মহেশখালীতে অনেক দেখার স্থানের মধ্যে অন্যতম শতাব্দীর পুরানো ঐতিহাসিক বৌদ্ধ মন্দির। রাখাইনদের বৌদ্ধ মন্দির দেখার জন্য মহেশখালীতে প্রতিনিয়ত পর্যটকদের সমাগম ঘটে। বৌদ্ধ মন্দির দেখার অনেক কিছু রয়েছে বলে রাখাইনরা মনে করে। মহেশখালীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ২০০১ সালের আদমশুমারীর হিসাব অনুযায়ী ৭০০০ (সাত হাজার) জন এবং ৫টি বৌদ্ধ মন্দির। রাখাইন আবাসিক এলাকা গুলো যথা মহেশখালী পৌরসভা, শাপলাপুর ও ছোট মহেশখালীর ঠাকুরতলা রাখাইন ধর্মাবলম্বীরা যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস ও ধর্ম পালন করে আসছে। তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়ই কর্মঠ। ছেলেমেয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিনিয়ত পরিবারের ভরণপোষনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। মূলত তারা স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও মহাজনী কারবারী। তাছাড়া টেইলার্স, ছোট ছোট মুদির দোকান, তাঁতের কাপড় তৈরী এবং কিছু লোক জেলের কাজ করে। তারা বেশির ভাগ সচ্ছল। মহেশখালী রাখাইন ও নারী-পুরুষ ধর্মের প্রতিও সচেতন। পার্বণের সময় বিভিন্ন দোকানপাঠ বন্ধ করে ধর্মীয় আচারে মন দেয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় বড় দিনের মধ্যে সবচেয়ে বড়দিন হলো বৌদ্ধ পূর্ণিমা, তার আচরিত দিক হলো যেদিন পূজা আরম্ভ হবে সেদিন তারা বিভিন্ন পূজা ঘরে গিয়ে সুগন্ধি পরিবেশন করে এবং গোলাপ জল দিয়ে ছোট বড় বৌদ্ধ মূর্তি স্নান করায়। ছোট বড় রাখাইন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সকলে বৌদ্ধ মূর্তির সামনে দু’হাত জোর করে প্রার্থনা রত হয়। কারণ সেদিন গৌতমবুদ্ধের জন্মদিন, নির্বাণ লাভের দিন ও সমাধীর দিন। তাদের আর একটি বড়দিন হলো ফানুস বাতি উড্ডয়নের দিন, এই পূজার অর্থ হলো বৌদ্ধের শিষ্যকে স্বরণ করার তাৎপর্য হলো দেশের মধ্যে কোন ঝড়-তুফান, খরা, আপদ-বালাই দুর করার উদ্দেশ্যে নারী-পুরুষ মিলে ফানুস বাতি উড্ডয়ন করে। এই সময়ে হাজার হাজার রাখাইন তরুণ-তরুণী নতুন রূপে সাজে লে-লে মাইও মাইও (হেপি পুরে হেপি পুরে) শ্লোগানে শ্লোগানে বিভিন্ন দলে দলে সব রাখাইন এলাকা মুখরিত করে। পূজাটি হয় অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে। তাদের ফানুস বাতি গুলো যদি সঠিক ভাবে উড্ডয়ন হয় তাহলে তাদের মন খুব ভাল হয়ে যায়। পূজার সময় তাদের বাড়ীতে বাড়ীতে অথিতির আপ্যায়ন হয়। রাখাইদের আরেকটি উৎসব রাখাইন ভাষায় সাংগ্রাই বা নববর্ষ উৎসব। এই সাংগ্রাই উৎসব (এপ্রিল মাসের ১৩-১৪) জলকেলি অনুষ্ঠিত হয়। জলকেলি অনুষ্ঠানটি তাদের অন্যরকম খেলা। ১৪-১৫ (১৯-২০) বছরের তরুণ-তরুণী নিজেদের মধ্যে জল নিক্ষেপনের মাধ্যমে হৃদয় বিনিময় হয়। তরুণ-তরুণেরা বিভিন্ন ঢংয়ে পোষাক পরিধান করে নাচ গানে মেতে উঠে। তরুণীরাও বিভিন্ন রকমের ফুলের লাল থামি আলপনা আঁকা ফতুয়া পরিধান করে হাতে পানির পাত্র নিয়ে ছেলেদের পানি নিক্ষেপ করে। এই তিন দিনের অনুষ্ঠানে উভয় লিঙ্গের মধ্যে অন্যরকম ভাবের সৃষ্টি হয়। তাদের বৈচিত্র্যময় ও মধুময় গান যেমন- তেঘ্রাংশে (লোকগীতি) এছাড়াও অসংখ্য সঙ্গিত রয়েছে।
লোকগীতি, লালনগীতি, প্রেম-বিরহের গান ও দেশাত্মবোধক গান এছাড়াও ধর্মীয় গান সহ রাখাইদের বিশেষ ধর্মীয় সঙ্গিত। তাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে রাখাইন তরুণ-তরুণীরা আনন্দে মেতে ওঠে। রাখাইনরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম ত্রিপিটক। ত্রিপিটক তিন ভাগে বিভক্ত যথা- ১) সূত্র, ২) বিনয়, ৩) অভিধর্ম। রাখাইনরা নিজের মাতৃভাষায় কথা বলে। তাদের ভাষা সাংস্কৃতিক ও স্বত্তার দিকে থেকে তারা বাংলাদেশের উন্নতম সম্প্রদায় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং তাদের সাংস্কৃতিকে বিভিন্ন ভাবে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- ১) আমোদ প্রমোদ, ২) রাখাইন জেপোয়া (যাত্রা), ৩) রাখাইন এয়ইন পোয়া (জলসা), ৪) রাখাইন প্রাণেই (নাটক), ৫) রাখাইন ছাখাং (গান), ৬) রাখাইন আকাহ্ (নৃত্য), এদিকে রাখাইন এয়ইন পোয়ে (জলসা) এই জলসা অনুষ্ঠান একমাত্র বৌদ্ধ ভিক্ষুর শবদাহ ও অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া উপলক্ষে এই অনুষ্ঠান। আকাহ্, সিমিং, ব্রজ্য আকাহ্, নেহ আকাহ্, তায় পাং আকা ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলো মহেশখালীর সকল শ্রেণীর রাখাইনরা ঐতিহাসিক বড় রাখাইন পাড়ার শতাব্দীর পুরানো মন্দির মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। আরো অনেক কিছু তাদের মাঝে দেখা যায়। রাখাইন তরুণীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভিন্ন পোষাক ও সোনার গয়না তামি হাব ফতুয়া পড়ে অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। রাখাইন তরুণীরা আকাশের পরীর মত করে সাজগোজ করেন। রাখাইন তরুণরাও কম সাজে না। তারা লুঙ্গির উপর সার্ট পড়ে এবং রাখাইন কিছু তরুণ সার্ট, গেঞ্জি, জিন্স পেন্ট পড়ে ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। রাখাইন দেব মন্দির টি হলো তাদের এক পরম কাঙ্খিত স্থান। রাখাইন পাড়ায় এক প্রাকৃতিক সবুজ গাছ, গাছালী, লতা-পাতায় মুড়ানো ছোট বড় অনেক দেব-দেবী নিয়ে ঐতিহাসিক রাকাইনদের বৌদ্ধ মন্দির। এই মন্দিরের চতুর্পাশ্বিক সৌন্দয্য আমর ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ণয়নাবিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দয্য শুধু নিজের চোখে দেখে প্রাণ ভরে অনুভব করা যায়। বাংলাদেশের অন্যান্য আদিবাসী, উপজাতিদের মত যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। কক্সবাজারে বিভিন্ন স্থানে উপজাতি হিসাবে রাখাইনরা নিজেদের অস্তিত্ব মেনে নিতে রাজি নয়। কেননা তারা পূর্বের স্বাধীনদেশের সভ্য জাতি বিশেষ। রাখাইনদের আলাদা ভাষা সাংস্কৃতি ও সাহিত্য রয়েছে। বর্তমানে তাদের বিকাশ ধর্ম সততা জাতিগত অধিকার অক্ষুন্ন রাখার প্রোজ্জ্বল স্বাক্ষর। রাকাইনরা একটি জাতি, তারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ও তদানিন্তন আরাকান রাজার অধিবাসী। রাখাইন জাতীর উর্ত্তিন্ন হয় খ্রিঃ পূঃ ১৩২৫ সালে। বংশগত মর্যাদায় শাংক্যবংশীয় মংগোলয়ের নর গোষ্টির অন্তর্র্ভক্ত।
পালি-শব্দ অর্থ- রাক্ষস, রাক্ষস হতে রাখাইন শব্দের উৎপত্তি বলে জানা যায়। রাখাইন জাতি হিসাবে নিজেদের ধর্ম ও সাংস্কৃতি থেকে অবক্ষয় থেকে হাত ধরে রক্ষা করে বলে তাদের রক্ষণশীল বলা হয়। তাই তারা রাখাইন।