জেবুন্নেসা চপলা
অনেকেই হয়ত আমার সাথে একমত হবেন যে, বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের নাম সহিংস ধর্ম সন্ত্রাস বা লুকানো রিলিজিয়াস রেসিজম । এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় আজ বাংলার আকাশও আচ্ছাদিত ।
শান্তিই নাকি পৃথিবীর সকল সম্প্রদায়গত ধর্মের গন্তব্য। তাহলে এই শতাব্দীর দ্বার প্রান্তে এসে এইসব আমরা কি দেখছি ? মানুষের কল্যাণের জন্য যে ধর্ম তা নিয়েই কত রাজনীতি,মত বিভেদ, রক্তপাত, অত্যাচার, লাঞ্ছনা আর অশান্তি।
ঔপনিবেশিক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের কারণে এই ধর্ম সন্ত্রাসের বীজ অনেক আগেই বাংলার মাটিতে বপন করা ছিল যা এখন বড় মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রমাণ করেছে দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে দেশ ভাগ হওয়াটা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। ভাষা ,সংস্কৃতি এবং ইতিহাসই জাতিসত্তার মূল ভিত্তি। বাঙালির প্রথম পরিচয় সে একজন বাঙালি ।
স্বধর্মীয় পাকিস্তানিদেরকে (বিদেশী ) আপন ভাবা আর অন্য ধর্মাবলম্বী বাঙ্গালীকে পরজাতি এবং দূরের মনে করাটা একধরণের বিভ্রান্তিকর ধারণা এবং সাম্প্রদায়িক মানসিকতার চর্চা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাঙালি- বাঙালি ভাই-ভাই না হয়ে, যখন শুধুমাত্র মুসলিম -মুসলিম ভাই-ভাই হবার প্রচেষ্টা চলে, সেখানেই তখন ধর্মীয় মৌলবাদীরা সফলতা অর্জন করে। তখন তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের মত বিধ্বংসী সন্ত্রাসী মতবাদও বাংলার ছেলেমেয়েদের কাছে আপন হয়ে যায় !
ঢাকায় নববর্ষ উদযাপন: অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের লক্ষেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল মন্ত্র ছিল, বাংলার প্রত্যেক মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জনগণকে মুক্তি দেয়া।
বাঙালি হবে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি। ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশ্র আদর্শে এই ভূখণ্ড পরিচালিত হবে।
বিবেকবান,অসাম্প্রদায়িক মুক্তবুদ্ধি, যুক্তিবাদী মনের মানুষ যেন আর তৈরি হতে না পারে তাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে ছলে -বলে কৌশলে।
বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ এবং উচ্চশিক্ষার সিলেবাসগুলো ঢেলে সাজানো জরুরি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এম বি এ, কম্পিউটার সায়েন্স, ফ্যাশন ডিজাইন , আর্কিটেকচার, ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিকেলে পড়ার হিড়িক শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারণ সহজে চাকরি পাবে।
সামাজিক বিজ্ঞান ও কলা অনুষদের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো হাতে গোনা কিছু পাবলিক এবং কিছু ব্যতিক্রমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয় না।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ ইতিহাস, দর্শন, নৃ-বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি , আইন, মনোবিজ্ঞান, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, সোশ্যাল জাস্টিস স্টাডিজ, রিলিজিয়ন অ্যান্ড কালচার, সংগীত, নাট্যতত্ত্ব, চারুকলা এবং বাংলা/ ইংরেজি সাহিত্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো সবচেয়ে নিগৃহীত এবং পরিবার উৎসাহ যোগায় না পড়বার জন্য, চাকরি পাবে না বলে।
এই সকল গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত আমাদের গোটা সমাজ ।
লন্ডনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর জীবন দর্শনের প্রতিফলন কতটুকু ঘটছে?
এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা লালসালু, লালনের দর্শন, সিমোন দা বুভোয়ার এর দর্শন,বেগম রোকেয়া, নূরজাহান বেগম ,ইলা মিত্র, প্রীতিলতা , সক্রেটিস, বার্ট্রান্ড রাসেল, মার্ক্স, এঙ্গেলস, ম্যাক্স ওয়েবার, মিশেল ফুকো, আহমেদ ছফা, সর্দার ফজলুল করিম, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথের মানব ও প্রকৃতি প্রেমের সাথে পরিচয় ঘটাচ্ছে না।
পৃথিবীর ক্লাসিকাল এবং পোস্ট-কলোনিয়াল চিন্তাবিদদের দর্শন এবং তাঁদের চিন্তার সাথে পরিচয় থাকাটা জরুরী সুশিক্ষিত নাগরিক তৈরির জন্য।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে, বাংলাদেশে বসে পাশ্চাত্যের অদেখা সংস্কৃতি আর ইতিহাস পড়ে তাদের চারপাশ-এর বাংলা সংস্কৃতির মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করতে পারছে না। মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্রটিরও একি সমস্যা। ইসলামের যে ইতিহাস জানছে, অদেখা আরবের সংস্কৃতি যা পড়ছে তার সাথে তার নিজস্ব যাপিত জীবনের, বাংলাদেশের ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নাই।
ভিন দেশের ভাষায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম অর্থ না বুঝে ধর্ম গ্রন্থ পড়লে যা হবার তাই হচ্ছে আজকের বাংলাদেশে। ধর্ম গ্রন্থগুলোকে বুঝে পড়তে হবে। ভয়, ঘৃণা, বিদ্বেষের লেন্স দিয়ে ধর্ম গ্রন্থ পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
বেশিরভাগ ফ্রন্টলাইন মিলিট্যান্ট ধর্ম ব্যাখ্যা দ্বারা প্রভাবিত।তারা বিশ্বাস করে আল্লার রাস্তায় দ্বীন কায়েম করার জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে বিধর্মীদের জীবন হরণ করাই বেহেশত লাভের পথ ।
বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস , ভারতবর্ষের ইতিহাস, বাংলাদেশের সংবিধান, অর্থনীতি, আইন, সমাজ ব্যবস্থা, মানবাধিকার এবং নৈতিক জ্ঞান ছাড়া বেড়ে উঠলে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধতার অন্ধকার সে জাতির সঙ্গী হবে সেটাই স্বাভাবিক। উগ্রপন্থী চিন্তা থেকে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
বাংলাদেশে ভাষা শহীদ দিবস ‘একুশে’ উদযাপন: বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধান।
এক মুসলিমদের মধ্যে এত মতের অমিল আর কোন্দল থাকলে বহিঃশত্রুরাতো সুযোগ নেবেই! আহমদিয়া, শিয়া, সুন্নি, সালাফি, ওয়াহাবি, সুফী মুসলীম, ভারত বর্ষের ইসলাম, পারস্য ইসলাম, আরব্য দেশের ইসলামিক চর্চা, ইউরোপ আমেরিকার ইসলাম, আফ্রিকার ইসলাম, সবশেষে সিরিয়া-ইরাকের তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের সন্ত্রাসী মতবাদ – এতো সকল ভিন্ন সংস্কৃতির ইসলামকে আমাদের দেশের মানুষরা বুঝতে পারছে না কারণ আমাদের দেশের মানুষরা নানা সংস্কৃতির মানুষ, ভাষা, পোশাক, রীতি-নীতি দেখে অভ্যস্ত নয়।
ক্রস-কালচারাল পরিবেশে মেশার অভিজ্ঞতার অভাবে শুধুমাত্র ইন্টারনেট-এ ডিজিটাল মাল্টি কালচারাল ইসলামিক জীবন দেখে তরুণরা গোলক ধাঁধায় পড়ে গেছে। মৌলবাদী ধার্মিক, মডারেট ধার্মিক, সাম্যবাদী ধার্মিক, কিংবা নারীবাদী ধার্মিকদের মত ও আদর্শের ভাষা আমাদের সাধারণ জনতা বোঝে না ।
মানুষ যদি অন্তরাত্মাকে না চেনে, অন্য ধর্মকে সম্মান করতে না শিখে নিজেকে “সর্বশ্রেষ্ঠ” প্রমাণের জন্য ব্যস্ত থাকে ,তাহলে সমাজে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে না।
‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ কিন্তু আজকের বাংলার বাস্তবতা উল্টো ‘সবার উপরে ধর্ম সত্য মানুষ সেখানে নাই’ !
বাংলাদেশ শুধু মুসলমানের দেশ তাতো কখনো শুনিনি ! হিন্দু-বৌদ্ধরা মার খেলো বলে প্রতিবাদ শুধু তারাই করবে না। এই প্রতিবাদ আসতে হবে দেশের আপামর মেজরিটি মুসলমানদের পক্ষ থেকে সবার আগে, তাহলে নির্যাতিতরা সাহস পাবে এই ঘোরতর অন্ধকারে নতুন করে বাঁচবার ।
নিঃশ্চুপ থেকে যারা নির্যাতনকারীদের হাতকে আরো বেশি শক্তিশালী করছে তাদেরকে জাগিয়ে তুলতে হবে। মেজরিটি জনগণের নীরবতা তাদের অজান্তেই পরোক্ষভাবে এই সহিংস ধর্মীয় সন্ত্রাস টিকিয়ে রাখার পক্ষে সমর্থন যোগাচ্ছে।
ঢাকার এক শিয়া মসজিদে পুলিশ প্রহরা: ধর্মের ভেতরে সংঘাত সৃষ্টি করতে তৎপরতা বাড়ছে।
রাষ্ট্র এবং নিঃশ্চুপ সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মানুষদের শোষণ করে তাদের ধন সম্পত্তি কুক্ষিগত করবার আশায়। সবাই আজ নীরব দর্শক যাবতীয় ধর্মীয় সন্ত্রাসের।
হিন্দু – বৌদ্ধ – খ্রিষ্টান মারা শূন্যের কোঠায় এলে শুরু হবে নাস্তিক মারা, তা শেষ হলে হয়ত শিয়া, কাদিয়ানি, আর তাও যদি ফুরায় তারপর শুরু হবে কে কত খাঁটি আর অ-খাঁটি মুসলিম তা নিয়ে মারামারি, সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়।
বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধান করতেই হবে। বাঙালিয়ানার সাংস্কৃতিক শেকড়ের খোঁজে বের হলেই জানতে পারবো ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ইতিহাস এবং সেই সাথে পরিষ্কার হয়ে যাবে ইসলামিক ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস আর আজও চারিদিকে ধর্ম নিয়ে ঠোকাঠুকির কারণগুলো।
সৃষ্টির আদিতে ধর্ম ছিল অদৃশ্য শক্তিতে ভক্তি এবং নিজেকে সমর্পন যা পরবর্তীতে ধর্মীয় ব্যবসার ইন্ডাস্ট্রিতে ও রাজনীতিতে পরিণত হয় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার কারণে। শেকড়ের ইতিহাস না জানলে, পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে না বুঝলে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ এর বহুমাত্রিক কারণ গুলো কখনই জানা যাবে না।
এগুলো বুঝতে হলে সামাজিক বিজ্ঞানের মাল্টি ডিসিপ্লিনারি জ্ঞানকে অবহেলা করলে চলবেনা। বর্তমান বাংলাদেশের জন্য ক্রিটিক্যাল থিংকিং,বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী শিক্ষা, ‘ডিকলোনাইজেশন অফ থটস’ ভীষণ জরুরি যা সাম্প্রদায়িক মানসিকতার মানুষদের চিন্তাকে উগ্রবাদ থেকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
লেখিকা :জেবুন্নেসা চপলা
গবেষক ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট, সাস্কাটুন, কানাডা
সুত্র: বিবিসি বাংলা