ইলা মুৎসুদ্দী:
ঘন শ্রাবণের মেঘের মতো রসের ভারে নম্রনত,
একটি নমষ্কারে প্রভু, একটি নমষ্কারে
সমস্ত মন পড়িয়া থাক তব ভবন দ্বারে।
যুগে যুগে অনেক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটে পৃথিবীতে। তাঁদের জ্ঞানপ্রতিভায়, প্রজ্ঞায় ও আদর্শে পূর্ণতা পায় সমাজ-সভ্যতা সর্বোপরি মানবতা। তাঁদের আজন্মলালিত স্বপ্ন মানবতার বাণী প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মধ্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটানো।
যে ব্যক্তি পরিপূর্ণরূপে তাঁর (ধর্ম পালনের) প্রতিশ্রুতি নেন,
তিনি সহজে লক্ষ্যে পৌঁছেন এবং (তাঁর) সুফল লাভ করেন,
ভালভাবে জেনে ধর্মের অনুশীলন করলে,
তদনুসারে তিনি তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছবেনই। —– আত্মবর্গ
সমকালীন চিন্তাজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, জ্ঞানতাপস শীলানন্দ ভিক্ষু (ধুতাঙ্গ ভান্তে) অনুপম গুণবৈশিষ্ট্য, অতুলনীয় কীর্তিমাহাত্ম্য ও অনন্যসাধারণ জীবনের অধিকারী। জ্ঞানরাজ্যের ভুবনে তাঁর প্রজ্ঞাদীপ্ত বিচরণ। জগৎ ও জীবনের স্বরূপ উপলব্ধির মাধ্যমে আধুনিক মননসমৃদ্ধ প্রাগ্রসর এই সত্যানুসন্ধানী গভীর অর্ন্তজ্ঞান দ্বারা আলোকশিখা প্রজ্জ্বলিত করতে সর্বদা সচেষ্ট। জ্ঞানান্বেষণ-সাধনার নিরন্তর ব্রতচারী হয়ে জগৎ ও জীবনের প্রকৃত সারসত্য উন্মোচনে প্রয়াসী। তাঁর আধুনিক-প্রাগ্রসর আলোকিত দর্শনসত্ত্বা সমাজ-দেশ-জাতিকে উদ্ভাসিত করেছে। তাঁর দর্শনমানসের বিকীর্ণ জ্যোতির্ময় প্রভা আমাদের মহিমান্বিত করছে সর্বদা। তিনি চেতনায় যা ধারণ করেছেন, তা কর্মে প্রতিফলিত করেছেন। কর্মই ছিল তাঁর একান্ত সাধনা। সত্যিকার অর্থেই তিনি একজন মহান কর্মযোগী। কর্মের মাধ্যমেই দেশ-জাতির কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করে চলেছেন অবিরাম। বুদ্ধের নীতি আদর্শের অনুসারী হিসেবে বৌদ্ধ ধর্ম দর্শনের গভীর প্রভাব তাঁর উপর পড়েছিল — যার কারণে এত অল্প বয়সে উনি অর্জন করতে পেরেছেন প্রজ্ঞার দর্শন। বৌদ্ধিক ধ্যান- ধারণায় ঋদ্ধ হয়েছে তাঁর চিন্তা-চেতনা। আজীবন বুদ্ধের নীতি-আদর্শ তথা বৌদ্ধ ধর্ম দর্শনের বিশ্বজনীন আবেদনকে চর্চা ও প্রচারের মাধ্যমে মানবতার জয়গান তথা অসচেতন মানবগোষ্ঠীকে সচেতন, ধর্মপরায়ন করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। বৌদ্ধ ধর্ম দর্শন শুধু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে নিবেদিত। বুদ্ধের অহিংসানীতি, মৈত্রী-করুণা-মুদিতা-উপেক্ষা নীতি বা ব্রক্ষ্মবিহারতত্ত্ব, উদার মানবতাবাদ, সার্বজনীন সাম্যবাদ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রভৃতি উপাদানের এক অপূর্ব সমন্বয় পূজনীয় শীলানন্দ ভিক্ষুর জীবন দর্শন। বৌদ্ধ দর্শনের প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি, অনিত্যবাদ, শূণ্যবাদ, কর্মবাদ, দুঃখবাদ, চতুরার্য্যসত্য, আর্যঅষ্টাঙ্গিকমার্গ প্রভৃতি মৌলিক বিষয়ের সুষমামন্ডিত সমাবেশ তাঁর দর্শনমানসের বুনিয়াদ সৃষ্ঠি করেছে। তাঁর চিন্তা ও কর্মে বৌদ্ধ দর্শনের ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক, সাং®কৃতিক, অর্থনৈতিক সর্বোপরি মানবিক মূল্যবোধ স্থান পেয়েছে। তাঁর দর্শনমানস অবশ্যই বিরলতায় বিশিষ্ট, স্বতন্ত্র এবং ব্যতিক্রমী। মহান বুদ্ধের একজন সুযোগ্য উত্তরাধিকাররূপে পূজনীয় ধুতাঙ্গ ভান্তে সদ্ধর্মের আলোকরশ্মি হয়ে বিচরণ করছেন মানবসমাজে। মানবতাবাদের ব্রতচারী তিনি।
পুণ্যের বিপাক সুখকর,
যদ্বারা সমস্ত আশা-আকাঙ্খা পরিপূর্ণ হয়।
পুণ্যবান দ্রুতই প্রশান্তির দিকে অগ্রসর হন
এবং স্বকীয় প্রচেষ্টায় নির্বাণ পৌঁছেন।—দন্ডবর্গ
মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধ মানবকল্যাণে তাঁর ধর্মবাণী প্রচার করেছিলেন। তাঁর প্রথম ধর্মপ্রচারের নির্দেশনা ছিল — ”ভিক্ষুগণ, নিজের সুখ ও হিতের জন্য, বহুজনের সুখ ও হিতের জন্য, দেব-মানবের হিত ও কল্যাণের জন্য আমাকর্তৃক দেশিত আদি-মধ্য-অন্ত কল্যাণকর ধর্ম চারিদিকে প্রচার কর।” বুদ্ধের এই প্রথম নির্দেশনায় নিজের ও অপরের কল্যাণ সাধনের উপদেশ রয়েছে। যাঁরা বুদ্ধের এ নির্দেশনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছেন তাঁরা নিজের জীবনকে সার্থক করেছেন, অপরের জীবনকেও মহিমান্বিত করার চেষ্টায় রত আছেন। পূজনীয় ধুতাঙ্গ ভান্তে এমনিতর এক মহাজীবনের অধিকারী যিনি মহামতি বুদ্ধের উপদেশের আলোকে নিজের জীবনকে সার্থক ও ধন্য করেছেন এবং পরহিত সাধন করে অনেকের জীবনকে পরিশীলিত ও কল্যাণময় করতে সহায়তা করছেন নিরন্তর। আত্মহিতে পরিশীলিত জীবনচর্চার পাশাপাশি যে পরহিতে লব্ধ জ্ঞান প্রচারে রত আছেন তার দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। সম্প্রদায়ের প্রতি ও জাতির প্রতি তাঁর মমত্ববোধ-প্রেম-ভালোবাসা তাঁকে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (বুদ্ধের নীতি অনুসারে) গড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে।