শামসুদ্দোহা চৌধুরী
চীনের সঙ্গে প্রাচীন বাংলার সম্পর্ক হাজার বছরেরও অধিককাল পেরিয়ে গেছে। ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্রে এর প্রমাণ মেলে। বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন, গৌতমবুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র স্থানগুলো দর্শন, বৌদ্ধশাস্ত্রের প্রাচীন গ্রন্থ চীনা ভাষায় অনুবাদকরণ, তীর্থ ভ্রমণ, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত, সিদ্ধাচার্যদের সঙ্গে ভাব বিনিময়, উপমহাদেশখ্যাত বৌদ্ধ বিহারগুলো দর্শন, চীনের সঙ্গে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য খ্রিপূর্ব কাল থেকেই চলে আসছিল। সপ্তম শতাব্দীতে চীনের বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত হিউয়েন সাং এসেছিলেন বাংলায়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধের পবিত্র স্মৃতিগুলো দর্শন, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিতদের সঙ্গে বৌদ্ধশাস্ত্রের নিগূঢ় তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা, উপমহাদেশখ্যাত বৌদ্ধ বিহারগুলো পরিদর্শন, অধ্যয়ন, চীনা ভাষায় গ্রন্থ অনুবাদের মাধ্যমে হিউয়েন সাং বাংলা ও চীনের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের এক নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন।
এরও আগে ৪১০ খ্রিষ্টাব্দে ফা হিয়েন এসেছিলেন বাংলায়। তিনি সে সময়ের বাংলার আন্তর্জাতিক বন্দর ‘তাম্রলিপ্তের’ উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন। এই বন্দরের মাধ্যমে বাংলার বিখ্যাত বস্ত্র, চিনি, মশলা, চাল সিংহল, সুমাত্রা, জাভা, মালয় ও ইন্দোচীনে রফতানি হতে দেখেছেন। হিউয়েন সাং আসার আরও একশ’ বছর আগে আরেক বৌদ্ধ পণ্ডিত ইৎসিঙ এসেছিলেন বাংলায়। তিনি মূলত নালন্দা মহাবিহারে অধ্যয়ন এবং অনুবাদকাজে লিপ্ত ছিলেন। হিউয়েন সাংও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালি অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকদের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন তান্ত্রিক শাস্ত্র অধ্যয়নে, অনুবাদে এই বিহারে দীর্ঘদিন কাটিয়েছিলেন।
নালন্দা মহাবিহার ছাড়াও তিনি বগুড়ার পুন্ড্রবর্ধন (মহাস্থানগড়) ভাসু বিহার, বিক্রমপুরের বিক্রমশীল বিহার, কর্ণসুবর্ণ, রক্তমৃত্তিকা ও পাহাড়পুরের বিহারে অবস্থান ও পরিদর্শন করেছেন (সূত্র : ড. নীহার রঞ্জন রায়ের বাংলার ইতিহাস, আদিপর্ব)। ইতিহাসবিদ, পণ্ডিতরা ধারণা করেন, এশিয়া এবং এশিয়ার বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য, তীর্থযাত্রা, সামরিক পথের গুরুত্বের পাশাপাশি পর্যটকদের আসা-যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ ছিল সিল্ক রুট বা রেশম পথ। ভারতের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য চলত এই রেশম পথ বা সিল্ক রুটের মাধ্যমেই। এই সিল্ক রুটের মাধ্যমে চীনারা তাদের রেশম, পশমের দ্রব্যাদি নিয়ে আসত ভারতে এবং এখান থেকে সংগ্রহ করত মশলা, মিহি কাপড় ইত্যাদি। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘মধ্যযুগে বাংলা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘চীনা পরিব্রাজকরা অনেকেই বাংলার বন্দর তাম্রলিপ্ত থেকে বাঙালির জাহাজে উঠে সিংহল হয়ে স্বদেশ যাত্রা করেছিলেন, সেকালে পূর্ব ভারত ও দ্বীপপুঞ্জ ছাড়াও চীন দেশের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য চলত, বৌদ্ধ প্রচারকরা বাঙালির জাহাজে চড়ে চীন, জাপান গমন করে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিলেন।’ হিউয়েন সাং ভারতে এসেছিলেন দুর্গম গোবি মরুভূমি পার হয়ে এই সিল্ক রুট দিয়েই, আবার ফেরার সময়েও এই রেশম পথের রাস্তা ব্যবহার করে দেশে ফিরেছিলেন।
রোমান সাম্রাজ্য বিধ্বস্থ হওয়ার পর মূলত গুপ্ত যুগের বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ধারাটি হারিয়ে যায়, নবম শতাব্দী থেকে আরব বণিকদের হাতে সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটটি চলে যায়। অষ্টম-নবম শতাব্দী থেকে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত চীনাদের বাংলায় আগমন সর্ম্পকে কিছু জানা যায়নি। চতুর্দশ শতকে ইলিয়াস শাহী শাসনামলে বাংলা-চীনের দূত বিনিময়ে বাংলার ইতিহাস সরব হয়ে ওঠে। সোনারগাঁও, গৌড় পান্ডুয়ার সুলতান গিয়াসুদ্দিন আযম শাহের রাজত্বকালে স্বয়ং সুলতান নিজ আগ্রহে চীনে শুভেচ্ছা দূত পাঠান। চীনের ইতিহাস ‘মিং-শর-লুতে’ বাংলার সুলতানের প্রেরিত সৈয়দ মোহাম্মদ, বায়াজিদ, ওসমান, জিয়াউল আহাম্মদ, নাসির নামক বাঙালি দূতদের নাম লেখা আছে (সূত্র : সুখময় মুখোপাধ্যায়ের স্বাধীন বাংলার সুলতানের ইতিহাস দুশ’ বছর)। বাংলার সুলতানরা ১৪০৮, ১৪০৯, ১৪১২, ১৪১৪, ১৪২০, ১৪২১, ১৪৩৮, ১৪৩৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চীনে শুভেচ্ছা দূত পাঠিয়েছিলেন। তখন চীনে ‘উংলোর’ রাজত্বকাল চলছে। চীন সম্রাটের নির্দেশে চীনা দূতেরা ১৪০৯, ১৪১২, ১৪১৫, ১৪২২, ১৪২৩, ১৪২৯, ১৪৩৫ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁও, পান্ডুয়া ভ্রমণ করেন। চীন সম্রাটের দূত দলের নেতৃত্বে ছিলেন মা হোয়ান, কুয়ংছংলি, ঝেংহে, ইয়াংমিন ও ফেইসিন।
শামসুদ্দোহা চৌধুরী : গবেষক