ড. জিনবোধি ভিক্ষু
মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে বিশ্বে যত ধর্ম বলি আর দর্শন বলি, সব কিছুর মূলে লক্ষ্য হল-এই মানবজীবন-ন্যায়, সততা, সুন্দর, মঙ্গল ও কল্যাণপুষ্ট মানবজীবন।
জ্ঞানী-গুণী-সাধক, তপস্বী এবং আত্মত্যাগী যে সকল ধর্মীয় প্রবক্তা ও মহামনীষীগণ এই ধরাধামে জন্ম নিয়ে পৃথিবীকে জ্ঞানালোক এবং নৈতিক চেতনায় ধন্য করেছেন তাঁরা সকলেই মুক্ত-চিন্তা-চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ এবং গুণী মানুষের মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন।
সাম্য, মৈত্রী, প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, সমদৃষ্টি এবং সমবণ্টনের ইত্যাদি মানুষের মানবতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে মানুষের প্রকৃত কল্যাণ নিহিত এবং মানবতার বাতাবরণের পরিবেশ তৈরি করা। বিবেকবান,আত্মসচেতন এবং বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ মাত্রই এইসব কার্যক্রমে ভূমিকা রাখার প্রয়াসী হলে পরিবার, সমাজ, দেশ, জাতি এবং সমগ্র বিশ্ব সুন্দর ও আদর্শ জীবনধারায় ফিরে আসবে।
একবিংশ শতাব্দীতে এটাই প্রতিটি মানুষের অন্তরের প্রত্যাশা। মানবতাবাদী বৌদ্ধভিক্ষু ধর্মপ্রিয় মহাস্থবির সেই মানবিক আদর্শের একজন পুণ্যপুরুষ। তিনি পারিবারিক বিষয়-বাসনা, মায়ামোহ ত্যাগ করে আত্মত্যাগী ব্রহ্মচারীব্রত গ্রহণ করে বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজ এবং অসাম্প্রদায়িক একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে সদা-সর্বদা মানুষ ও মানবতার কল্যাণে সেবা করে চলেছেন।
একদিকে জ্ঞান সাধনা এবং তপচর্যা অন্যদিকে বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়-এই অমিয় শান্তির বাণী প্রচারে আত্মোৎসর্গকৃত জীবন-যাপন করে সর্বজনশ্রদ্ধেয় আসন লাভে কৃতার্থ।
তাছাড়া ব্রহ্মচর্য জীবনের বড়গুণ গরিব-দুঃখী এবং শিক্ষার আলো বঞ্চিত ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার উন্নয়নে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে যাওয়া। সমাজের বহু বিদ্যার্থীকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিসহ বিদেশ থেকে পি-এইচডি ডিগ্রি অর্জনে তাঁর সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা সত্যিই প্রশংসনীয়।
মূলত বৌদ্ধভিক্ষুর জীবন মানবকল্যাণ ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জীবন। মানবতাবাদী ধর্মপ্রিয় প্রায় ৬৪ বছর ব্রহ্মচর্য জীবনে ভারত-বাংলা এবং বহির্বিশ্বে গিয়ে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার দৃষ্টান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এদেশে কয়েকটি সেবামূলক পুণ্যতীর্থ তৈরি করে সমাজ ও জাতিকে উপকৃত করেছেন।
আমরা যদি এই নিবেদিত প্রাণ মানবকল্যাণ কর্মী,কর্মযোগী এবং জ্ঞানতাপস ধর্মপ্রিয়ের নৈতিক আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করি, সমাজ ও জাতি সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে। সম্প্রীতি, ভালবাসা ও মানবিক চেতনায় দেশ উন্নত হবে।
চট্টগ্রাম স্মরণাতীত কাল পুণ্যভূমি নামে খ্যাত। সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক বড় বড় সাধু,সন্ত,পীর-দরবেশ, ব্রহ্মচারী এবং পূত চরিত্রের মহান মনীষীদের জন্মে ধন্য চট্টগ্রাম। তাঁদের কল্যাণস্পর্শে দেশ ও জাতি এখনও শান্তি-সুখের পরশে মহিমান্বিত। ভবিষ্যতে আরো অসংখ্য মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক পূত চরিত্রের মহান ব্যক্তিত্বদের আগমন খুবই প্রয়োজন।
আজ সেই মানবতাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু ধর্মপ্রিয়ের ৮৪ তম হীরকজয়ন্তী মহোৎসব। একজন মানুষ যদি সমাজ, দেশ ও জাতির সার্বিক মঙ্গল ও কল্যাণে কিছু কাজ নিঃস্বার্থভাবে করার চেষ্টা করে থাকেন তাহলে তাঁর মানবিক কর্মের স্বীকৃতি এবং মূল্যায়ন এসে যায়। এর জ্বলন্ত উদাহরণ স্বয়ং ধর্মপ্রিয় মহাস্থবির। ইতিমধ্যে এই পুণ্যপুরুষ শ্রমণ, ভিক্ষু, স্থবির, মহাস্থবির এবং উপসংঘরাজ পদমর্যাদা প্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মচর্য জীবনের যথাযথ সম্মান ও গৌরব লাভ করেছেন।
আজ তাঁর ৮৪ তম হীরক জয়ন্তী উৎসব সামগ্রিকভাবে ব্রহ্মচর্য জীবনের যথার্থ স্বীকৃতি বলা যায়। জন্মদাতা পিতা দুর্যোধন,গর্ভধারিণী মাতা শান্তিবালা বড়ুয়া ধন্য ও সম্মানিত। বর্তমান সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে তাঁর মত একজন গুণী ও আদর্শ ব্রহ্মচারী বিরল। জয় হোক মানবতার। আজ তাঁর হীরক জয়ন্তী উৎসবে শতকোটি প্রণাম।
লেখক : প্রফেসর ও সভাপতি, পালি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়