ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন বক্তা ও কানাডার ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি অব অন্টারিও’র প্রেসিডেন্ট প্রফেসর অমিত চাকমাকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৫০তম সমাবর্তন শুরু হয়েছে।
শনিবার (৪ মার্চ) বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল প্রাঙ্গণ থেকে সমাবর্তনের শোভাযাত্রা শুরু হয়। এরপর সকাল সাড়ে ১১টায় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে শুরু হয় সমাবর্তনের মূল আনুষ্ঠানিকতা।
স্বর্ণপদকপ্রাপ্তদের পদক প্রদান করেন রাষ্ট্রপতি।
সমাবর্তন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন সমাবর্তন বক্তা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট এবং উপাচার্য অধ্যাপক অমিত চাকমা। সমাবর্তন বক্তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
সমাবর্তনে ১৭ হাজার ৮৭৫ জন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীকে সনদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ৮০ জনকে স্বর্ণপদক, ৬১ জনকে পিএইচডি ও ৪৩ জনকে এমফিল ডিগ্রি দেওয়া হয়।
আচার্য আবদুল হামিদ বলেন, গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করতে হলে দেশে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। আর সেই নেতৃত্ব তৈরি হবে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই। তিনি বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে অছাত্ররাই ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব দেয়, নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে ছাত্র রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা, সমর্থন ও সম্মান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এটি দেশ ও জাতির জন্য শুভ নয়। তাই এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে ছাত্র রাজনীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘আমার নিজেরও ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। কিন্তু সেই সময়ের রাজনীতি আর আজকের ছাত্র রাজনীতির তফাৎ অনেক। ষাটের দশকে আমরা যারা ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলাম তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণ। দেশের মানুষকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের কোনো স্থান ছিল না। সাধারণ মানুষ ছাত্রদের সম্মানের চোখে দেখত।’

এবারের সমাবর্তন বক্তা ছিলেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওর উপাচার্য অধ্যাপক অমিত চাকমা। সমাবর্তনে তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি দেওয়া হয়। তিনি একজন রাসায়নিক প্রকৌশলী হিসেবে বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করেছেন। সমাবর্তন বক্তা করায় অমিত চাকমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমার কর্মজীবনে সফলতার কারণ, আমি মেধাবী না হলেও মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করেছি।’
সমাবর্তনকে শেখার জগতের সমাপ্তি নয়, বরং একটি মাইলফলক বলে মনে করেন অমিত চাকমা। তিনি বলেন, এই ডিগ্রি ও মেধাকে যেভাবে কাজে লাগাবেন, আপনার জীবন সেভাবেই চলবে। যে যত জ্ঞান অর্জন করবেন, তাঁর ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা তত বেশি থাকবে। নীতির ওপর তত বেশি অটল থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরিন আহমদ, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এনামউজ্জামান, বিভিন্ন অনুষদের ডিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত রয়েছেন।
শনিবার যাকে এই সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত করা হলো, কাপ্তাই বাঁধের কারণে ঘরহারা হয়েছিল সেই অমিত চাকমার পরিবার।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ণে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ কার্য শুরু হয় ও ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ সমাপ্ত হয়। পানি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে বাঁধ নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহনের ফলে কাপ্তাই এলাকার স্থায়ী অধিবাসীরা তাদের বাড়ী-ঘর এবং চাষাবাদযোগ্য জমি হারিয়েছেন। এর মধ্যে অমিত চাকমার পরিবারও ছিল। তখন চল্লিশ হাজারেরও অধিক চাকমা আদিবাসী সম্প্রদায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্থানান্তরিত হয়েছেন।
অমিত চাকমা বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করার পর আলজেরীয় সরকারের বৃত্তি নিয়ে ‘রাসায়নিক প্রকৌশল’ বিভাগে আলজেরিয়ার বিখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। ১৯৭৭ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
এরপর কানাডায় চলে যান মাস্টার্স ও পিএইচডি অধ্যয়নের জন্য। কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে রাসায়নিক প্রকৌশল বিষয়ে এমএএসসি এবং পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালগারির রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপনা করার পর ১৯৯৬ সালেই ইউনিভার্সিটি অফ রেগিনা-তে চলে যান। সেখানে রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৯৯ থেকে ২০০১ পর্যন্ত রেগিনার ভাইস-প্রেসিডেন্ট রিসার্চ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখানে থাকার সময়ই অমিতকে কানাডার ‘টপ ৪০ আন্ডার ৪০’ তে স্থান করে নেন।
এরপর ২০০১ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াটারলু-র অ্যাকাডেমিক ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং প্রভোস্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
২০০৯ সালের ১লা জুলাই অমিত চাকমা ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন ওন্টারিওর প্রেসিডেন্ট ও উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে অমিতের লক্ষ্য ওয়েস্টার্ন ওন্টারিওকে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের সারিতে পৌঁছে দেয়া।