সুনীল বড়ুয়া:
হাজারো পুণ্যার্থীর গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্যদিয়ে সম্পন্ন হয়েছে কক্সবাজার পশ্চিম ঝিলংজা আর্য্য বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত রত্নপ্রিয় ভিক্ষু’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান।
শুক্রবার সকাল থেকে (৩ মার্চ) কক্সবাজারের রামু শ্রীকুল মৈত্রী বিহার এবং পার্শ্ববর্তী মাঠে এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে বসেছিল প্রাণের মেলা। সন্ধ্যায় মোমবাতি,ধুপ বাতি ও চন্দন কাঠের আগুনে দাহ করার মধ্যদিয়ে শেষ শ্রদ্ধায় বৌদ্ধ ভিক্ষুকে বিদায় জানান ভক্তরা।
এর আগে ভোর থেকে বুদ্ধ পুজা,মহা সংঘদান,অষ্ট উপকরণ দান,আলোচনা সভা,ধর্মসভা,ঐতিহ্যবাহী আলং নৃত্যসহ নানা আয়োজন। আগের দিন বিহার প্রাঙ্গনে আয়োজন করা হয় বুদ্ধ কীর্তন।
বাংলাদেশী বৌদ্ধদের উপ-সংঘরাজ একুশে পদক প্রাপ্ত পন্ডিত ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথের’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল।
এর আগে সকালের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ৫০ বর্ডার গার্ড রামু’র অধিনায়ক লে.কর্ণেল গোলাম মঞ্জুর ছিদ্দিকী।
মহতী পুণ্যানুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ উপ-সংঘরাজ একুশে পদকে ভূষিত পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের।
বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন রামু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম, ইউএনও মোহা. শাজাহান আলি, ওসি প্রভাষ চন্দ্র ধর ও ফতেঁখারকুল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে ধর্মদেশনা করেন, বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা’র মহাসচিব এস লোকজিৎ থের, রামু উসাই-ছেন রাখাইন (বড় ক্যাং) বৌদ্ধ বিহার অধ্যক্ষ উ-পাঞ্ঞাদীপা মহাথের ,দ্বীপ শ্রীকুল ধর্মরত বৌদ্ধ বিহার অধ্যক্ষ উ-পাঞ্ঞাওয়ারা মহাথের, চট্টগ্রাম নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহার উপাধ্যক্ষ প্রিয়রত্ন মহাথের ও রামু মৈত্রী বিহারের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাতিলোক ভিক্ষু, উখিয়া জ্ঞানসেন বৌদ্ধ ভিক্ষু-শ্রামণ প্রশিক্ষণ ও সাধনা কেন্দ্রের প্রধান পরিচালক কুশলায়ন মহাথের, রামু হাজারিকুল বোধিরত্ন বৌদ্ধ বিহার অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাবোধি মহাথের, রামু উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ করুণাশ্রী থের, উত্তর ফতেখাঁরকুল বিবেকারাম বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শীলমিত্র থের প্রমুখ।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক পরিচালক ‘আমাদের রামু নিউজ ডটকম’ সম্পাদক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু।
অন্যান্যদের মধ্যে প্রয়াত ভদন্ত রত্নপ্রিয় ভিক্ষুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া উদযাপন পরিষদের কার্যকরি সভাপতি শীলপ্রিয় থের, সাধারণ সুগত রঞ্জন বড়ুয়া ও রামু মৈত্রী বিহার পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ বড়ুয়া বক্তৃতা করেন।
সন্ধ্যায় রেঙ্গুনী কারুকাজে সজ্জিত আলংয়ে স্থাপিত মরদেহে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে উৎসবের শেষ হয়।
বেলা দেড়টা থেকে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী আলং নৃত্য। দৃষ্টি নন্দন রেঙ্গুনি কারুকাজে সজ্জিত আলং নিয়ে চমৎকার নৃত্যশৈলী প্রদর্শন করেন। কক্সবাজার ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে আসা ছয়টি নৃত্যদল। প্রায় বিকাল চারটা হাজারো পুণ্যার্থী ঐতিহ্যবাহী এ নৃত্য উপভোগ করেন।
সন্ধ্যায় আতশবাতি,মোমবাতি ও চন্দন কাঠের আগুনে সুসজ্জিত আলংয়ে অগ্নিসংযোগের মধ্যদিয়ে শেষ হয় বৌদ্ধ ভিক্ষু ভদন্ত রত্নপ্রিয়’র শেষ কৃত্যানুষ্ঠান।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপ-সংঘরাজ, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের’র প্রিয়শিষ্য প্রয়াত ভদন্ত রত্নপ্রিয় ভিক্ষু প্রয়াত ফকির চাঁদ বড়ুয়া ও বেনু বালা বড়ুয়ার তিন পুত্র ও চার কন্যার মধ্যে রত্নপ্রিয় ভিক্ষু (বঙ্কিম চঁন্দ্র বড়ুয়া) ছিলেন ৪র্থ সন্তান।
চন্দ্র মাসের ২য় তিথিতে জন্ম গ্রহণ করেন বলেই পিতামাতা পুত্র সন্তানের নাম রাখেন বঙ্কিম চন্দ্র। উখিয়ারঘোনা টেইলা পাড়া মক্তবে শুরু হয় তার বর্ণ পরিচয়। এর বছর দু-এক পর রামু খিজারী এটাস্ট প্রাইমারী স্কুলে (বর্তমান রামু প্রাইমারী স্কুল) ভর্তি হন। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯৫৯ সালে রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর নারিজহাট কলেজে ভর্তি হন।
কর্ম জীবনে তিনি একে খাঁন ফ্লাইউড কোম্পানী, সাঙ্গুভেলী টিম্বার ইন্ডাস্ট্রিস,রূপালী ব্যাংক, সর্বশেষ ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত রামু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অফিস সহকারী হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৮৯ সালে ব্যাংকের চাকুরি ছেড়ে রামু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ওই বছর তিনি এ বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি নিজেকে জড়িয়ে নেন সামাজিক এবং ধর্মীয় কাজে।
২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি রামু সীমা বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথের’র শিষ্য হিসেবে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন এবং পরের দিন ৩ জানুয়ারি উপসম্পদা লাভ করে রত্নপ্রিয় ভিক্ষু নাম ধারণ করেন।
রামু সীমা বিহারে আবাসিক ভিক্ষু হিসেবে এক বর্ষাবাস এবং কক্সবাজার পশ্চিম ঝিলংজা আর্য্য বিহারের বিহারাধ্যক্ষ হিসেবে দুই বর্ষাবাস যাপন করেন।
২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর তাঁর মরণ ব্যাধি লিভার সিরোসিস ও ক্যানসার সনাক্ত হয়। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দুইমাস শয্যাশায়ী অবস্থায় কাটানোর পর গত গত ১৩ ফেব্রুয়ারি’১৭ (সোমবার) সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় রামু মৈত্রী বিহারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর শবদেহ ধর্মীয় মর্যাদায় পেটিকাবদ্ধ করা হয়।