তা হলো- একতা। লক্ষ্য করুন, এই একটি ইস্যুতে আমাদের দু’ নিকায়ের সংঘসমাজ আজ ঐক্যবদ্ধ। সংঘের একতায় সমাজের শ্রীবৃদ্ধি। ভাবাবেগ পরিহার করে বিবেক ও বিচক্ষণতার সঙ্গে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বুঝতে হবে, কী কঠিন চ্যালেঞ্জিং বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা! দেখে বুঝতে হবে, কেন আজ বিহারগুলোতে এমন জোরালো নিরাপত্তা প্রহরা।
বুদ্ধের প্রতি ভক্তি জানানোর জন্যই তো ফানুস ওড়ানো।
ফানুস ওড়ে আগুনের তাপে। সে আগুনের শিখা যেন সমগ্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে না পোড়ায় সেদিকটি গভীরভাবে ভাবতে হবে সবার আগে। বুদ্ধ বলেছেন, ধর্মের স্থায়িত্ব নির্ভর করবে সংঘের স্থায়িত্বের ‘পরে। তাই, সংঘের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিতে হবে ।
সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজের মানবিক দৃষ্টিকোণ ও সম্প্রদায়ের কল্যাণে ফানুস না ওড়ানোর কঠোর সিদ্ধান্তে কারো কারো আবেগ অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে, এর জন্য সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে । সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে, সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ সরকার ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মহলের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে নানান কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে।
আপাতঃ দৃষ্টিতে কোনো কোনো কর্মসূচি/ সিদ্ধান্ত স্রোতের বিপরীতে বলে প্রতীয়মান হলেও, কালক্রমে সেটিই হয়ে ওঠে সমাজের রক্ষা কবচ হয়ে। দৃষ্টান্ত,
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোর এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন এ দেশের মানুষকে নির্বিচারে খুন ও নিপীড়ন করে চলেছে, তখন তিনি বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে রক্ষার্থে ঘোষণা দিলেন- ‘চায়নিজ বুদ্ধিস্ট’। সম্প্রদায়কে রক্ষায় তাঁর এ ফর্মুলা ধন্বন্তরির কাজ দিল। বৌদ্ধরা ‘ চায়নিজ বুদ্ধিস্ট’ বলে রক্ষা পেলো। কেননা, চিন ছিল সে সময়ে পাকিস্তানের দোসর।
চিনের ভূমিকা তখন এদেশের মুক্তিকামী মানুষের বিপক্ষে ছিল বলে, আমরা তরুণরা, মহামান্য সংঘনায়কের ‘ চায়নিজ বুদ্ধিস্ট’ ফর্মুলাকে ভেবেছিলাম চায়নাকে সমর্থন দেয়া। তাই তাঁর ওপর আমাদের তখন ক্ষোভের সীমা- পরিসীমা ছিল না। কিন্তু পূজনীয় বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোর দূরদর্শী কৌশলী সে ভূমিকা বৌদ্ধদের শুধু রক্ষাই করে নি, চায়নিজ বুদ্ধিস্ট এর আড়ালে বৌদ্ধরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে হানাদের ওপর আক্রমণের সুযোগও করে দিয়েছিল তারা। মহামান্য মহাসংঘনায়ককে ‘ রাজাকার’ নামের কুত্সা ও গ্লানি সইতে হয়েছিল। অথচ বঙ্গবন্ধু বিষয়টি সঠিকভাবে উপলব্ধি করে তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন।