নশ্বর সুজয়
১ম পর্ব –
(ত্রিপিটক পরিক্রমায় ক্রমানুসারে তুলে ধরার চেষ্টা করব)
ভারতবর্ষে বর্ণবাদের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। বুদ্ধের আবির্ভাবের পূর্বেই ভারতে মানবসৃষ্ট এই বর্ণবাদ মানবজাতিকে ভিন্ন ভিন্ন স্তরে বিভাজিত করে। এতে করে মানবাধিকারের চরম পতন ঘটে; ক্ষেত্রবিশেষে একশ্রেনীর মানুষ অন্য শ্রেনীর মানুষকে তীর্যক পশুতুল্য উপেক্ষা করত। বুদ্ধপূর্ব ও বুদ্ধ সমকালীন ব্রাম্মণরা সকলেই ত্রিবেদ চতুরবেদে খুবই পারদর্শি ছিলেন। ত্রিপিটকের বিভিন্ন সূত্রে দেখা যায় বুদ্ধের বিশেষ বিশেষ ভিক্ষু শিষ্যরা ত্রিবেদজ্ঞ চতুরবেদজ্ঞ ছিলেন। তাই সংক্ষেপে বেদ ও ত্রিপিটকের আলোকে বর্ণপ্রথার প্রারম্ভিক সৃষ্টি তুলে ধরার চেষ্টা করব-
ভারতের প্রাচীনতম অসনাতন নাস্তিক্য ধর্মদর্শনের অন্যতম হচ্ছে বৌদ্ধ দর্শন। কিন্তু একান্তই ধর্মবাদী দর্শন হয়েও এ দর্শনের সম্প্রদায়কে তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কেন নাস্তিক্যদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন তা কৌতুহলজনক বৈকি। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যখন উপনিষদীয় চিন্তাধারা কর্মমীমাংসা ও ব্রহ্মমীমাংসার বিরোধে ধর্মসংকটের ন্যায় তত্ত্বসংকটের সম্মুখীন হয় তখন প্রায় একইসময়কালে জৈন বর্ধমান মহাবীর ও শাক্যবংশীয় রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের কঠোর তপস্যালব্ধ এ দুটি বেদবিরোধী সম্প্রদায় দর্শনের আঙিনায় আবির্ভূত হয়। উপনিষদীয় পরিমণ্ডলে থেকেও ভারতীয় দর্শনের বৌদ্ধ সম্প্রদায় বেদভিত্তিক উপনিষদীয় চিন্তাধারার বিরোধিতায় নেমে সাধারণ মানুষের বোধগম্য এক আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার প্রবর্তন করেন। এই আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা বেদভিত্তিক না হয়েও সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা নিবৃত্তির সহায়ক হয়েছিলো। নিরীশ্বরবাদী হওয়া সত্ত্বেও উচ্চমানের আধ্যাত্মিকতায় ধীরে ধীরে এই চিন্তাধারার প্রভাব এতো আকৃষ্ট ও বিস্তার লাভ করেছিলো যে ভারতের সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি ধর্মজীবনকেও তা আলোড়িত করেছিলো। জনমানসে অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করেছিলো বলেই বেদানুসারী হিন্দু দর্শনে এই মতবাদগুলি খণ্ডনের জন্য বিশেষ যত্ন লক্ষ্য করা যায়।
প্রারম্ভিক দিকে এ বর্ণপ্রথা খুবই সরল ছিল। অতি প্রাচীন গ্রন্থ ঋগ্বেদে চতুবর্ণের উল্লেখ্ দৃষ্ট হয়। কালক্রমে তা ভিন্ন পথে পরিচলিত হয়। ঋগবেদকালীন ভারতীয় সমাজে ব্রাম্মণ, ক্ষত্রিয় (রাজা), বৈশ্য ও শুদ্র এ চারিবর্ণের অস্তিত্ব যথানিয়মে স্বাভাবিক ছিল। যেকোনো ব্যক্তি তার স্বীয় ইচ্ছানুরূপ চারিবর্ণের যেকোন একটির সমর্থন বা সদস্য হওয়ার সমাধিকার ছিল। ধীরে ধীরে এ সমর্থন প্রথা মানুষের মনে দৃঢ় হতে হতেই বংশানুপরস্পরা রূপ নেয়। ফলে বুদ্ধ যুগে এ জাতিবাদ স্বীয় পরাকাষ্টে উপনীত হয়। এতে জাতিগত বা বর্ণগত বৈশিষ্ট্যের উচু-নিচু ভাবনা মানুষ মনে অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠে।
জাতিভেদ বিষয়ে ভাবেরগীতে বলা হয়েছে-
দেখ ছত্রিশ বর্ণ চার জাতি কারু খান না তিনি,
বর্ণ মধ্যে কোন বর্ণ তা শুনি আবার মানুষ নিশানী।
যে তার হুকুমে মকাম করে স্বকাম করে ত্যাগ,
তারি হন তারি সেবা লন, তাতেই অনুরাগ।
ভাবেরগীত নং-৪২১, কলি-৪
ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শুদ্র ৪জাতি, ৩৬বর্ণ, বর্ণশঙ্কর, পতিত, জারজ, অষ্পৃশ্য ইত্যাদি কশ্যপ, ভরদ্বাজ, আলেম্মন বিভিন্ন গোত্র এ সব ব্রহ্মণ্যবাদের বিধানকে কু-সংস্কার মনে করে মন থেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলবে এবং এমন কোন কাজ করবে না যাতে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতিভেদ স্বীকৃত হয়।
বুদ্ধ যুগে জন -মানসে বর্ণগত ধারনা এতোই দৃঢ় ছিল যে; মানব সৃষ্ট সমাজে এই মানব বিভাজন অর্থাৎ চতুবর্ণের মধ্যে মানুষ মাত্রই স্বীয় পূর্বজন্মের কৃত্যানুসারে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণে জন্মগ্রহন পূর্বক সুখ দুখ ভোগ করে। কিন্তু ভগবান বুদ্ধ এরূপ মিথ্যা বদ্ধমূল ধারনার অপনোদন লক্ষে্য এক নতুন সামাজিক ও সার্বজনীন চেতনার জন্ম দেন এবং পরম্পরাগত ধারনাকে নিতান্তই নিরর্থক ঘোষণা করেন।
ভগবান বুদ্ধের উদ্ধৃতি ছিল- মানুষ মাত্রই সকলেই সমান। কেউ জন্মের দ্বারা মহান বা শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। মানুষ তার স্বীয় স্বীয় কর্ম প্রতিভায় প্রচেষ্টায় শ্রেষ্ঠত্ব মহত্ত্ব অর্জন করতে সক্ষম। বুদ্ধের এরূপ সার্বজনীন ব্যাখ্যা তৎকালীন প্রসিদ্ধ ব্রাম্মণ অশ্বলায়নও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন- শুধু ব্রাম্মণ স্বর্গীয় সুখভোগ করবে তা নয়, স্বীয় স্বীয় পুণ্যকর্মানুসারে ক্ষত্রিয়, শুদ্র, বৈশ্যও স্বর্গাধিকারী হতে পারে। (অস্সলাযন সুত্ত, মধ্যমনিকায় ২য় খণ্ড)
এছাড়াও সুত্ত পিটকের জাতক গ্রন্থের উদ্দালক জাতক-এ জৈনক ব্রাম্মণ পুরোহিতও বুদ্ধের সার্বজনীন মত গ্রহনপূর্বক ব্যক্ত করেন যে- ব্রাম্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র, চন্ডাল সকলেই আত্ম প্রচেষ্টায় স্বর্গ মোক্ষম এমনকি নির্বাণও লাভ করতে সক্ষম।
এভাবে বুদ্ধই সর্বপ্রথম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রা শুরু করেন। তৎকালীন সমাজবেবস্থায় সর্বক্ষম রাজা থেকে শুরু করে পথের ভিখারিও এরূপ বর্ণবিভাজনকে শ্রেষ্ঠ বিধান রূপে মান্য করত।
তাই বুদ্ধ ……….
চলবে…..