ইমতিয়াজ মাহমুদ
এখন রোহিঙ্গাদের কথা কি বলবো? ওদের প্রতি মানবিক সহমর্মিতা তো আমাদের আছেই। আমাদের সরকারও ওদেরকে সাহায্য করছে। আমাদের সরকার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক ফোরামে নিয়ে গিয়ে সেখানে মায়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে করে ওরা রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত নেয়, ওদের অধিকার রক্ষা করে, ওদেরকে আইনের সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাবস্থা করে। আর মানবিক সাহায্যের ব্যাপারে তো আমাদের দেশের সকলেই একমত- অনেকটা জাতীয় ঐক্য যেন তৈরি হয়েছে।
কিন্তু আমাদের দেশী বৌদ্ধদের কি দোষ। ওদেরকে কেন মারছেন? এটা কি ধরনের অন্যায়? এটা কি ধরনের প্রতারণা? এটা কি ধরনের ভণ্ডামি? এটা তো পুরা ভণ্ডামি রে ভাই। কেন এটাকে ভণ্ডামি বলছি?
মায়ানমারের কাছে আমরা কি দাবী করছি? আমরা দাবী করছি যে রোহিঙ্গারা হিন্দু কি মুসলিম কি বৌদ্ধ সেটা মুখ্য বিষয় নয়, ওরা প্রায় হাজার বছর ধরে বার্মায় বসবাস করছে, ওরা বার্মার নাগরিক, ওদের বিরুদ্ধে ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য করা অন্যায়। বলছি না আমরা এই কথা? বলছি না যে কেবল ধর্মের কারণে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে ভিন্ন চোখে দেখতে পারে না? বলছি তো। তাঁর মানে আমরা কোন নীতিটা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি? আমরা চাইছি যে একটা জনগোষ্ঠীর সাধারণ ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন করা যাবে না। তাইলে আমরা কেন ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অন্যদেরকে মারবো। এটা ভণ্ডামি না? বার্মাকে বলবো ধর্মের কারণে বৈষম্য করছ- সেটা অন্যায়, আর আমরা নিজেরা ধর্মের কারণে মানুষের উপর অত্যাচার করবো?
একটা ভিডিও পাঠিয়েছেন এক বন্ধু, সেখানে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রাণভয়ে কাতর হয়ে ওকে যা বলতে বলছে তাই বলছে ক্যামেরার সামনে। আশপাশ থেকে গালাগালি আর হুমকির আওয়াজ ভেসে আসছে। এটা নাকি বেনাপোলের ঘটনা। আমার পিচ্চি দোস্ত অংপ্রু (আমি ওকে ডাকি বাবু বলে), ওর কাছে আরও কয়েকজনের কাছে শুনলাম চট্টগ্রামে অক্সিজেন এলাকায় নাকি হুমকি দেওয়া হয়েছে, ১৬ তারিখের মধ্যে সকল বৌদ্ধদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে, তাইলে ওদের খবর আছে। অক্সিজেন এলাকায় অনেক পাহাড়ি আদিবাসী বাস করে- অনেকেই ছাত্র, অনেকে শহরে নানারকম চাকরী বাকরি করে।
কিছুদিন আগে মিরপুরে একটি বৌদ্ধ বিহারে হুমকি দিয়েছে। বৌদ্ধদেরকে মেরে ফেলা হবে, কিয়াং ভেঙে ফেলা হবে ইত্যাদি। মিরপুরে নাকি পুলিশ প্রহরা বসানো হয়েছে বিহারের আশেপাশে। কিন্তু দেশের অন্যত্র? পাহাড় থেকে ছেলেমেয়েদের বার্তা পাই। ওরা ভয় পাচ্ছে। অজানা অচেনা লোকজন আনাগোনা করছে। রাতের অন্ধকারে কারা যান ট্রাক নিয়ে একখান থেকে আরেকখানে যাচ্ছে।
আমি ভয় পাচ্ছি। ভয় পাচ্ছি, তবে কি রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের মানবিক সহানুভূতিকে ব্যাবহার করে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এদেশে সাপ্রদায়িক অশান্তি তৈরি করবে? আপনারা যারা লিবারেল গণতন্ত্রমনস্ক মানুষরা আছেন, আপনারা কিছু বলবেন না? আমরাও কি তবে মায়ানমারের মতোই মানুষ মারতে থাকবো? মানুষই তো। মায়ানমারের ওরা রোহিঙ্গা মারছে, ওরাও মানুষ, আর আমাদের বৌদ্ধরাও মানুষ। মানুষই তো। শেষ বিচারে মৃত্যু তো হয় মানুষেরই।
মেহেরবানি করে সকলে একটু বলেন, মুখ খোলেন। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আমরা সহ্য করবো না। বৌদ্ধ বলেই কাউকে মারতে ধরবেন না, হেনস্তা করবেন না। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে মানুষকে অত্যাচার করা সেটা সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদীদের কাজ।
হিন্দু উগ্রবাদী, মুসলিম উগ্রবাদী এরা সকলেই এক এই ব্যাপারে। আর আছে ধর্মকে যারা রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার বানাতে চায় ওরা। আমাদের এখানে জিয়াউর রহমান যেরকম আমাদের জাতীয় পরিচয়ে আর রাজনীতিতে ধর্মীয় উপাদান ঢুকিয়েছিলেন, একইভাবে মায়ানমারের মিলিটারি শাসকরাও ধর্মীয় উপাদান ঢুকিয়েছে। জিয়াউর রহমান ঢুকিয়েছেন ইসলাম আর বার্মার ওরা ঢুকিয়েছে থেরোবাদি বৌদ্ধ ধর্ম। আপনি যদি আসলেই উদার গণতন্ত্রী হয়ে থাকেন, আসলেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকেন আর আসলেই যদি আধুনিক হয়ে থাকেন তাইলে আপনাকে এদের বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে।
এমনকি আপনি যদি রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রকৃতই সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে থাকেন তাইলেও আপনাকে বৌদ্ধদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমার এই প্রিয়তম স্বদেশে ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের হাতে মানুষ হত্যা সহ্য করবো? আপনি বলেন, করবেন?
(ফেসবুক থেকে নেওয়া)