নশ্বর সুজয়
বুদ্ধের দশ অ-কথনীয়/দশ অব্যক্ত কথা/ (indeterminable questions)
বুদ্ধ ছিলেন মূলত একজন সমাজসংস্কারক, ধর্মপ্রচারক। কিন্তু অধিবিদ্যা বা আধ্যাত্মবাদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই ঈশ্বর, আত্মা, জগৎ প্রভৃতি বিষয়ের দার্শনিক বিচারে তাঁর কোন আগ্রহ ছিলো না। তাঁর নীতিশিক্ষা পর্যালোচনা করলে তাতে নীতিবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, তর্কশাস্ত্র তত্ত্বদর্শন বা অধিবিদ্যা প্রভৃতির উপস্থিতি দেখা যায়। তারপরও দর্শন শাস্ত্রের কোন প্রশ্ন করা হলে তিনি তখন মৌন থেকে আত্মা, জগৎ ইত্যাদি সম্পর্কিত জনপ্রিয় প্রশ্নের প্রতি ঔদাসীন্য প্রকট করেছেন। এই মৌনতার অর্থ হচ্ছে তা ‘অতিপ্রশ্ন’, যার প্রতিপাদন করা কেবল দুরূঢ়ই নয়, অনাবশ্যকও।
যাইহোক মূলবিষয়ে যাওয়ার পূর্বে বুদ্ধ তার নিজ সম্পর্কে কেমন ধারনা দিয়েছেন তা জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক।
বিনয় পিটকে পারাজিকা গ্রন্থে দশবল
বুদ্ধের গুণকীর্তি এরূপ দৃষ্ট হয়; বুদ্ধ ছিলেন অসীম জ্ঞান, অনন্ত জ্ঞানের আধার যিনি আদি মধ্য অন্ত বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞাত। অতীত বর্তমান ভবিষ্যত বিষয়ে বিস্তৃত জ্ঞাত। যিনি সর্বজ্ঞ সর্ব বিষয়ে অদ্বিতীয়। যিনি অরহৎ, বিদ্যাচরণসম্পন্ন, লোকবিদ, অদম্যপুরুষ সারথি, অনুত্তর, সুগত, দেব মনুষ্যে শাস্তা এরূপ নানা গুণের আধার। এছাড়াও উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ্ আছে বুদ্ধ স্বয়ং নিজেই তার ক্ষমতা ও সম্মান কতো উচ্চ তা প্রকাশ করেন।
বুদ্ধ নলেরুপচিমন্দমূলে অবস্থান কালে বৈরঞ্জ নামক খ্যাতিমান ব্রাম্মণ বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করেন হে শাক্যপুত্র ভো গৌতম! আপনি নাকি বয়প্রাপ্ত, প্রবীণ, জীর্ণ, বয়স্ক ব্রাম্মণগণকে অভিবাদন প্রতু্যত্থান এবং আসন বাড়িয়ে আহ্বান করেন না?
উত্তরে বুদ্ধ বললেন- হে ব্রাম্মণ! আমি কাউকে দেখছি না, এই মনুষ্যলোকে, দেবলোকে, মারলোকে, ব্রহ্মলোকে আমা কতৃক অভিবাদন, সম্মান, প্রতু্যত্থান এবং আসন দ্বারা বসার আহ্বান যোগ্য হতে পারে। যদি তথাগত এরূপ কাউকে অভিবাদন প্রতু্যত্থান করেন তাহলে সেই ব্যক্তি নিশ্চিত বির্দীণ হবে। (বিনয় পিটক, পারাজিকা)
এছাড়াও বুদ্ধের বিভিন্ন উক্তিতে দেখা যায় বুদ্ধ তার বুদ্ধজ্ঞানে এই ত্রিলোক বিষয়ে যতদূর জ্ঞাত থাকতেন তা তিনি ক্ষেত্রবিশেষে শিষ্যেবর্গকে পরিপূর্ণ জ্ঞাত করাতেন না (দেশনা করতেন না)। যদি তারা তাদের জ্ঞান বিচারের তা ধারন করে অক্ষম হয়। তাহলে তাদের মহা অমঙ্গল সাধিত হবে।
পারাজিকা গ্রন্থে উল্লেখ্ আছে- স্থান রাজগৃহ গিজ্ঝাকূটপর্বত, একদিন ঋদ্ধিমান মহামোগ্গলায়ন স্থবির ও আয়ুষ্মান লক্ষন স্থবির আহার সংগ্রহে যাওয়ার সময় আয়ুষ্মান মহামোগ্গলায়ন এমন এক বিবৎস প্রাণীকে আকাশ পথে গমন করতে দেখতে পান এবং তাতে মৃদু হাস্যোদ্রেক করেন। অতপর আয়ুষ্মান লক্ষন স্থবির হাসির হেতু কি তা জানতে চাইলে মহামোগ্গলায়ন উত্তরে তা বুদ্ধের সম্মমুখে জ্ঞাত করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। অতপর উভয়ে বুদ্ধের সকাশে উপস্থিত হয়ে উক্ত বিষয়টি উপস্থাপন করেন। মহামোগ্গলায়ন- ভান্তে ভগবান! আমি গিজ্ঝাকূটপর্বত হতে অবতরণ কালে মাংসপেশি সদৃশ এক বিভৎস প্রাণী দেখেছি। যা পূর্বে কখনো দেখিনি। তাকে কিছু শেনকপক্ষী, চিলপক্ষী কাকপক্ষীরা চক্ষুতে তীব্র আঘাত করছিল, ছিন্নবিছিন্ন করছিল চঞ্চুর দ্বারা। এবং খুব চিৎকার করছিল।
তা শুনে বুদ্ধ বলেন- হে ভিক্ষুগণ তা আমি অনেক পূর্বেই দেখেছিলাম। কিন্তু সাধারণ জনগন তা বিশ্বাস করবে না বলেই তা প্রকাশ করিনি। কারন বুদ্ধ বাক্যে কর্ণপাত না করলে তাদের মহা অহিতসাধন হয়, অমঙ্গল হয় এমনকি অনন্ত কাল নরক ভোগ করে, সহস্রকাল নিরয় যন্ত্রনা ভোগ করে। (বিনয় পিটকে পারাজিকা গ্রন্থ)। এরূপ অনেক অনেক বিষয়ের উল্লেখ্ পাওয়া যায়।
এছাড়াও বিনয় পিটকের মহবর্গ গ্রন্থ দেখা যায়- বুদ্ধ বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির প্রারম্ভে তার সাধনালব্ধ নৈর্বাণিক ধর্ম মানুষদেরকে প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিলেন না।
আমার কতৃক লব্ধ এই নৈর্বাণিক ধর্ম বড়ই সুগম্ভীর, পন্ডিতবেদনীয়, শান্ত, প্রনীত, দুর্বোধ্য, তর্কাতীত। কে বুঝতে সক্ষম? সাধারণ মানুষ আলয়াশ্রিত তাদের পক্ষে তা উপলব্ধি করা দুষ্কর হবে। তৎদ্বেতু আমারও ক্লেশ ও বিরক্তির কারণ হবে।
বুদ্ধের এরূপ বিতর্ক দেখে সহম্পতি ব্রহ্মা বুদ্ধের সকাশে ত্রসে অনুরোধ করলে বুদ্ধ মানবজাতি তথা সমগ্রজীবের মঙ্গলার্থে ধর্ম প্রচারে সম্মিত হন। (বিনয় পিটক, মহাবর্গ, ব্রহ্মার যাচ্ঞা কথা)।
বুদ্ধ ছিলেন মূলত একজন সমাজসংস্কারক, ধর্মপ্রচারক। কিন্তু অধিবিদ্যা বা আধ্যাত্মবাদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই ঈশ্বর, আত্মা, জগৎ প্রভৃতি বিষয়ের দার্শনিক বিচারে তাঁর কোন আগ্রহ ছিলো না।
এ বিষয়ে বুদ্ধ অতি সুন্দর উপমাসূচক দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। ব্রাহ্মণদের আত্মবাদ বিষয়ে ‘দীঘনিকায়ে’র ‘পোট্ঠপাদ সূত্তে’ বলা হয়েছে-
আত্মাকে স্বর্গসুখ ভোগ করতে কে দেখেছে? না দেখে তার অস্তিত্ব স্বীকার করা নিতান্ত উপহাস্যস্পদ। যদি কোন পুরুষ বলে যে, সে এই দেশের যে জনপদকল্যাণী (=দেশের সুন্দরতম স্ত্রী) তাকে চায়। তাতে লোকে তাকে প্রশ্ন করে, যে স্ত্রীকে সে চায় সে কি ক্ষত্রিয়াণী, ব্রাহ্মণী, বৈশ্যস্ত্রী বা শূদ্রী? অমুক নামধারী বা অমুক গোত্রধারী, লম্বা বা বেটে বা মাঝারি? এরূপ প্রশ্নে ‘না’ বললে (তাকে হয়তো নির্বোধ বা পাগল ঠাউরে) কেউ সেই বাক্যের কোন প্রমাণ চায় না। এরূপ আত্মবাদী ব্রাহ্মণবাক্যের প্রমাণ চাওয়া হয় না।
.
দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি আরো সুন্দর। কোন ব্যক্তি প্রাসাদে আরোহণের জন্য চৌরাস্তায় সিঁড়ি বানালে লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করে, ওহে! তুমি যে প্রাসাদের জন্য সিঁড়ি বানাচ্ছো, তুমি কি জানো সেই প্রাসাদটি পূর্ব দিকে, দক্ষিণ দিকে, পশ্চিমদিকে বা উত্তরদিকে? উঁচু, নিচু বা মাঝারি? এই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বললে তাকে বলা হয় যে, যাকে তুমি জানো না, দেখোনি সেই প্রাসাদে চড়ার জন্য সিঁড়ি বানাচ্ছো? ঐদি এই প্রশ্নের উত্তরে ‘হাঁ’ বলা হয় তবে কি তার বাক্য প্রমাণশূন্য হবে না?
.
এই উদাহরণের সহায়তায় গৌতম বুদ্ধ দেখিয়েছেন যে, ব্রাহ্মণদর্শনে প্রতিপাদিত ‘আত্মা’ নামক কোন পদার্থ নেই। কেননা যখন কেউ আত্মাকে দেখেনি, শোনেনি তখন তার অস্তিত্ব কিভাবে স্বীকার করা হয়? পরলোকে সেই আত্মাকে সুখী বানাতে যে উপায় গ্রহণ করা হয় তা কি নিরর্থক নয়? কেননা যার মূল নেই তাকে সিঞ্চন করা প্রয়োজন হয় না।
বুদ্ধ একজন সমাজসংস্কারকই ছিলেন, দার্শনিক নন। তাই যখনই তাঁকে দর্শন শাস্ত্রের কোন প্রশ্ন করা হতো তখন তিনি মৌন থেকেছেন।
মিলিন্দপ্রশ্ন গ্রন্থেও নাগসেন ভান্তে গ্রিক রাজ মিলিন্দকে নানা চমকপ্রদ উপমায় তা ব্যক্ত করেছেন ।
.
শ্রাবস্তীর জেতবনে বিহার করার সময় মোগ্গলিপুত্ত তিস্স বুদ্ধকে দশটি প্রশ্ন করেছিলেন, যার উত্তরে বুদ্ধ নিস্পৃহ থেকেছিলেন। এগুলোকেই বুদ্ধের দশ অ-কথনীয় বলা হয়। মজ্ঝিমনিকায় অনুসারে বুদ্ধের অকথনীয় সূচিতে মাত্র দশটি বাক্য আছে, যা লোক (বিশ্ব), আত্মা এবং শরীরের ভেদাভেদ তথা মুক্ত পুরুষের গতি বিষয়ক। এই প্রশ্নগুলো হলো-
(ক) লোক বিষয়ক:
(১) লোক শাশ্বত বা নিত্য (eternal) কি-না ?
(২) লোক কি অনিত্য (non-eternal) ?
(৩) লোক কি সসীম (finite) ?
(৪) লোক কি অসীম (infinite) ?
(খ) দেহাত্মার একতা বিষয়ক:
(৫) আত্মা ও শরীর কি এক ?
(৬) আত্মা ও শরীর কি ভিন্ন ?
(গ) নির্বাণ-পরবর্তী অবস্থা বিষয়ক:
(৭) মৃত্যুর পর তথাগতের কি পুনর্জন্ম হয়েছে ?
(৮) মৃত্যুর পর কি তথাগতের পুনর্জন্ম হয় নি ?
(৯) তথাগতের পুনর্জন্ম হওয়া বা না হওয়া- উভয়ই কি সত্য ?
(১০) তথাগতের পুনর্জন্ম হওয়া বা না হওয়া- উভয়ই কি অসত্য ?
.
বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধের এ মৌনতার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হয়েছে। কোন কোন পণ্ডিতের মতে বুদ্ধের এই নীরবতা তত্ত্ববিষয়ক অজ্ঞানের প্রতীক। কিন্তু এ মত গ্রহণযোগ্য নয় এজন্যেই যে, তত্ত্বশাস্ত্রীয় প্রশ্নের উত্তর না জানলে তিনি ‘বুদ্ধ’ সংজ্ঞায় বিভূষিত হতেন না। বুদ্ধ শব্দের অর্থ জ্ঞানী। আবার কারো কারো মতে বুদ্ধ আত্মা, জগৎ, ঈশ্বর ইত্যাদির অস্তিত্বে সন্দিগ্ধ ছিলেন বলে এই মৌনতা তাঁর সংশয়বাদের স্বীকৃতি। কিন্তু তাঁদের এ ধারণা যে সম্পূর্ণই অর্বাচীন তার প্রমাণ হলো বুদ্ধের অনিত্যবাদ, অনাত্মবাদ, নিরীশ্বরবাদের মধ্য দিয়ে এই বহমান জগতের কোনো বস্তুকেই ধ্রুব বা নিত্য বলে স্বীকার না করা।
.
অনেক পণ্ডিত বুদ্ধের মৌন থাকাকে উদ্দেশ্যমূলক আখ্যায়িত করে বলেন, বুদ্ধ ছিলেন সর্বজ্ঞানী। তিনি তত্ত্বশাস্ত্রের প্রশ্নোত্তর জানতেন এবং মানবজ্ঞানের সীমাও জানতেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, তত্ত্বশাস্ত্রীয় যত প্রশ্ন আছে তাদের নিশ্চিতভাবে উত্তর হয় না। এরকম কোন প্রশ্নের উত্তরে দার্শনিকরাও এক মত নন। তত্ত্বশাস্ত্রের প্রশ্নে সৃষ্ট ঝঞ্ঝাট ব্যর্থ বিবাদকে প্রশ্রয় দেয়। কেননা অন্ধগণ স্পর্শ করে হাতির স্বরূপ বর্ণনা করলে সেই বর্ণনা বিরোধাত্মক ও ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাই তিনি তত্ত্বশাস্ত্রীয় প্রশ্নের প্রতি মৌন থেকে নিস্পৃহতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন যে, সে সব প্রশ্নের উত্তর ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণে নিষ্প্রয়োজন। বুদ্ধমতে এসব অব্যাকৃত প্রশ্নে আগ্রহী হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এসব তত্ত্বশাস্ত্রীয় প্রশ্নের উত্তরে ব্যবহার বা নীতিমার্গের কোন সমস্যার সমাধান হয় না।
.
বুদ্ধের মতে সংসার দুঃখে পরিপূর্ণ। দর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে দুঃখের সমাপ্তি সন্ধান। সেকারণে তিনি দুঃখের সমস্যা ও দুঃখনিরোধের উপর অধিক জোর দিয়েছেন। তাই মালুঙ্ক্যপুত্ত যখন বুদ্ধকে এই দশ অকথনীয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন- “ভগবন্ ! যদি এ বিষয়ে জানেন …তবে বলুন …না জানলে …বা যিনি জানেন না বা বোঝেন না তাঁকে সরাসরি বলে দেওয়াই যুক্তিসংগত- ‘আমি জানি না।’ …”
বুদ্ধ এর উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন- “…আমি একে অ-কথনীয় …বলেছি, …কারণ …এর সম্বন্ধে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভিক্ষুচর্যা বা ব্রাহ্মচর্যের জন্য যোগ্য নয়। আবার নির্বেদ-বৈরাগ্য, শান্তি …পরম-জ্ঞান ও নির্বাণপ্রাপ্তির জন্যও এই অ-কথনীয়ের কোনো আবশ্যকতাই নেই; তাই আমি এদের বলেছি অবক্তব্য।” – মধ্যমনিকায় ও (দর্শন-দিগদর্শন/ রাহুল সাংকৃত্যায়ন)
.
বুদ্ধের মতে ভবরোগে পীড়িত জীব অধ্যাত্মবিষয় নিয়ে কী করবে ? তার কাছে তো কর্তব্য পথ জেনে চলা হচ্ছে জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এজন্যেই বৌদ্ধধর্ম প্রারম্ভে মানুষকে নীতিশাস্ত্রে আগ্রহী করায় তা ‘নৈতিক যথার্থবাদ’ (ethical realism) নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে।
.
তবে কোন বদ্ধ চিন্তার পাকে আটকে না থেকে স্বাধীন চিন্তার পক্ষেই বুদ্ধের সম্মতি ও উপদেশ পরিলক্ষিত হয়। যেমন (মজ্ঝিমনিকায়-১/২/৩) বুদ্ধ উপদেশ শুরু করেছিলেন এভাবে-
“ভিক্ষুগণ! আমি সেতুর মতো অতিক্রম করার জন্য তোমাদের ধর্মোপদেশ দিচ্ছি, ধরে রাখার জন্য নয়। …যেমন, একজন পুরুষ …এমন এক বিরাট নদীর ধারে উপস্থিত হলো যার এপার বিপদসঙ্কুল, ভয়পূর্ণ এবং ওপার সুখ-সমৃদ্ধিপূর্ণ তথা ভয়রহিত। অথচ সেখানে যাওয়ার জন্য কোনো তরীও নেই, নেই কোনো সেতু। …তখন সে …তৃণ-কাষ্ঠ …পত্র সংগ্রহ করে সেতু বেঁধে, তার সাহায্যে দৈহিক পরিশ্রমের দ্বারা স্বস্তিপূর্বক নদী পার হলো। …এরপর তার মনে হলো- ‘এই সেতু আমার উপকার করল, এর সাহায্যে …আমি পার হলাম; অতএব এখন একে আমি কেনই বা মাথায় করে অথবা কাঁধে তুলে… নিয়ে যাব না।’ …তবে কি …ঐ পুরুষকে সেতুটির প্রতি কর্তব্য পালনকারী ধরতে হবে? …না…। ভিক্ষুগণ! ঐ পুরুষ সেতুটি থেকে দুঃখকেই আহরণ করবে।”
.
একবার বুদ্ধকে কেশপুত্র গ্রামের কালামো নানা মতবাদে সত্য-মিথ্যা সন্দেহ করে প্রশ্ন করেছিলেন- “প্রভু! কোনো কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ কেশপুত্র গ্রামে এসে নিজ নিজ মতবাদ প্রকাশ…করেন, অন্যের মতবাদে দ্বি-মত হন, নিন্দা করেন।… অন্যেরাও…স্বীয় মতবাদ প্রকাশ করে…অন্যের মতবাদে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেন। অতএব…আমার মনে এরূপ দ্বিধা হয়- এঁদের মধ্যে…কে সত্য বলেন কেই বা মিথ্যা বলেন?’
উত্তরে বুদ্ধ বলেন- “‘কালামো! তোমার সন্দেহই…ঠিক, যেখানে প্রয়োজন সেখানেই সন্দেহ করেছ। …কালামো! তুমি শ্রুত কথার (বেদের) ভিত্তিতে কারুর কথা মেনে নিও না; তর্কের খাতিরে, বিনা যুক্তিতে, বক্তার ভব্যরূপে মুগ্ধ হয়ে, নিজের পুরনো সিদ্ধান্তের অনুকূল বলে, এই শ্রমণ আমার গুরু’ বলে মেনে না নিয়ে, নিজের বিচারে যা তুমি ধর্মসংগত, উত্তম, নির্দোষ, অনিন্দিত মনে করবে, যাকে গ্রহণ করা হিতকর ও সুখকর বলে জানবে নির্দ্বিধায় তাকে স্বীকার কর।’”
.
বুদ্ধ স্বয়ং যে সর্বজ্ঞতার ধারণার বিরোধী ছিলেন তা মজ্ঝিমনিকায়ে বুদ্ধের উপদেশেই পরিলক্ষিত হয়-
বাৎস্যগোত্র প্রশ্ন করেছিলেন- “‘প্রভু! শুনেছি শ্রমণ গৌতম সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী… -(যিনি এ কথা বলেন) …তিনি কি যথার্থই বলেন? মিথ্যাচরণ দ্বারা …ভগবানের নিন্দা করেননি তো?’
“বাৎস্য! আমার সম্পর্কে যিনি এরূপ মত পোষণ করেন …তিনি যথার্থ বলেন না। তিনি বিচার না করে মিথ্যা দ্বারা …আমার নিন্দাই করেন।” (মজ্ঝিমনিকায়-২/৩/১)
আবার অন্যত্র দেখা যায়, বুদ্ধ বলেছেন- “ আমার সদৃশ এমন কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নেই, যিনি একেবারেই সব জানবেন ও দেখবেন; অর্থাৎ সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা হবেন।” (মজ্ঝিমনিকায়-২/৪/১০)।