প্রজ্ঞাশ্রী ভিক্খু
বর্তমান সময়ে বৌদ্ধধর্মের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায়, বৌদ্ধধর্ম ব্যাপকভাবে সমাদৃত-জনপ্রিয় একটি ধর্ম ও দর্শন। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশসমূহের যুবক-যুবতীদের মাঝে বৌদ্ধধর্ম যুক্তিসংগত, বৈজ্ঞানিক, আধুনিক এবং বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হিসেবে ব্যাপকহারে সমাদৃত। তারা বিশ্বাস করে এ ধর্ম জ্ঞানী এবং শিক্ষিত ব্যক্তিদের জন্য। মহাকারুণিক বুদ্ধের কণ্ঠেও এ কথাটি ভাষিত হয়েছে-
“Pannavantassayam dhammo, Nāyam dhammo duppannassa; পঞ্ঞাবন্তস্সযং ধম্মো, নাযং ধম্মো দুপঞ্ঞাস্সা। This doctrine is for the wise people, This doctrine is not for unwise or unintelligent people. এ ধর্মানুশাসন বা মতবাদ জ্ঞানী ব্যক্তিদের জন্য; এ ধর্মানুশাসন বা মতবাদ অজ্ঞানী ও নির্বোধের জন্য নয়।”
এ কারণে তাদের মাঝে বৌদ্ধধর্ম আচরণ ও অনুশীলনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সে তুলনায় এ প্রবণতা এশিয়ান দেশ সমূহের তরুণদের মাঝে পরিলক্ষিত হয় না। এমনকি বৌদ্ধ ঘরে জন্মজাতদের মাঝেও নয়! আবার তাদের অনেকে মনে করেন, Buddhism is mainly for the old people; it is out-dated and old fashioned! প্রকৃতপক্ষে, বৌদ্ধধর্ম হল “অকালিকো” অর্থাৎ এ ধর্ম প্রতিপালনের নির্দিষ্ট কোন সময় বা কাল নেই।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বৌদ্ধধর্ম কখনো আমাদেরকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে শিক্ষা দেয় না। কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ ব্যক্তি নিজেই তা অনুধাবন-আবিষ্কার করবে, বিচার-বিবেচনা করবে। মহাকারুণিক বুদ্ধ কালাম সূত্রে, কেশপুত্রের কালামগণকে উপলক্ষ করে এমনও দেশনা করেছেন- হে কালামগণ, “শ্রুত কথার ভিত্তিতে কারো কথা মেনে নিও না; তর্কের খাতিরে, বিনা যুক্তিতে, বক্তার ভব্যরূপে অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের প্রভাবে অভিভূত হয়ে, নিজের পুরনো সিদ্ধান্তের অনুকূল বলে, এই শ্রমণ আমার গুরু বলে মেনে নিও না; দেখতে সত্য বলে মনে হয় – একারণেও বিশ্বাস বা মেনে নিও না” তাহলে আমাদের কি করা উচিত? কালামগণের এ প্রশ্নে বুদ্ধ দেশনা করলেন, হে কালামগণ, নিজেদেরকে জিজ্ঞেস কর, প্রশ্ন কর; এগুলো অযোগ্য কিনা, এগুলো নিন্দার্হ কিনা? এগুলো জ্ঞানী ব্যক্তিদের দ্বারা নিন্দনীয় কিনা, এগুলো দুঃখ দুর্দশার দিকে পরিচালিত করে কিনা?
Kalamas, when you yourselves know: ‘These things are bad; these things are blamable; these things are censured by the wise; undertaken and observed, these things lead to harm and ill,’ abandon them. ‘হে কালামগণ, যখন তোমরা নিজেরা জানবে: এগুলো খারাপ; এগুলো অযোগ্য; এগুলো জ্ঞানী-গুণী কর্তৃক নিন্দনীয়; গ্রহণ এবং পালন, এগুলো দুঃখ দুর্দশার দিকে পরিচালিত করে,’ তবে পরিত্যাগ কর. -কেশপুত্র সূত্র (অঙ্গুত্তর নিপাত, সূত্র পিটক)
The fruit of practicing the Dhamma is, one can discover the Truth by oneself. ধর্ম অনুশীলনের পূণ্যফল হল, ব্যক্তি নিজেই সত্য উদ্ঘাটন করতে পারে। তাই বুদ্ধ দেশনা করেছেন, “পচ্চত্তম বেদিধম্মো” এ ধর্ম বিজ্ঞগণ কর্তৃক স্বচেষ্টায় জ্ঞাতব্য, এ ধর্ম অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর নয়, এ ধর্ম গভীর গবেষণা প্রসূত, সুক্ষ্ম বিশ্লেষণযোগ্য ও নিরপেক্ষ বিচার মীমাংসা নির্ভর। জ্ঞানীগণ অনুরূপভাবে তা জ্ঞাত হন এবং উপলব্ধি করেন। তাই বলা হয় স্বচেষ্টায় এ ধর্ম বিজ্ঞগণের বোধগম্য। “এহিপস্সিকো” এস এবং দেখ। অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে আপন বিবেক, বিবেচনা, বোধশক্তি প্রয়োগে যাচাই কর।
দূলর্ভ মানব জন্মে এমন একটি স্বাধীন ধর্ম পেয়েও আমরা অন্ধভাবে ছুটছি মিথ্যা ও অবিদ্যার দিকে। সত্য পথ ভুলে ডুবছি মোহ অন্ধকারচ্ছন্নতায়। অথচ, Quantum Method যেভাবে করে বুদ্ধের Meditation শিক্ষা হতে উপাদান সংগ্রহ করে স্বতন্ত্রতার পরিচয় দিয়ে জন মানুষের জীবনে প্রশান্তির আহ্বান জানাচ্ছে, সে বিবেচনায় আমরা যদি অন্ততঃ নিজেদের এ ধ্যান নিধি অনুশীলনকে হলেও প্রাধান্য দিই তবে আলোকিত জীবন গড়ার স্বপ্ন অপূর্ণ থাকবে না, সেই সাথে জ্ঞানালোকে পূর্ণতা ও প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়বে দেহ-মনে।
মুক্ত-স্বাধীন চিন্তা-মননে সমৃদ্ধ বুদ্ধের ধর্মবাণী আজ জম্বুদ্বীপ পেরিয়ে বিশ্বের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এবং বুদ্ধের শিক্ষা, ধর্মবাণীকে অনুধাবন করে দিন দিন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ এবং পালনে ব্রতী হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষি, সংস্কৃতির মানুষ। সে পদাঙ্ক অনুসরণ করে নয়, বরং নিজেদের বোধশক্তি, চিন্তা-মনন ও সত্যান্বেষী হয়ে সদ্ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে বৌদ্ধ পরিবারে জন্মজাত বৌদ্ধগণও যদি ধর্ম পালনপূর্বক নিজেদের জীবনকে আলোক হতে আরো আলোকের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় তবেই ব্যক্তি হিসেবে যেমন মানব জীবন সার্থক। তেমনি বৌদ্ধ জাতি হিসেবেও আমরা হবো গর্বিত।
আসুক ফিরে সুদিন, প্রদীপ্ত হোক জ্ঞানালো,
মুছে যাক কলুষতা, মুছে যাক যত কালো।
জয়তু বুদ্ধ সাসনম্।