সঞ্জীব বর্মন
১৯০৩ সালে জার্মানিতে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্ঘ গঠিত হয়েছিলো৷ ১০০ বছর পর এই মূহুর্তে জার্মানিতে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ নিয়মিত বৌদ্ধ ধর্মের রীতি নীতি পালন করেন৷ গত সপ্তাহান্তে ভুপার্টাল শহরে প্রায় ৬০০ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জার্মান বৌদ্ধ সংগঠনের বাত্সরিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন৷ সারা দেশ জুড়ে মোট ৫৪টি বৌদ্ধ গোষ্ঠি এই সংগঠনের সদস্য৷ জার্মানিতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি এই আগ্রহের কারণ কী ?
ভুপার্টাল শহরের একটি ভবনের দোতলায় ছোটখাটো একটা হল৷ টেবিলের উপরে রাখা সোনালি রঙের এক বুদ্ধমূর্তি৷ চেয়ারের বদলে মেঝের উপর ছোট ছোট আসন বিছিয়ে রাখা আছে৷ চারিদিকে ধুপের গন্ধ৷ বেগুনি রঙের একটি আসনের উপর বসে আছেন শুভ্রকেশী এক মহিলা – ঠোঁটের কোণে তাঁর মৃদু হাসি৷ নাম তাঁর বজ্রমালা৷ তিনি বলছিলেন, “আমার মনে হয়, মানুষ যদি হৃদয়ের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা বহন করতে শেখে, তাহলে আমাদের আর কখনো যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখতে হবে না৷”
জার্মানিতে জন্ম হলেও বজ্রমালা নামে ভারতীয়৷ তিনি জার্মান বৌদ্ধ সংগঠনের মূখপাত্র৷ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্মের বিশাল শক্তি সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত৷ এবছরের সম্মেলনের মূল বাণীই ছিলো – শান্তির পথে সহমর্মী হন৷ বক্তাদের মধ্যে আলোচনা চলছিলো – বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাজনৈতিক আঙিনায় সক্রিয় হওয়া উচিত কি না৷ সম্মেলন উপলক্ষে সাধারণ দর্শকদের জন্য বেশ কয়েকটি স্টল তৈরী করা হয়েছিলো – যেখানে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে৷ দর্শকদের একজন বললেন, “মানুষ আনন্দের সন্ধান করে চলেছে৷ চারিদিকে খোঁজ চালিয়ে যদি সেই আনন্দের সূত্র পাওয়াও য়ায়, তা বড়জোর ২০, ৩০ বছর স্থায়ী হয়৷ তখন দেখা যায় এককালে কেনা নতুন গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে, বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে স্ত্রীও সঙ্গে নেই, বাড়ি কেনার ঋণ শোধ করা যায় নি৷ এই করতে করতে একদিন সব শেষ হয়ে যায়, তারপর আসে মৃত্যু৷”
যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই শুধুমাত্র দলাই লামার সহাস্য ছবির পোস্ট কার্ড কিনে বা মেডিটেশন শেখার সেমিনার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন নি৷ তাঁদের অনেকেরই প্রশ্ন ছিলো, প্রাচুর্যে ভরা এই জীবনের প্রকৃত অর্থ কী? যেমন রুডলফ প্রয়েস৷ তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার আগেও তাঁর প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে অনেক সন্ধান চালিয়েছিলেন৷ রুডলফ বললেন, “বহুদিন ধরে আমি গির্জার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, সেখানে নানারকম কাজ করেছি৷ একসময়ে মনে হয়েছে, আমি একটা সীমায় পৌঁছে গেছি৷ এর বাইরেও নিশ্চয় অন্য কিছুও আছে৷ তারপর হঠাত করে আমি বৌদ্ধধর্মের সংস্পর্শে আসি৷ তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে একটা বই আমার হাতে আসে – যার বিষয় ছিল পশ্চিমা বিশ্বে বৌদ্ধ ধর্ম৷”
জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছেন ফ্রানত্স লিচ- ও৷ বার্লিনবাসী এই স্থপতি সমাজের মধ্যে আরও উদ্যোগ দেখতে চান৷ তিনি আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ নেটওয়ার্ক-এ অত্যন্ত সক্রিয়৷ ১৯৮৯ সালে থাইল্যান্ড-এ এই নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়৷ তিব্বত থেকে ভারতে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সহায়তায় জার্মান বৌদ্ধরা বেশ কিছু কাজ করছে৷ তবে জার্মান বৌদ্ধরা নিজেদের দেশের অনেক বিষয় নিয়েও চিন্তিত৷ লিচ জানালেন, “জার্মানির মানুষের বেশীরভাগ সমস্যাই মানসিক স্তরে৷ যেমন জীবন সম্পর্কে হতাশা, সেই হতাশার কারণও খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি৷ সব মিলিয়ে মানুষের মনে গভীর এক অসন্তুষ্টি বোধ কাজ করে চলেছে৷ জার্মানিতে মানুষ বৌদ্ধধর্মের মধ্যে একধরণের আশ্রয় খোঁজেন, তাঁরা চান এক সুরক্ষিত বলয়৷”
জার্মানদের চোখে দূর প্রাচ্যের এই ধর্মের প্রতিনিধিরা সদা উত্ফুল্ল৷ তাই হতাশায় ভরা মানুষদের কাছে এই জ্যোতি অত্যন্ত আকর্ষণীয়৷ বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকর্ষণ তাই বেড়েই চলেছে৷