ভদন্ত প্রজ্ঞাশ্রী ভিক্ষু
পূর্বরত্ন মৈত্রী বিহার কক্সবাজারের উখিয়া রত্না পালং ইউনিয়ন অন্তর্গত একটি বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। সূত্রমতে, ১৯৯১ সালে বিহারটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৯৯৫ সালের দিকে স্থানীয় এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিদর্শন পরবর্তী বিহারটি দ্বিতল ও সেমিপাকা করা হয়। মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধের আদর্শে পরিচালিত পূর্বরত্ন মৈত্রী বিহার স্থানীয় বৌদ্ধদের ধর্মচর্চা, প্রশান্তির বাতাবরণ ছড়িয়ে দেওয়া ও জন মানুষকে কল্যাণের পথে জীবন পরিচালনায় অনুপ্রেরণা, দিক নির্দেশনা প্রদানের পাশাপাশি বিহারটির কাঠের সুন্দর কারুকাজ যা বৌদ্ধিক ঐতিহ্যকে লালন করে আসছে। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হল, গত ২৮ জানুয়ারী, ২০১৭ রাত ৮ টার দিকে ভয়াবহ এক অগ্নি দুর্ঘটনায় বিহারটি ভস্মীভূত হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক ধারণা মতে, অাগুনের সূত্রপাত বিহারে প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি হতে হয়েছে বলে জানা যায়। সেসময় বিহারাধ্যক্ষ শ্রীমৎ জ্যোতিমিত্র ভিক্ষু এক দায়কের বাড়িতে পরিত্রাণ পাঠে নিয়োজিত ছিলেন। দ্রুতই আগুনের লেলিহান শিখা গোটা বিহারে ছড়িয়ে পড়ে। এক এক করে ভস্মীভূত হয় বৌদ্ধিক নানা ঐতিহ্য, মূল্যবান পুঁথি-গ্রন্থ, ভিক্ষুসংঘের আসবাবপত্র, পাত্র-চীবর, বিহার উন্নয়নে দায়কদের দানকৃত অর্থ-দানবক্স সবই। পরে গ্রামবাসী ও প্রশাসনের যৌথ প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও ততক্ষণে বিহার পুরোপুরিই ভস্মীভূত। অবশিষ্ট ছিলনা বিহার ঐতিহ্যের কোন কিছুই।
নিকট অতীতে এমন একটি ঘটনা গত ২২ জানুয়ারী, ২০১৪ সালেও ঘটে। সেসময় ভস্মীভূত হয় সদ্ধর্ম বিদর্শন ভাবনা পরিবেণ, যেটি চন্দনাইশ পৌরসভার পূর্ব জোয়ারায় অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ ভাবনা কেন্দ্র। ভাবনা কেন্দ্রের পরিচালক ভদন্ত জিনপাল ভিক্ষুর মতে, বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ভাবনা প্রশিক্ষণার্থী এক শ্রমণ চৌকির উপর মোমবাতি জ্বালায় এবং পরে বিদ্যুৎ আসলেও তা না নেভানোতে এ ঘটনা ঘটে। পুরো ভাবনা কেন্দ্রে আগুন জ্বলে মুহূর্তে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মূল ভাবনা কেন্দ্র, হল ঘর, গেস্ট রুম, স্টোর রুমসহ পুরো প্রতিষ্ঠানটি ভস্মীভূত হয়। ফলে বুদ্ধমূর্তিসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই-পান্ডুলিপি ও ভাবনাকারীদের দানকৃত অষ্টউপকরণাদি সব মিলিয়ে ২৫ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ভাবনা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়।
এভাবে বারংবার বৌদ্ধ বিহার আগুনে দাহ্য হওয়া মোটেও বৌদ্ধদের জন্য সুখবর কিংবা সুলক্ষণ নয়। তদুপরিও আমরা বৌদ্ধরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে কেন যে… পিছপা হই, বুঝা বড় দায়! এসব অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা দেখেও যদি আমরা না শিখি, তবে বলতে হয় সম্মুখে এমন অনাহুত আরো অনেক বিপদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে! আর যদি আমরা এসব হতে পরিত্রাণ পেতে চাই তবে সময় থাকতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরী।
মোমবাতি প্রজ্বলনে সতর্ক হোনঃ
আমাদের দেশে মূলগন্ধ কুটিরে যেভাবে মোমবাতি জ্বালানো হয়, এতে যেকোন সময় এ ধরণের বিপদ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, বর্তমানে কিছু কিছু বিহারে মোমবাতি জ্বালানোর জন্য আলাদা বেদি/আসন বিহারের একপার্শ্বে করা হয়েছে। আমার মতে, এ উদ্যাোগটি প্রত্যেক বিহারে গ্রহণ করলে ভালো হয়। মুলগন্ধ কুটিরে বিপদজনকভাবে মোমবাতি না জ্বালিয়ে বিহারের আঙিনার একপার্শ্বে কিংবা বিহারস্থ উন্মুক্ত কোন স্থানে মোমবাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করলে এ ধরণের আকস্মিক বিপদ হতে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সেসাথে পূণ্যার্থী উপাসক-উপাসিকাদেরও মোমবাতি প্রজ্জ্বলনে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
আলোক পূজাঃ
পূজা-পার্বণ এবং আমাদের বিবিধ প্রত্যাশার পূর্ণতা বা প্রার্থনার সময় আমরা প্রদীপ, হাজার তৈল প্রদীপ/মোমবাতি প্রজ্বলনের মধ্যদিয়ে আলোক পূজা করে থাকি। এ প্রদীপ পূজার পাশাপাশি আলোক পূজা হিসেবে আমরা বিহারে বাল্ব, চার্জলাইট, বৈদ্যুতিক জেনারেট/সোলার প্যানেল/আইপিএস (যা বিদ্যুৎ না থাকা কালীন সময়ে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে সক্ষম) ইত্যাদি দান করতে পারি। এমনকি ভিক্ষু সংঘদের আহারাদি চতুর্প্রত্যয় দানের পাশাপাশি বিহার উন্নয়নে স্থায়ী দানে আমাদের আরো বেশী উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
অবিরাম পূণ্যবর্দ্ধনশীল দানঃ
জগতে এমন ছয় প্রকার কুশল কর্ম আছে, যা সম্পাদন করলে, সেই দাতার দিবা-রাত্রি অবিরাম পূণ্য বৃদ্ধি হয়। সেই অবিরাম পূণ্যবর্দ্ধনশীল দানের শ্রেষ্ঠতম দান হল “বিহার নির্মাণ করা”। বিহার নির্মাণে সহায়তা করা বলতে অতীত, বর্তমান এবং অনাগত এ ত্রিবিধ সংঘকে রক্ষণাবেক্ষণ করা বুঝায়। পাশাপাশি কেউ যদি অনাগত আর্যমৈত্রেয় বুদ্ধের সাক্ষাৎ লাভ করতে ইচ্ছা পোষণ করেন, এতে বিহার নির্মাণের পূণ্যরাশি আপনাকে এগিয়ে রাখবে।
কাল দান অর্থাৎ প্রয়োজন অনুসারে দানঃ
কালে দদন্তি সপ্পঞ্ঞা বদঞ্ঞূ বীতমচ্ছরা,
কালেন দিন্নং অরিযেসু, উজুভূতেসূ তাদিসু,
বিপ্পসন্নমনা তস্স বিপুলা হোতি দক্খিণা।
অর্থাৎ, বদান্য বা দানশীল, মাৎসর্য্য মলহীন ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি যোগ্য কালে দান দিয়ে থাকে। কায়, বাক্য ও চিত্তের বক্রতাহীন তাদৃশ আর্য্যগণকে প্রসন্নমনে (পূর্ব, অপর ও মোচ্চন চেতনা) দান দিলে তার দানের ফল বিপুল হয়।
বর্তমান ভস্মীভূত হওয়া পূর্বরত্ন মৈত্রী বিহারর পুনঃনির্মাণের মাধ্যমে কালদান করার সুযোগ আছে। কালদান অর্থাৎ প্রয়োজনের সময় দান দিয়ে আমরা ভস্মীভূত বিহারকে নতুনভাবে, নতুনসাজে পুনঃনির্মাণে আর্থিক, কায়িক, বাচনিক, মানসিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতার মধ্যদিয়ে অপ্রমেয় পূণ্য সঞ্চয় করতে পারি।
“বিহার” আমাদের উপাসনালয়। এটি দেব-মনুষ্য কর্তৃক পূজিত। আবার এই বিহারই অন্যদের কাছে আমাদের পরিচিতি তুলে ধরে। সুতরাং, বিহারের রক্ষণাবেক্ষণ, বিহারের পরিচর্যা, ভিক্ষু-শ্রামণ সংঘের পরিচর্যা এবং বিহারের সর্ব প্রকার উন্নয়নে আমাদের আরো বেশী আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। পরিশেষে, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সকল সচেতন নাগরিকদের প্রতি বিনীত অনুরোধ ঐক্যতা এবং দানময় চিত্তে একাত্মতা পোষণ পূর্বক ভস্মীভূত পূর্বরত্ন মৈত্রী বিহার পুনঃনির্মাণে এগিয়ে আসুন। বিহার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিহার সুরক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ করুন।
প্রজ্ঞালোক ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।
জয় হোক বুদ্ধ শাসনের।