সূত্রধর
মিলিন্দ পনহ
রাজা মিলিন্দ যিশুখ্রিস্টের আগের আমলের মানুষ। বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের সঙ্গে এক দীর্ঘ বাহাস করেছেন। তাঁদের আলাপ নিয়েই মিলিন্দ পনহ। লিখেছেন চট্টগ্রাম কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ড. রেয়াজুল হক ভিক্ষু পেশালার বইয়ের প্রচ্ছদ
গ্রিকরা ডাকে মিনান্ডার। পালি ভাষায় বলে মিলিন্দ। আলেকজান্দ্রিয়া অব ককেশাসের এক গ্রিক পরিবারে রাজা মিলিন্দের জন্ম। এখন আফগানিস্তানের বাগরামের একটি গ্রাম এটি। তাঁর রাজত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫ থেকে ১৩০ অব্দ। তিনি জ্ঞানী ছিলেন। আইন, যোগশাস্ত্র, দর্শন, পাটিগণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বেদ, পুরাণ, জ্যোতির্বিদ্যা আর যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। জানার আগ্রহ ছিল তাঁর খুব। তাই তো ভিক্ষু নাগসেনকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বসেছিলেন দীর্ঘ আলাপে।
মিলিন্দরাজের রাজ্য
গ্রিক বীর আলেকজান্ডার পারস্য জিতে নিয়েছিলেন। তখন হিন্দুকুশ পর্বতমালা আর আমু দরিয়ার মাঝখানের বিশাল এলাকাকে বেকট্রিয়া বলা হতো। এটি এশিয়ার পূর্বাঞ্চল। আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ছিল বেকট্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। রাজা মিলিন্দরাজ্য আরো বড় করেন। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন খাওয়া, পাঞ্জাব, ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ আর জম্মুও ছিল তাঁর অধীনে।
রাজধানী ছিল শিয়ালকোট
পাঞ্জাবের শিয়ালকোটের একটি জায়গা সাগালা। পাহাড়, নদী, হ্রদ, বাগান মিলে আকর্ষণীয় ছিল সাগালা। স্থাপত্যবিদরা হিসাব কষেই এ নগরের পরিকল্পনা করেছিলেন। মানুষ সুখে-শান্তিতে ছিল। শহরের চারপাশের সুরক্ষা ছিল সুদৃঢ়। শহরের বাজারে অনেক রকম পণ্যসামগ্রী পাওয়া যেত। অনেক উঁচু উঁচু ভবন ছিল। রাস্তাগুলো হাতি, ঘোড়া আর চাকাযুক্ত যান চলাচলের উপযোগী ছিল। ব্রাহ্মণ, শিল্পী আর দাসদের ভিড় লেগেই থাকত। প্রায় সব ধর্মাবলম্বীর জন্য উন্মুক্ত ছিল সাগালা।
জানা গেল যেভাবে
গ্রিক লেখক স্ট্রাবো লিখে গেছেন, বেকট্রিয়ার গ্রিকরা আলেকজান্ডারের চেয়েও বড় জায়গা জয় করেছে। তাদের একজন হলেন ডেমেট্রিয়াস, অন্যজন মিলিন্দ। প্রাচীন ভারতের লেখকদের থেকেও জানা যায়, মিলিন্দ রাজস্থান ও পাটলিপুত্র বা পাটনায়ও অভিযান চালিয়ে ছিলেন। বৌদ্ধ লেখকরা নাগসেন আর মিলিন্দর কথোপকথনের কথা অনেকবারই বলেছেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০-১০০ অব্দের বেকট্রীয় রৌপ্য ও ব্রোঞ্জের মুদ্রা থেকেও জানা যায় রাজা মিলিন্দর কথা। কিছু মুদ্রা আছে নয়াদিল্লির জাতীয় জাদুঘরে। আরো কিছু ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। মুদ্রাগুলোর এক পিঠের ভাষা গ্রিক, অন্য পিঠে পালি। কোনো কোনোটিতে বুদ্ধ চক্রও দেখা যায়। আর নাগসেন ছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু। কাশ্মীরের কজঙ্গল নামের ব্রাহ্মণ গ্রামে জন্ম তাঁর। তাঁর বাবার নাম সুনোতারা। সাত বছর বয়সে বাবা তাঁকে এক ব্রাহ্মণ শিক্ষকের অধীন করেন। ক্রমে ক্রমে তিনি একজন বৈয়াকরণিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও তার্কিক হয়ে ওঠেন।
মিলিন্দ পনহ
ধারণা করা হয়, বইটি প্রথমে সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল। নাম ছিল নাগসেন ভিক্ষু সূত্র। মূল বইয়ে ৩০৪টি প্রশ্ন-উত্তর আছে। গ্রন্থটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে সংকলিত। সাধারণভাবে পশ্চিমের মানুষ বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন করে থাকেন, সেগুলোই এতে স্থান পেয়েছে। যেমন : আত্মা কী, পুনর্জন্ম কী, ইত্যাদি। দুটি প্রাচীন সভ্যতার (গ্রিক ও সিন্ধু) সমন্বয়ের সাক্ষ্য বহন করে এ গ্রন্থ। অনেকে মনে করেন নাগসেন নিজেই বইটির রচয়িতা। ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে পালি ভাষায় রচিত বইটির কপি পাওয়া যায় (সবটা নয় অবশ্য)। চট্টগ্রামের রাউজান নিবাসী শ্রী প্রজ্ঞালোক স্থবির গ্রন্থটির প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডের অনুবাদ প্রকাশ করেন ১৯৩১ সালে। গ্রন্থটি রেঙ্গুনের বৌদ্ধ মিশন প্রেসে মুদ্রিত হয়। কলকাতা থেকে ১৯৭৭ সালে এটি প্রকাশিত হয় পণ্ডিত শ্রীমৎ ধর্মাধার মহা স্থবিরের অনুবাদে। থমাস উইলিয়ামস রেহ ডেভিডস নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিক পালি ভাষার পণ্ডিত ছিলেন। তিনি গ্রন্থটি পালি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, আমি মনে করি, এ গ্রন্থ ভারতীয় গদ্য সাহিত্যের সেরা সাহিত্যকর্ম। ভিক্ষু পেশালাও গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন।

গ্রন্থের প্রশ্নোত্তরের নমুনা
মিলিন্দ : পরমপূজ্য নাগসেন, মনোযোগের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কী, জ্ঞানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যই বা কী?
নাগসেন : মনোযোগের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পরীক্ষা এবং জ্ঞানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছিন্নকরণ।
মিলিন্দ : উদাহরণ দিন।
নাগসেন : মহামান্য রাজা, আপনি বার্লি ফসল কর্তনকারীদের জানেন?
মিলিন্দ : হ্যাঁ, পরমপূজ্য মহাশয়, আমি তাদের জানি।
নাগসেন : মহামান্য রাজা, কর্তনকারীরা কিভাবে বার্লির গোছা কর্তন করে?
মিলিন্দ : তারা বাম হাতে বার্লির একটি গোছা ধরে আর ডান হাতে কাস্তে ধরে, এর পর কাস্তে দিয়ে বার্লির গোছা কাটে।
নাগসেন : ঠিক যেমন, মহামান্য রাজা, তারা বাম হাতে বার্লির একটি গোছা ধরে আর ডান হাতে কাস্তে ধরে, তারপর কাস্তে দিয়ে বার্লির গোছা কাটে। তেমনিভাবে মহামান্য রাজা, আধ্যাত্মিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা মনোযোগ দিয়ে মনকে ধরে এবং জ্ঞানের দ্বারা অশুচি দূর করে।
মিলিন্দ : আপনি অতিশয় বুদ্ধিমান পরমপূজ্য নাগসেন।