বিবর্তন ডেস্ক: বৌদ্ধ মন্দিরগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হলেও আতঙ্কে রয়েছেন দেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিরা। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের পর থেকে স্বাভাবিক জীবন যাপনও ব্যাহত হচ্ছে বলে দাবি করেছেন তারা। ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল নামা শুরু হলে দেশের বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়।এপিসিসহ মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ।এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান হত্যাযজ্ঞের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিরা।শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বৌদ্ধ মন্দিরগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বছরের অন্যান্য সময় মন্দিরে স্বাভাবিক পুলিশি নিরাপত্তা থাকলেও ২৫ আগস্টের পর থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। মন্দিরগুলোর সামনে পুলিশি পাহারা বাড়ানো হয়েছে। যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় এপিসি ও জলকামানসহ প্রস্তুত রয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। এছাড়া, বাংলাদেশে বসবাসকারী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে কেউ যেন উস্কানি ছড়াতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।
বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে আটটিসহ সারাদেশে তিন হাজার আটশো বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বৌদ্ধ বিহারের অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামে। এছাড়া, দেশের অন্য জেলাতেও বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের বসবাস রয়েছে। জানা যায়, বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোকের সংখ্যা ২৪ থেকে ২৫ লাখ। তারা এদেশের নাগরিক হিসাবে সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশে বসবাস করছেন।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে জনসংখ্যার ০.৭ শতাংশ বৌদ্ধ। এদের ৬৫ শতাংশের বসবাস পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এছাড়া, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে ঢাকা, বরগুনা ও পটুয়াখালীতেও বেশি সংখ্যায় বৌদ্ধদের বসবাস রয়েছে।
বাংলাদেশি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পরপরই মন্দিরগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও তারা আতঙ্কেই রয়েছেন। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে উগ্রবাদীদের হামলা ও ধাওয়ার শিকার হয়েছেন তারা। ফলে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা (যারা বৌদ্ধদের নির্ধারিত পোশাক পরেন) প্রয়োজন ছাড়া মন্দিরের বাইরে যাচ্ছেন না। দিনের বেশিরভাগ সময় তারা মন্দিরের ভেতরে অবস্থান করছেন।
কমলাপুরের ‘ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার’ ঘুরে দেখা গেছে, প্রধান ফটকে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। প্রতি শিফটে একজন এসআই’র নেতৃত্বে দশ জন পুলিশ সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। মন্দিরের নিরাপত্তায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বৌদ্ধরা।
বৌদ্ধ মন্দির এলাকায় নিরাপত্তা থাকলেও বাইরে বের হলে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কেউ কেউ বাজে মন্তব্য ও ধাওয়ার শিকারও হচ্ছেন বলে অভিযোগ তাদের। কমলাপুরের ‘ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার’ এ কথা হয় বৌদ্ধ শ্রমণ দীপ্ত বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহে আমি এক ভক্তের বাসায় যাচ্ছিলাম। কদমতলী ৯ নম্বর লেনে যাওয়ার পর কয়েকজন যুবক প্রথমে খুব বাজে ভাষায় বকা দেয়। এরপর হামলার উদ্দেশে ধাওয়া করে। তখন আমি ভয়ে পালিয়ে আসি।’ এরপর থেকে খুব জরুরি কাজ ছাড়া মন্দিরের বাইরে যাওয়া হচ্ছে না বলে জানান তিনি। দীপ্ত বড়ুয়া বলেন, ‘মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। আমাদের বাইরে চলাফেরা করতে সমস্যা হচ্ছে।’
একই কথা বলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নোবেল বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা শ্রমণ বা ভিক্ষু নই, তাদের বাইরে চলাফেরা করতে সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু যাদের ভিক্ষু পোশাক পড়তে হয়, তারা সমস্যায় আছেন। তবে আমাদের পরিচয় পাওয়ার পর কেউ কেউ উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করেন।’
রাজধানীর ‘বাড্ডা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহার’ ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে প্রধান ফটকের সংস্কার কাজ বন্ধ রয়েছে। দ্বিতীয় প্রবেশ পথের গলির দুই পাশে রয়েছে পুলিশের ব্যারিকেড। এ পথে কোনও যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া না। শুধুমাত্র পায়ে হেঁটে চলাচলের জন্য রাস্তা খোলা রাখা হয়েছে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রবেশ পথের চারপাশে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। একইসঙ্গে প্রধান গেটের সামনে একটি আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেখানে দায়িত্বরত বাড্ডা থানার এসআই খান মারুফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২২ জন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত আছেন। গত ২৫ আগস্ট রাত থেকেই একানকার এ নিরাপত্তা বাড়ানো হয়।’
বাড্ডা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহারে কথা হয় বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতাদের। তারা জানান, নিজেদের নিরাপত্তা চাওয়ার আগেই সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। প্রতিটি মন্দিরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। যা অত্যন্ত সন্তোষজনক।
বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি ডা. অসীম রঞ্জন বড়ুয়া ও বাংলাদেশ সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজের মুখ্য সমন্বয়ক অশোক বড়ুয়া বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমরা মিয়ানমার দূতাবাসেও প্রতিবাদ পাঠিয়েছি। মানববন্ধন করেছি। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। বৌদ্ধ ধর্ম কেবল মানুষ নয়, কোনও প্রাণী হত্যারও পক্ষে নয়। যারা প্রকৃত বৌদ্ধ, তারা কখনই মানুষ হত্যা করতে পারে না। গৌতম বুদ্ধ আমাদের সেই শিক্ষা দেননি।
তারা বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সন্তান। মিয়ানমারের এই হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশের কোনও বৌদ্ধ সমর্থন করে না। আমরা শান্তিময় পরিবেশের মধ্যে জীবন-যাপন করতে চাই। কোনও সংঘাতে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা চাই, এটি দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আরও ব্যাপকভাবে প্রচার করা হোক। যাতে কোনও উগ্রবাদী গোষ্ঠী ধর্মের নামে বিদ্বেষ ছড়িয়ে শান্তি নষ্ট করতে না পারে। অনেকে মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের দায়ভার ধর্মের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। এটাকে কোনোভাবেই ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে উপস্থাপন করা ঠিক হবে না। মিয়ানমারে যা হচ্ছে, তা জাতিগত সংঘাত। এটা কোনও ধর্মীয় সংঘাত নয়।’
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহা-পরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন বৌদ্ধ ও হিন্দু স্থাপনায় নিরাপত্তা রক্ষার্থে এলাকাভিত্তিক সাম্প্রদায়িক সুরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেকোনও উস্কানিদাতা ও ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। সারাদেশের বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মীয় স্থাপনা ঘিরে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কাজেই বৌদ্ধ ও হিন্দুসহ কোনও ধর্মের লোকজনের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই।’