ড: নীরুকুমার চাকমা
বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা-ধারনা ও বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটেছে অনেক। বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলো অভিজ্ঞতালব্ধ ও প্রমাণ সাপেক্ষ; এবং এ কারণে অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে সত্য বলে অপ্রমাণিত কোন কিছুকেই আধুনিক মানুষ সহজে জানতে বা গ্রহণ করতে নারাজ। শিক্ষিত সমাজের কাছে তাই ধর্মের আবেদন নগণ্য। ধর্মীয় মতবাদকে সাধারনত মনে করা হয় অবৈজ্ঞানিক, অন্ধবিশ্বাসভিত্তিক অযৌক্তিক। অন্যান্য ধর্মের উপর এ অভিযোগ চাপানো গেলেও বুদ্ধ ধর্মের উপর চাপানো কিন্তু যুক্তি-সজ্ঞত বলে মনে হয় না। খ্রিষ্ট জম্মের সেই ষষ্ট শতাব্দিতে উৎপত্তি হলেও বুদ্ধধর্ম আসলে একটি আধুনিক ধর্ম, বৈজ্ঞানিক ধর্ম, যুক্তির ধর্ম। বুদ্ধের সুমহান উপদেশ, বানী ও চিন্তাধারাই বুদ্ধদর্শনের উৎস ও ভিত্তি। অন্য কথায়, বুদ্ধের ধর্মই আসলে বুদ্ধ দর্শন। বুদ্ধ দর্শনের প্রধান বৈশিষ্টই হচ্ছে স্বাধীন চিন্তা। স্বাধীন চিন্তার এ গতিধারা যুগে যুগে বিকশিত হয়েছে বিচিত্র ভঙ্গিমায়। ধর্মের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস এ দর্শনকে কলুষিত করতে পারেনি কোনদিন। অতিজাগতিক বা অতীন্দ্রিয় ব্রহ্ম বা ইশ্বরের অন্ধবিশ্বাস এ দর্শনে থাঁই পাইনি কনোদিন।যুক্তির স্বচ্ছতা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এ দর্শনের প্রাণ।
হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম, ও ইসলামধর্মের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস, কিন্তু বুদ্ধ ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে যুক্তি। বুদ্ধের বানী ও উপদেশকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করলে বা নির্বিচারে গ্রহণ করলে বুদ্ধ ধর্মকে বুঝা যাবে না। একমাত্র যুক্তির মাধ্যমে বুদ্ধ ধর্মকে জানা বা বুঝা সম্ভব। বুদ্ধ যীশু খ্রিষ্টের মতো ঈশ্বরের সন্তান নন, শ্রীকৃষ্ণের মতো ভগবান নন, হযরত মুহম্মদের (দঃ) মতো পয়গম্বরও নন। রাজপুত্র হলেও তিনি ছিলেন আমাদের মতই রক্ত মাংসের মানুষ যিনি নিজের সাধনাবলে বুদ্ধত্ব লাভ করে ইতিহাসে মহামানব বলে পরিচিত হবার গৌ্রব অর্জন করেন। অন্যান্য ধর্ম প্রচারকরা যেখানে নিজেদের বানীগুলোকেই এক মাত্র পরম সত্য বলে দাবী করেন এবং এগুলোকেই অন্ধভাবে ও নির্বিচারে গ্রহণ করার জন্যে আহ্বান জানান, বুদ্ধ সেখানে তাঁর অনুগামীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘আমি যা বলছি তা তোমরা নির্বিচারে মেনে নিওনা, আমার কথাকে তোমরা নিজেরা পরিক্ষা করে দেখ।’ এত বড় কথা যুক্তিবাদী ছাড়া আর কে বলতে পারে?
এ জীবন ও জগতকে বুদ্ধ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলদ্ধি করেছেন, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দ্বারা বিচার করেছেন, যুক্তি দিয়ে বুঝাবার চেষ্টা করেছে। অন্যান্য ধর্ম যেখানে বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়েছে, বুদ্ধ ধর্ম সেখানে প্রাধান্য দিয়েছে বুদ্ধিকে, যুক্তিকে এবং এ জীবন ও জগতের সব জিনিসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। বুদ্ধের মতে জগতের প্রত্যেক্তি জিনিস কার্যকারণ শৃঙ্খলাবদ্ধ। কোন বস্তুই স্বয়ং উৎপন্ন হইনা একটি ঘটনা অন্য একটি ঘটনা থেকে সঞ্জাত। সবকিছুই উৎপত্তি হয় ঘটনা থেকে। বুদ্ধ দর্শনে এ তত্ত্বকে বলা হয় ‘প্রতীত্যসমুৎপাদ’। এ তত্ত্বানুসারে আমাদের জীবন দুঃখময় , এ দুঃখের কারণ আছে, এ দঃখ থেকে মুক্তিও পাওয়া যায়। জীবন যে দুঃখময় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বুদ্ধ নিত্য, অপরিবর্তনশীল, চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর বলে কোন জিনিজের অস্তিত্বকে স্বীকার করেন না। তাঁর মতে জগতের সবকিছু পরিবর্তনশীল, সারা বিশ্বে চলেছে বস্তুর বিরামহীন পরিবর্তন ও রূপান্তর। আমাদের জীবন হচ্ছে এক অবিরাম প্রবাহ-আবির্ভাব ও তিরোভাব এক অন্তহীন স্রোত, এ জগতে শাশ্বত সত্তা বলতে কোন জিনিস নেই।বুদ্ধ দর্শনের এ বৈজ্ঞানিকমত পরবর্তীকালে মার্ক্স ও এঙ্গলকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। অধিবিদ্যায় বা শুদ্ধ তত্ত্ব জিজ্ঞাসায় বুদ্ধ কোনদিন আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর দর্শন ছিল সম্পূর্ণভাবে জীবন মুখী। জীবন সমস্যা সমাধানে যে জিনিস কোন প্রয়োজনে আসে না, বুদ্ধ সে জিনিসকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেছেন. বুদ্ধের মতে, জগত কি নিত্য না অনিত্য, সসীম না অসীম, ঈশ্বর আছে কি নেই এ ধরণের তত্ত্ব বিচারে আত্ত্বনিয়োগ করা অর্থহীন এবং সময়ের অপচয় মাত্র, কারণ এতে দুঃখের নিবৃত্তি হয় না, জিবনের লক্ষ্য অর্জিত হয় না। বুদ্ধ দর্শনের বৈশিষ্ট্য তাই শুদ্ধ তত্ত্ব বিচার নয়,দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের চেস্তা করা। এ মুক্তির প্রশ্নে বুদ্ধ ধর্ম যে মত পোষণ করে তা নিঃসন্দেহে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী.
[ ড: নীরুকুমার চাকমা, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ]
[বুদ্ধঃ তাঁর ধর্ম ও দর্শন পুস্তক থেকে]