মাহজাবীন জুন
এই পৃথিবীতে কত রকম বিস্ময়ই যে আছে তা হয়তো আপনি আঙ্গুলের কড় গুনেও শেষ করতে পারবেন না। এর মাঝে কোনোটা হলো মানুষের তৈরি, আবার কিছু প্রকৃতি তার নিজ হাতে, নিজের খেয়ালখুশীতে রচনা করেছে। আজ প্রকৃতি নয় মানুষের তৈরি তেমনি এক অবিস্মরণীয় কীর্তির কথা বলবো যা দেখার সৌভাগ্য হলো আমার গত ১৯ এপ্রিল ২০১৫ মিয়ানমারের পুরনো রাজধানী মান্দালেতে।
এই বিস্ময়কর সৃষ্টির স্রষ্টা হলেন মিয়ানমারের (বার্মা) শেষ উল্লেখযোগ্য রাজা মিন্দন। “The world’s largest book” অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে বৃহদাকার এবং ব্যতিক্রমী বইটি নির্মাণ করে তিনি সারা বিশ্বে অমর হয়ে আছেন।
মান্দালের কিংস প্যালেস ঘুরে ঘুরে দেখার সময় আমার স্বামী দু’এক বার গাইড মিজ ট্যান্ডাকে প্রশ্ন করছিলেন বইটি দেখাতে আমাদের কখন সে নিয়ে যাবে? আমি একটু বিরক্তই হচ্ছিলাম। যদিও আমি ভীষণ বই ভালোবাসি। কিন্ত এখন যখন সুন্দর এই রাজকীয় প্রাসাদ দেখছি তখন এর মাঝে আবার বই দেখার কি হলো?অন্যান্য বার কোথাও ঘুরতে গেলে আগে থেকে কি কি দেখবো তার পুরোপুরি একটা ধারণা নিয়ে যাই। কিন্ত এবার যাবার আগে নানা রকম পারিবারিক সমস্যায় তাদের পাঠানো ভ্রমণসূচিটা আমার দেখা হয়নি। তাই এই বইটির ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই ছিল না। অবশেষে কিংস প্যালেসের পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে যখন বই দেখতে রওনা হলাম তখন শুনলাম আমরা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বিশালাকার একটি বই দেখতে যাচ্ছি।
শুনে মনে হলো এটি আবার কেমন বই, পাতাগুলো কিভাবে সাজানো, কত প্রকাণ্ড, কিভাবে তা মানুষ পড়ে? কোথায় রেখেছে? কোন লাইব্রেরিতে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরপাক খেতে লাগলো।
অবশেষে হাজির হলাম আমাদের গন্তব্যে। মাঝখানে স্বর্ণালী এক মন্দির আর তার চারিদিক ঘিরে সাদা সাদা ছোট ছোট অজস্র শ্বেত শুভ্র ঘরগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে হাত ছড়িয়ে গাইড ট্যান্ডা বলে উঠলো, ‘দেখো এই হলো বিশ্বের বৃহদাকার বই ‘। বইয়ের এই রূপ দেখে আমরা সত্যি বিস্মিত হয়ে গেলাম।
গাইড মিস ট্যান্ডা আমাদের ধাতস্থ হওয়ার সময় দিয়ে থেমে থেমে শুরু করলো এই অত্যাশ্চর্য বইটির ইতিহাস। বিখ্যাত মান্দালে শহরের গা ঘেঁষেই ইতিহাস বিখ্যাত মান্দালে পাহাড়, সেই পাহাড়ের পাদদেশেই রয়েছে রাজা মিন্দনের তৈরি বিখ্যাত কুথোদ বৌদ্ধ বিহার। সেই বিহারকে কেন্দ্র করে চারপাশের বিশাল জায়গা জুড়ে সারিবদ্ধভাবে নির্মিত ছোট ছোট সমান মাপের ৭৩০টি শ্বেত শুভ্র ছোট ছোট আকৃতির মন্দির, যাকে গাইড Dhamma ceti or kyauksa gu বলছিল।
আর এই ৭৩০টি মন্দিরের ভেতরেই রয়েছে ১৫৩/১০৭ সে.মি. মাপেরএকটি করে শিলা পাথর বা শিলাপাতা যার উভয়দিকে প্রাচীন “পালি” ভাষায় খোদাই করা হয়েছে ত্রিপিটকের তিনটি অংশ যথাক্রমে সুত্তা পাটিকা, ভিনায়া পাটিকা এবং অবিধাম্মাপাটিক। এতে রয়েছে ২০০০ বছর আগে মানবজাতির উদ্দেশে লেখা গৌতম বুদ্ধের সমস্ত বাণীগুলো। ৭৩০টি মন্দিরে ৭৩০টি শিলাপাতায় লেখা মোট ১৪৬০ পৃষ্ঠার এই বৃহদাকার বই যা সত্যি বিস্ময়কর।
পাথরে খোদাই করা এই শিলাপাতাগুলো ৫ ইঞ্চি মোটা যাতে এটা আপনাআপনি সোজা হয়ে থাকতে পারে। মন্দির নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা মার্বেল পাথরগুলো ৩০ মাইল দূর থেকে ইরাবতী নদী দিয়ে ভেলায় করে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল।
মান্দালে ছিল সেসময় বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) রাজধানী। ১৮৬০ সালে রাজা মিন্দনের নির্দেশে বইটির কাজ শুরু হয়ে আর এটি শেষ করতে সময় লেগেছিল ৮ বৎসর। তারপর সবাই যাতে বইটি পড়তে পারে তার জন্য উন্মুক্ত করা হয় ১৮৬৮ সালে।
লেখাগুলো নেয়া হয়েছিল শুকনো তাল পাতায় লিখা প্রাচীন পাণ্ডুলিপি থেকে। শত শত পাথর শিল্পী নিযুক্ত ছিল পাথরগুলোকে মাপমতো কাঁটা এবং খোদাই করার কাজে। আর একশ’রও বেশি সংখ্যক ভিক্ষু দিনের পর দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তদারকী আর সম্পাদনা করেন পাথর শিল্পীদের খোদাই করা লেখাগুলোকে।
শুরুতে পাথরে খোদাই করা বুদ্ধের বাণীগুলো সোনার কালি দিয়ে লেখা হয়েছিল। মূল্যবান রত্নের দেশ মিয়ানমারের খনিতে উৎপাদিত হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রত্ন চুনি, নীলা, জেড ছাড়াও অন্যান্য স্বল্প দামী পাথর। তাই তাদের ঐতিহাসিক স্থাপত্যে অলংকরণের জন্য এসব চুনী পান্নার বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এমন কি এই বিশালাকার বইটির প্রতিটি শিলাপাতার উপরের দিকে লাগানো ছিল একটি করে বড় আকারের রত্নখণ্ড।
১৮৮০ সালে বৃটিশরা বার্মা দখল করলে অন্যান্য অনেক দামী দামী জিনিসের সাথে এই বইয়ের পাতা থেকেও চুরি করে নেয় রত্ন আর স্বর্ণ। সেই সাথে এর যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে। পরবর্তীতে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বইটি আবার মেরামত করা হয়ে। তবে চুরি যাওয়া রত্নগুলো ফিরিয়ে আনা যায়নি। এখন লেখাগুলো আর স্বর্ণের কালিতে লেখা নয়, সাধারণ কালো রঙের কালিতে লেখা।
কুথোদ মঠ প্রাঙ্গণে বইয়ের এক একটি পাতার জন্য নির্মিত মন্দিরগুলোর চুড়ো যাকে তারা ছাতা বলে থাকে, তা ছিল সব স্বনির্মিত। এখন অন্য ধাতুর উপর সোনালী রঙ করা হয়েছে।
সারি সারি সাজানো বইয়ের পাতার মন্দিরগুলোর মাঝখান দিয়ে চলাচলের জন্য রয়েছে সুপরিসর রাস্তা। প্রতিটি মন্দিরের চারদিকে খিলানাকৃতির জানালা যাতে রয়েছে লোহার শিকের গরাদ। তবে বইয়ের পাতা থেকে বুদ্ধের বাণীটি যাতে কাছ থেকে পড়া যায় তার জন্য সামনের এবং পেছনের দিকের লোহার গরাদ দুটো দরজার মত খোলা যায়।
চারিদিক খোলা থাকায় সেই বইয়ের মন্দিরের ভেতর ঢেউ খেলে যায় পাশের ১২১ বছরেরও পুরনো বিশাল বিশাল বকুলগাছ থেকে ফুলের সুবাস নিয়ে ভেসে আসা বাতাস। প্রচুর আলো বাতাসের পাশাপাশি আপনিও দরজা খুলে প্রবেশ করে পুরো পাতাটি কাছ থেকে পড়তে পারবেন। অর্থাৎ এই বই শুধু দূর থেকে চোখে দেখার জন্য নয়, এর ব্যবহার ও যেন সবাই করতে পারে সে ব্যবস্থা করেছিলেন দূরদর্শী রাজা মিন্দন ।
উল্লেখ্য, রাজা এই বইতে তার নিজের সম্পর্কে কিছুই বর্ণনা করেনি যা ছিল সেই যুগ এমনকি বর্তমান সময়ের জন্যও ব্যতিক্রম একটি ঘটনা । শুধু ৭৩০তম শিলাপাতাতে লেখা আছে বিশ্বের বিস্ময় এই বইটির নির্মাণ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ ।
রাজা মিন্দন বই পড়তে ভালবাসতেন। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তিনি দীর্ঘস্থায়ী কিছু রেখে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন সাহিত্য হচ্ছে সমাজে জ্ঞান বিকাশের জন্য রেখে যাওয়ার একটি শক্তিশালী মাধম। কিন্তু কাগজের পাতায় লিখা বই বেশিদিন টেকে না। রাজা মিন্দন চেয়েছিলেন তিনি যে বইটি সৃষ্টি করবেন তা যেন কমপক্ষে ৫ হাজার বছর টিকে থাকে। এরই ফলে পাথরের পাতায় বুদ্ধের বাণী লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন যা কিনা ৫ হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে।
এখন পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ ছাড়াও হাজার হাজার পর্যটক বিশ্বের এক বিস্ময়্কর কীর্তি দেখার জন্য এখানে ছুটে আসে। ইউনেস্কো এই ব্যতিক্রমী বইটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণা করেছে। স্থানটিও যথেষ্ট সুরক্ষিত। বিরাট কোন বিপর্যয় না ঘটলে বইটি হয়তো ৫০০০ বছর এভাবেই থাকবে এবং রাজা মিন্দনের স্বপ্ন পূরণ হবে।