ব্রাত্য বসু লিখেছেন ‘অনুসোচনা’। জানালেন, পালি ভাষায় এই নামকরণ। অর্থ যদিও এক। বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় যে নাটকের প্রিমিয়ার ‘প্রাচ্যে’র নাট্য উত্সবে, ২৬ জানুয়ারি। ‘সুপারি কিলার’ বা ‘অশালীনে’র (রিমেক) পর ফের একসঙ্গে নাটককার-নির্দেশক জুটি।
এমনও হতে পারে? গৌতম বুদ্ধ- অর্থাত্ যুক্তিনিষ্ঠ জ্ঞান এবং মহাবোধীর ‘কালমিনেশনে’ যে ইমেজের সংজ্ঞা। তাঁকে নিয়ে থ্রিলার কেমনভাবে? অথচ বৌদ্ধধর্মের বাহ্যিক ইমেজটাকে পেরিয়ে যদি একটু গভীরে ঢোকা যায়, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি-পাওয়ার স্ট্রাগ্লের একটা আখ্যান পাওয়া যায়, যে আখ্যান আসলে হতে পারে যে কোনও প্রতিষ্ঠানের। গৌতম বুদ্ধের যে ধর্মাচরণ- তাতে বৌদ্ধ চিন্তনই একমাত্র সত্য। বৌদ্ধ চিন্তন, অর্থাত্ ক্ষমা, সহনশীলতা, বিনয়, জ্ঞানের স্ফূরণ। কিন্তু তার উল্টোদিকেই তো রয়েছে জীবনবৃত্তের ছাপোষা চাহিদাগুলো! সুতরাং সংঘাতের রাস্তা বেশ চওড়া। যে সংঘাতে একপক্ষ যদি বুদ্ধ স্বয়ং হন, আরেকপক্ষ হবেন দেবদত্ত।
গৌতম বুদ্ধ তাঁর ধর্ম প্রচারের জায়গা থেকে বরাবরই এক অনুশাসন বজায় রেখেছিলেন- বৌদ্ধভিক্ষুর কোনও জাত হয় না। কোনও আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে না, শুধু জ্ঞানপিপাসা ছাড়া। কিন্তু দেবদত্ত লোভ-হিংসায় মগ্ন মানুষদের মতো আকৃষ্ট ছিলেন বহিরাঙ্গে। বৌদ্ধ ধর্মের ওই ‘ইমেজ’টাই তাঁর কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। সারসত্য নয়। এবং সেই ‘ইমেজে’র ধারণায় আটকে নিজেকে বড় ভিক্ষু প্রমাণ করাই হয়ে ওঠে দেবদত্তের ‘মোক্ষ’। প্রায় একই সঙ্গে বেড়ে উঠে, কাছের বন্ধু হয়েও সিদ্ধার্থ তাঁর চেয়ে এতদূর এগিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছেন, মেনে নিতে পারেননি ঈর্ষান্বিত দেবদত্ত। তাঁর চাই যশ, প্রতিপত্তি। চাই বুদ্ধকে সরানোর জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র! বুদ্ধের পৃষ্ঠপোষক রাজা বিম্বিসারকে বন্দি করাতে রাজপুত্র অজাতশত্রুর সঙ্গে জোট বাঁধেন তিনি। রাজা হয়ে অজাতশত্রুর ক্ষমতার উপর ভর করেন দেবদত্ত, সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছোড়েন বুদ্ধের সামনে- সংঘের দায়ভার ছেড়ে দিতে হবে তাঁর হাতে। বুদ্ধ অরাজি হলে তাঁকে মেরে ফেলার একের পর এক ছক কষতে শুরু করেন দেবদত্ত। শেষ জীবনে অবশ্য বুঝতে পারেন নিজের ভুল। দগ্ধ হন তীব্র অনুশোচনায়।
এই জায়গা থেকেই ব্রাত্য বসু লিখেছেন ‘অনুসোচনা’। জানালেন, পালি ভাষায় এই নামকরণ। অর্থ যদিও এক। বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় যে নাটকের প্রিমিয়ার ‘প্রাচ্যে’র নাট্য উত্সবে, ২৬ জানুয়ারি। ‘সুপারি কিলার’ বা ‘অশালীনে’র (রিমেক) পর ফের একসঙ্গে নাটককার-নির্দেশক জুটি। দলের নাট্যোত্সবে একটি শো’য়ের জন্য বিপ্লব ব্রাত্যের লেখা ‘মৃত্যু
বিপ্লব বলছিলেন, ”আমার মতে, নাটকটা বুদ্ধের সঙ্গে দেবদত্তের আদর্শগত লড়াইয়ের চেয়ে দু’জনের ব্যক্তিগত সংঘাত নিয়ে। নাটকে দেবদত্ত যে নেহাত একজন খলচরিত্র, তা নয়। তিনি ক্ষমাপ্রার্থী নিজের কৃতকর্মের জন্য। কিন্তু দেবদত্ত এটাও মনে করতেন, বুদ্ধের সংঘারামে তার যে জায়গা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা পাননি। ফলে তিনি ওই সংগঠন ছেড়ে বেরিয়েও যান। তারপর থেকেই শুরু হয় তাঁর ঈর্ষা। বুদ্ধের নামে অপপ্রচার, কুত্সা, খুনের চক্রান্ত- সবকিছুই চালিয়ে যান তিনি। রিপুর প্রভাবে দুর্বল হয়ে পড়া মানুষ বলা যেতে পারে দেবদত্তকে।”
এখান থেকেই স্পষ্ট, গল্পে থ্রিলার এলিমেন্ট যথেষ্ট। শেষ পর্যন্ত সেই থ্রিলারের গতি কোন মাত্রায় পৌঁছে সুরাহা করবে দ্বন্দ্বের, সেই আন্দাজ দর্শক পাবেন পারফরম্যান্সের দিনে। কিন্তু এখান থেকে গল্পের উড়ান যায় অন্য আকাশে। বুদ্ধের কাছে ক্ষমা চাইতে এলেও চিরক্ষমাশীল বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা বুদ্ধ ক্ষমা করেন না দেবদত্তকে। এখানেই কি তৈরি হয় একটা অন্য ক্রাইসিস- দেবদত্ত বা বুদ্ধ দু’জনেরই ‘লিমিটেশন’, সীমাবদ্ধতা? নিজের থেকে উত্তীর্ণ হয়ে দেবদত্তকে ক্ষমা করতে পারেননি বুদ্ধ। আবার দেবদত্তও যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন, ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ব্রাত্য বললেন, ”বুদ্ধ কেন ক্ষমা করতে পারেননি, সেটা আমি বলতে পারব না। কিন্তু এটাকে আমি ঠিক লিমিটেশন বলব না। এই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা বা খুনের ছক- এর মধ্যে একটা চিরন্তনী উপাদান আছে। এর মধ্যে একটা ঘোরতর রাজনীতি আছে। এবং আশা করছি, বিপ্লবের মুনশিয়ানায় নাটকটা একটা আলাদা মাত্রায় পৌঁছবে।”