মার্কিন রেকর্ড প্রডিউসার স্টিভ টিব্বেতস-এর সঙ্গে দ্রলমা (বাঁয়ে)
আন্তজাতিক ডেস্ক
নেপালে বসবাসরত তিব্বতি শরণার্থী পিতামাতার ঘরে জন্ম অ্যানি চইং দ্রলমা কিন্তু কিশোরী সেবিকা থেকে তার আন্তর্জাতিক সংগীত তারকায় পরিণত হওয়ার গল্প রূপকথার মতো। বদান্যতার দরুন নেপালজুড়েই তার জানাশোনা। ইউনিসেফের জাতীয় দূতের সম্মান নেপালে তিনিই প্রথম পান। আর এরপর তার সঙ্গে ভারতের মাদার তেরেসার তুলনাটা চলে আসে। সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দ্রলমার গল্প। প্রতিবেদনে বলা হয়, এখন পর্যন্ত ১২টি পপ গানের অ্যালবাম নিয়ে দ্রলমা বরং ব্যতিক্রমী আর যুগান্তকারী এক ব্যক্তিত্ব। বিয়ে করেননি। সন্তানও নেই। ৪৫ বছর বয়সে নিজেই গাড়ি চালান রাজধানী কাঠমান্ডুতে। জোরে হর্ন বাজানোর পাশাপাশি তার গাড়ি চালানোর আরেক বৈশিষ্ট্য হলো উচ্চস্বরে নিজের গান বাজানো! অর্থাৎ, নেপালে নারী বলতে যা ভাবা হয়, তার পুরো বিপরীত তিনি। তার নিজের ভাষ্য, ‘আমার সমাজের কথা চিন্তা করলে আমিই এখানে সবচেয়ে বিপ্লবী।’ একটুও বাড়িয়ে বলেননি দ্রলমা।
শৈশব বেশ রুক্ষই ছিল তার। বাবা তাকে খুব বেশি মারতেন। তার ভাষায়, ছোট ছোট ব্যাপারে বাবা রেগে যেতেন। আমাকে আর মাকে মারতেন। আজ আমার মনে হয় এটা তার কোন রোগ ছিল। অথচ, আমরা এর কারণে ভুগেছি।
১০ বছর বয়সে রাগে-ক্ষোভে দ্রলমা সিদ্ধান্ত নেন বৌদ্ধ সেবিকা হবেন। আর এরা কখনও বিয়ে করতে বা সন্তান নিতে পারেন না। ওই সময়কার কথা ভেবে তিনি বলেন, আমি তখন ভাবলাম আমি যদি বড় হই আর বিয়ে করি তাহলে বাবার মতোও ওই পুরুষও আমাকে একইভাবে মারবে। এই ঘরোয়া সহিংসতা আমাদের সমাজে বেশ বড় একটি সমস্যা।
বাবা-মাকে যখন সেবিকা হওয়ার ইচ্ছার কথা জানালেন দ্রলমা, তারা রাজি হলেন। কারণ, তাদের বিশ্বাসই হলো কেউ সেবিকা হলে নিজের জীবন আরো ইতিবাচকভাবে কাটানো যায়। তিন বছর পর স্থানীয় একটি বৌদ্ধ ধর্মালয়ে তাকে গ্রহণ করা হলো। কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই দ্রলমা নিজের চুল কেটে ফেললেন। প্রতিদিনকার কাপড় ফেলে দিলেন। পাল্টে ফেললেন জন্মগত নাম: দলমা সেকয়িড। হয়ে গেলেন দ্রলমা। তার ভাষ্য, ‘আমি যখন প্রথম আমার মাথা মুণ্ডন করি, আমি খুবই মুক্ত অনুভব করি।’ কাঠমান্ডু উপত্যাকার এক পর্বতশৃঙ্খে নাগি গোমপা নামে ওই ধর্মালয় অবস্থিত। দ্রলমার কাছে এটি ছিল স্বর্গের মতো। ‘পুরো পরিবেশ ছিল সুন্দর। সবাই খুব বিনয়ী। আমাকে আর কেউ মারেনি। আমাকে পেছনে দুই ছোট ভাইকে আর চড়াতে হয়নি। ঘরদোর পরিষ্কারের কাজ করতে হয়নি। আমি যেন আমার শৈশব ফিরে পেলাম।’ মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, নেপালের ৩৭ শতাংশ মেয়েরই ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায়। সেখানে দ্রলমা ভালো শৈশবই পেয়েছেন বলতে হবে। বিদেশিরা প্রায়ই আসতেন নাগি গোমপায়। ১৯৯৩ সালের এক দিনে সেখানে এলেন আমেরিকার রেকর্ড প্রডিউসার স্টিভ টিব্বেতস। সেখানে দ্রলমার মূল গুরুর কাছ থেকেই ধ্যানচর্চা শিখতে গিয়েছিলেন তিনি। ফিরে আসার আগের দিন টিব্বেতসকে একজন বললেন দ্রলমার গান শুনতে। টিব্বেতসের ভাষায়, প্রথমে নিজের চোখ কুঁচকে অবাক হলো দ্রলমা। এরপর বড় শ্বাস নিয়ে শুরু করলো লিমন টেন্ড্রেলের কয়েকটি লাইন। আমি এতটা অবাক হলাম গানের গলা শুনে, স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। এতটাই স্তব্ধ ‘রেকর্ড বাটনে চাপতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি! দেশে ফিরে গিয়ে তিনি দ্রলমার কণ্ঠে গাওয়া গানের সঙ্গে পশ্চিমা গিটারের মিশ্রণ ঘটালেন। খুব ভালো লাগলো তার কাছে। এরপর একটি অ্যালবামে কাজ করার প্রস্তাব দেন দ্রলমাকে। তার রকস্টার জীবনের বাকিটা ইতিহাস। এরপর তারকাখ্যাতির পাশাপাশি অর্থবিত্তও জুটতে থাকে তার। ১৯৯৮ সালে তিনি নান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। দু’বছর পর তিনি কাঠমান্ডুতে বিনামূল্যের আর্য তারা বোর্ডিং স্কুল শুরু করেন। এখানে ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়াও ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও কমিপউটার শিক্ষাও শেখানো হয়। টিব্বেতস ভেবেছিলেন, নতুন পাওয়া অর্থকড়ি নিয়ে কাঠমান্ডুতে ঘরবাড়ি বানাবেন, কিংবা গাড়ি কিনবেন। কিন্তু না! দ্রলমা নিজের স্বপ্নই বাস্তবায়ন করেছেন। পরের এক দশক ধরে প্রতি বছর একটি করে অ্যালবাম করেছেন। আর জনপ্রিয়তার পারদ সবসময়ই ঊর্ধ্বগামী ছিল। তার প্রথম আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ সিংগিং ফর ফ্রিডম ২০০৮ সালে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়। অনূদিত হয়েছে ১৫টি ভাষায়।
২০১০ সালে তার নান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন আরোগ্য ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে। এখানে কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ কাজে সরকারকে এগিয়ে আসতে চাপ দেন তারা। একপর্যায়ে সরকারও সম্মত হয়। দ্রলমার মা কিডনি সমস্যার কারণে মারা যান।