ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদকে ভূষিত, বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপ-সংঘরাজ, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের’র স্নেহপ্রতিম শিষ্য, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী প্রয়াত ভদন্ত রত্নপ্রিয় ভিক্ষুর অন্ত্যেষ্ঠিক্রিয়া অনুষ্ঠান আগামীকাল (৩মার্চ) শুক্রবার রামু শ্রীকুল মৈত্রী বিহারে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
সকাল ৮টায় জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার শুভ সূচনা করার কথা রয়েছে। মহতী পুণ্যানুষ্ঠানে সভাপতির আসন অলংকৃত করবেন উপ-সংঘরাজ পন্ডিত ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথের। অনুষ্ঠানে ধর্মদেশনা দান করবেন ভদন্ত প্রিয়রত্ন মহাথের, নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহার, চট্রগ্রাম, ভদন্ত সুনন্দপ্রিয় মহাথের, উপাধ্যক্ষ, ঢাকা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার,ভদন্ত কুশলায়ন মহাথের, অধ্যক্ষ, শৈলরঢেবা চন্দ্রোদয় বিহার, উখিয়া, ভদন্ত করুণাশ্রী মহাথের, অধ্যক্ষ, বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র, উত্তরমিঠাছড়ি, রামু, ভদন্ত প্রজ্ঞাবোধি মহাথের, উপাধ্যক্ষ, পাতাবাড়ি আনন্দভবন বিহার, উখিয়া, ভদন্ত এস, লোকজিৎ থের, মহাসচিব, বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা, ভদন্ত জ্যোতিসেন থের, অধ্যক্ষ, রাংকুট বনাশ্রম বিহার, রামু, ভদন্ত শীলমিত্র ভিক্ষু, অধ্যক্ষ, ফতেঁখারকুল বিবেকারাম বিহার, রামু প্রমূখ।
ভদন্ত রত্নপ্রিয় ভিক্ষুর স্মৃতিচারণ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে সাংসদ আলহাজ¦ সাইমুম সরওয়ার কমল এমপি উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে । অনুষ্ঠানের মহতী সংঘদান সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে রামু ৫০ বর্ডার গার্ড, অধিনায়ক লে-কর্ণেল গোলাম মনজুর ছিদ্দিকী, এ. এস. সি, উপস্থিত থাকবেন বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
স্মৃতিচারণ সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে রামু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান,রিয়াজ উল আলম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাঃ শাজাহান আলি, রামু থানা অফিসার ইনচার্জ প্রভাষ চন্দ্র ধর, ফতেঁখারকুল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম উপস্থিত থাকবেন।
এছাড়া সমগ্র অনুষ্ঠানে বহু প্রাজ্ঞ ভিক্ষুসংঘ এবং বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, প্রয়াত ফকির চাঁদ বড়ুয়া ও বেনু বালা বড়ুয়ার তিন পুত্র ও চার কন্যার মধ্যে রত্নপ্রিয় ভিক্ষু (বঙ্কিম চঁন্দ্র বড়ুয়া) ছিলেন ৪র্থ সন্তান। ফকির চাঁদের জন্ম ও আবাস ভূমি খরুলিয়া হলেও জীবনের প্রয়োজনে তিনি ১৯৩১ সালে তার পরিবার ও তিন সন্তানদের নিয়ে রামুর উখিয়ারঘোনায় স্থানান্তরিত হন। সেখানেই ১৯৩৪ সালে বঙ্কিম চঁন্দ্র বড়ুয়া (রত্নপ্রিয় ভিক্ষু) জন্ম গ্রহণ করেন। ভাই বোনদের মধ্যে তিনি সবার মেঝ। জানা যায়, চন্দ্র মাসের ২য় তিথিতে জন্ম গ্রহণ করেন বলেই পিতামাতা পুত্র সন্তানের নাম রাখেন বঙ্কিম চন্দ্র।
উখিয়ারঘোনা টেইলা পাড়া মক্তবে শুরু হয় তার বর্ণ পরিচয়। এর বছর দু-এক পর রামু খিজারী এটাস্ট প্রাইমারী স্কুলে (বর্তমান রামু প্রাইমারী স্কুল) ভর্তি হন। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯৫৯ সালে রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে Matriculation পাস করে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর নারিজহাট কলেজে ভর্তি হন।
১৯৬১ সালের দিকে তার পিতা ফকির চাঁদ বড়ুয়ার অ-দূরদর্শীতার কারণে প্রায় ৩০ কানি কৃষি জমি হারিয়ে আর্থিক কষ্টে পতিত হন। এর ফলে পড়ালেখার ইস্তফা দিয়ে নিজেকে আয়মূলক কাজে নিয়োজিত করতে হয়।
১৯৬১ সালের ১০ জুন A K Khan Plywood co. Ltd. Chittagong- খন্ডখালীন Time Keeper হিসেবে চাকরি শুরু করেন।
১৯৬৪ সালের ২০ মে উক্ত কোম্পানিতে পূর্ণকালীন Time Keeper হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এবং ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৫ সালে কক্সবাজার থানাধীন ঝিলংজা ইউনিয়নের সীতানাথ বড়ুয়া (মহাজন) এর কনিষ্ঠ কন্যা মেথিলা বড়ুয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৬৬ সালে ৩ জানুয়ারি তিনি কর্মস্থল পরিবর্তন করে SANGU VALLEY TIMBER INDUSTRIES LTD এর দোহাজারী কারখানায় Time Keeper হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তি যুদ্ধের প্রায় মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ ক্রমেই বেগবান হচ্ছিল। পাকিন্তানীদের নির্যাতনও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একদিন তিনজন স্বশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে এসে পাকিস্তানীরা তাঁর কারখানায় বন্ধী করে রাখেন। ঐ দিন রাতে তিনি সেই মুক্তিযোদ্ধাদের ছেড়ে দেন এবং কারখানার চাকরি ত্যাগ করে পালিয়ে আসেন।
যুদ্ধকালীন সময়ে বাড়ি ফিরে এসে কৃষি কাজ শুরু করেন। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাউয়ারখোপ ইউনিয়ন পরিষদে ইউনিয়ন সচিব হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন।
পরে ১৯৮৫ সালে রূপালি ব্যাংকে Agriculture Field Assistant হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৯ সালে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে রামু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সর্বশেষ ২০০২ সালে তিনি বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
এরপর থেকে তিনি সামাজিক এবং ধর্মীয় কাজে বেশি জড়িয়ে পড়েন। ২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি রামু সীমা বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথের’র শিষ্য হিসেবে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন এবং পরের দিন ৩ জানুয়ারি উপসম্পদা লাভ করে রত্নপ্রিয় ভিক্ষু নাম ধারণ করেন।
রামু সীমা বিহারে আবাসিক ভিক্ষু হিসেবে এক বর্ষাবাস এবং কক্সবাজার পশ্চিম ঝিলংজা আর্য্য বিহারের বিহারাধ্যক্ষ হিসেবে দুই বর্ষাবাস যাপন করেন।
২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর তাঁর মরণ ব্যাধি লিভার সিরোসিস ও ক্যানসার সনাক্ত হয়। ঢাকা ও ইন্ডিয়ার ঞঅঞঅ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেয়া হলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তাঁর জীবনের সময় সীমা নির্ধারণ করে দেন সর্বোচ্চ চার মাস।
দু’মাস শয্যাশায়ী অবস্থায় কাটানোর পর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ খ্রি: রোজ সোমবার সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে রামু মৈত্রী বিহারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর শবদেহ ধর্মীয় মর্যাদায় পেটিকাবদ্ধ করা হয়।