পূর্ণেন্দু পত্রী
চীন দেশের এক গ্রাম। সেই গ্রামের দশ এগার বছরের একদল ছেলে মাঠের মধ্যে কাটছিল পাকা ধান। এমন সময় তাদের সামনে এসে দাঁড়াল একদল দস্যু। ধান লুট করাই তাদের কাজ। ছেলের দল ভয়ে দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পারল পালাল ছুটে। কেবল একজন রইল দাঁড়িয়ে, তার নিজের জায়গায়, শক্ত গাছের মত সোজা হয়ে। তার চোখে ভয়ের চিহ্ন নেই একরত্তি। বরং তার ভয়হীন সরল মুখে কেমন একটা বেদনার আঁচড়। দস্যুদের দিকে সেই বেদনার চোখ তুলে বালকটি বললে, “পূর্বজন্মে তোমরা অনেক পাপ করেছ, এ জন্মে তাই তোমাদের এমন দুঃখের জীবন। বাঁচতে হয় চুরি করে। আর চুরি কোরো না। তাহলে পরের জন্মে আরও বেশী দুঃখ পাবে।”
এক ফোঁটা এক বালকের মুখে এমন অদ্ভুত জ্ঞানের কথা শুনে এমনি অভিভূত হয়ে গেল দস্যুরা যে পাকা ধানের দিক থেকে বাড়ানো হাত সরিয়ে নিয়ে, ফাঁকা হাতে তারা ফিরে চলে গেল মাঠ ছেড়ে।
এই বালকটিই ফা-হিয়েন। ছেলেবেলা থেকেই বাবা মা তাঁকে মানুষ করেছিল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর আদর্শে, আশ্রমে রেখে। চীনে তখন বৌদ্ধ ধর্ম ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে ঘরে। তৈরী হচ্ছে মঠের পর মঠ। বৌদ্ধশাস্ত্র অনুবাদ করা হচ্ছে চীনাভাষায়। তবুও কিছু কিছু সন্ন্যাসীর মনের তলায় রয়ে যাচ্ছে একটা গভীর সংশয়। তাঁরা প্রতিদিন যে সব আচার-আচরণ পালন করে চলেছেন, তার কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক, কোন জিনিষটার আসল মানে কি, এসব জানা যাবে কি করে? জানতে হলে একটাই পথ। সে হোল ভারতবর্ষে বুদ্ধের জন্মভূমিতে গিয়ে শিক্ষালাভ। সেখান থেকে বৌদ্ধশাস্ত্রের বইপত্র নিয়ে আসা। ফা-হিয়েনের বয়স যখন পঁচিশ, তিনিই নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এই গুরুভার। যাবেন ভারতবর্ষে। আনবেন বৌদ্ধশাস্ত্রের বইপত্র এবং বুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন।
মেগাস্থিনিসের ভারতে আসার পর ৭০০ বছর কেটে গেছে। মৌর্য সাম্রাজ্যের পর ভারতবর্ষে রাজত্ব করেছে বিদেশী কুষাণরা। কুষাণ রাজত্বের শ্রেষ্ঠ রাজা কনিষ্ক। তিনিও ছিলেন বৌদ্ধ। তারপর গুপ্ত সাম্রাজ্য। প্রথমে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। তারপর সমুদ্রগুপ্ত, তারপর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। ইতিহাসে বা উপকথায় সম্রাট বিক্রমাদিত্যের অনেক মজার মজার গল্প আছে। তালবেতাল, বত্রিশ সিংহাসন, আরও কত কি। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, এই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তই কিংবদন্তীর সেই বিখ্যাত বিক্রমাদিত্য। তাঁর আমলেই ফা-হিয়েন এসে পৌঁছলেন ভারতে। সঙ্গে পাঁচজন সঙ্গী। তখন পঞ্চম শতাব্দী। একশো বছর পার হয়ে গেছে বুদ্ধের মৃত্যুর পর। ফা-হিয়েন মেগাস্থিনিসের মত রাজদূত ছিলেন না। নিতান্তই পরিব্রাজক। ধর্মসম্বন্ধে জ্ঞানলাভই প্রধান উদ্দেশ্য। তার সঙ্গে ছিল আরও একটা কাজ। বৌদ্ধধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই ‘বিনয়-পিটক’-এর মূল পুঁথি সংগ্রহ করা। নিজের দেশে তাঁর গুরু ছিলেন কুমারজীব। চতুর্থ শতাব্দীতে গিয়েছিলেন চীনে। খ্যাতনামা লেখক ছিলেন তিনি। বই লিখেছেন প্রায় সাতচল্লিশটার মত। চীনা ভাষায় তর্জমা করেছেন বহু ভারতীয় বই। ভারতবর্ষে পা বাড়ানোর আগে যেদিন শিষ্য এসে প্রণাম জানালে গুরুর পায়ে, গুরু বললেন, ‘যদিও তোমার আসল কাজ ধর্ম বিষয়ে জ্ঞানলাভ, তবুও যে দেশে যাচ্ছ, সে দেশের সব কিছুই তাকিয়ে দেখো। তুমি ফিরে এলে, তোমার চোখ দিয়ে এ দেশের মানুষ যেন দেখতে পায় একটা গোটা ভারতবর্ষের ছবি।’
নিজের জন্মভূমি ছেড়ে পুরো চোদ্দ বছর ফা-হিয়েন ছিলেন বাইরে। ছ’ বছর কেটেছে আসা-যাওয়ায়, ছ’ বছর ছিলেন ভারতবর্ষে। দু’ বছর সিংহলে। যে ছ’ বছর ভারতবর্ষে কেটেছে, তার মধ্যে তিন বছর ছিলেন পাটলীপুত্রে। অর্থাত্ পাটনায়। শেষ দু’ বছর তাম্রলিপ্তিতে। অর্থাত্ তমলুকে। তাম্রলিপ্তি তখন ভারতের এক প্রসিদ্ধ বন্দর। পৃথিবীর নানান দেশের দিকে মুখ করে এই বন্দর থেকে ভাসতো সদাগরের সাতডিঙা, বাণিজ্য করতে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে রাজধানী ছিল দুটো। পাটলীপুত্রেরটা পুরনো। নতুন রাজধানী উজ্জয়িনীতে। এইখানেই ছিল তাঁর নবরত্ন সভা। মহাকবি কালিদাস সে সভার একজন সদস্য।
চীন থেকে ভারতবর্ষে আসার কোনো সোজা-সাপ্টা পথ আঁকা ছিল না তখন কোথাও। আসতে হতো বহু কাঠখড় পুড়িয়ে। পায়ের তলায় পাথর ভেঙে। ফা-হিয়েন এসেছিলেন রোদে জ্বলজ্বল বিরাট মরুভূমি গোবী পেরিয়ে খোটান। সেখান থেকে বরফেঢাকা পামীর পর্বতমালা ডিঙিয়ে সিন্ধু নদীর তীরে। সিন্ধু পেরিয়ে গান্ধার, তক্ষশীলা, পুরুষপুর। পুরুষপুর এখনকার পেশোয়ার। তারপর আফগানিস্থান ঘুরে মথুরা।
পায়ের যত ব্যথা, গায়ের যত ক্লেশ সব জুড়িয়ে গেল এক নিমেষে, ভারতের মাটিতে পা দিয়ে। একি অপূর্ব শান্তির দেশ! ফা-হিয়েনের চোখে পড়ল রাজার শাসনের কঠোরতার চেয়ে উদারতাই বেশী। শাস্তির দণ্ড বজ্রের মত কঠোর নয় কোনোখানে। অপরাধীদের প্রাণদণ্ড দেওয়া নিষেধ। যদি অপরাধ হয় রাজদ্রোহ, তবেই শাস্তির মাত্রা কিছুটা কঠিন। তখন ডান হাত কেটে দেওয়া হয় অপরাধীর। অন্য সময়ে শুধু অর্থদণ্ড। দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে অনুমতি বা পাশপোর্ট লাগে না কারো। প্রজারা পরিপূর্ণ স্বাধীন। বিচারের জন্যে আদালতে যেতে হোতো না কাউকে। বিষয়সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করার প্রয়োজন ঘটতো না কখনো। রাত্রে লোকে ঘুমোতে পারত ঘরের দরজা খুলে রেখে। রাস্তায় সোনা পড়ে থাকলেও কেউ তুলে নিয়ে পালাবে না। শহরে ধনীর সংখ্যা প্রচুর। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো কে কত ভাল কাজ করতে পারে।
যাতায়াতের পথঘাট, রাজপথ ছিল অনেক। রাজপথের ধারে ধারে সরাইখানা। দেশে দাতব্য চিকিত্সালয়। দরিদ্রদের পয়সা লাগে না চিকিত্সা করাতে। ওষুধপত্রও জোগানো হয় বিনামূল্যে।
সারা দেশে তখন বৌদ্ধধর্মের প্রভাব প্রবল। মানুষ তাই প্রাণীহত্যা করে না। বেশীরভাগ মানুষই নিরামিষাশী। পেঁয়াজ রসুন তখন অস্পৃশ্য। শুকর বা মোরগ প্রতিপালনের চেষ্টা করতো না কেউ। অবশ্য বনে গিয়ে শিকার করার রেওয়াজটা ছিলই। সেটা করতো শুধু রাজার লোকজন এবং ধনীরা। গুপ্তরাজারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের লোক। তবু বৌদ্ধদের প্রতি বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ নেই। সিন্ধু উপত্যকা থেকে মথুরায় বেড়ানোর সময় তাঁর চোখে পড়েছিল অসংখ্য বৌদ্ধমঠ। মথুরাতেই মঠের সংখ্যা কুড়ি। তাতে বাস করতো প্রায় তিন হাজার ভিক্ষু। অথচ মথুরা হিন্দু ব্রাহ্মণদেরও তীর্থস্থান।
ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকেই আমরা জানতে পারি, বুদ্ধ যখন বেঁচে ছিলেন তখন তাঁর একটি মূর্তি গড়িয়েছিলেন কোশলের রাজা প্রসেনজিত্। তিনি ছিলেন বুদ্ধের সমসাময়িক। মূর্তিটি গড়িয়েছিলেন চন্দনকাঠ দিয়ে। প্রতিদিন পুজো করতেন সেই মূর্তিকে। সেই প্রথম মূর্তি বুদ্ধের। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বুদ্ধের নানা স্মৃতিচিহ্ন ও দেহাবশেষ নিজের চোখে দেখেছেন তিনি। যেমন কাশ্মীরে দেখেছেন বুদ্ধের একটি দাঁত এবং একটি পিক্দানি। গান্ধারে দেখেছেন পাথরের গায়ে বুদ্ধের পায়ের ছাপ। পেশোয়ারে কনিষ্কের তৈরী এক বৌদ্ধ স্তূপের ভিতরে তিনি দেখেছেন বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্র, একখণ্ড অস্থি আর তাঁর ব্যবহৃত চন্দনকাঠের আসবাব। অন্য এক পাথুরে গুহায় তিনি দেখেছেন বুদ্ধের এমন এক মূর্তি, সে যেন তাঁর জীবন্ত চেহারার মত উজ্জ্বল। অনেক বৌদ্ধ বিশ্বাস করতো, বুদ্ধদেব তাঁর নিজের ছায়া রেখে গেছেন এই মূর্তিতে। এ মূর্তি দেখা মানেই স্বয়ং বুদ্ধকে দেখা। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী না হলে এ মূর্তির দর্শন পাওয়াও দুর্লভ।
আরো এক বিচিত্র গুহার বর্ণনা আছে তাঁর লেখায়। একটা প্রকাণ্ড পাহাড় কেটে গড়া পাঁচতলা গুহা। নীচের তলার আকৃতি হাতির মত। তাতে পঁচিশটা ঘর। দোতলার আকৃতি সিংহের মত। তাতে চারশো। তিনতলার আকৃতি ঘোড়ার মত। তাতে তিনশোটা। চারতলার ষাঁড়ের আকৃতি। তাতে দুশোটা। পাঁচতলার আকৃতি একটা পায়রার মত। তাতে ঘরের সংখ্যা একশ’। মাথার উপরে ঝর্ণা। সেখানে ঝরে ঝরে আসে খাবার জল। পাথর কেটেই জানলা। যাতে ঘরে আসে রোদ, আলো, বাতাস। একটা ঘণ্টা বাজলে সন্ন্যাসীরা খেতে বসেন এক সঙ্গে, নীরবে। হাত তুললে খাবার আসে। এই গুহায় তিনি কাটিয়েছেন তিন বছর। উত্সবের দিনের শোভাযাত্রা দেখেছেন ফা-হিয়েন। বুদ্ধ এবং হিন্দুর দেবতার মূর্তি যায় শোভাযাত্রার আগে, সুসজ্জিত গাড়িতে। গাড়ি সাজানো হয় বহু রঙের সিল্কের চাঁদোয়া আর পতাকা দিয়ে। পুজোর সময় রাজা রানী দেবতার আরতি করেন সুগন্ধী ধূপ ধূনো এবং ফুল দিয়ে। পুজো শেষ হলে দরিদ্রদের দান করেন নানা উপহার।
পাটলীপুত্রে সম্রাট অশোকের রাজগৃহ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ফা-হিয়েন। তিনি লিখেছেন, ‘পাটলীপুত্র শহরের মাঝখানে অশোকের রাজপ্রাসাদ। আগের মতই উজ্জ্বল এখনো। এই রাজগৃহের পাথর, দেওয়াল, তোরণদ্বার এবং খোদাই ও ভাষ্কর্য্যের কাজ এমন সুনিপুণ যা জগতের আর কোন মানুষের পক্ষে গড়া সম্ভব নয়। সব দেখে শুনে, ফা-হিয়েন পাটলীপুত্রের নাম দিয়েছিলেন ‘ফুলের শহর’। অশোকের আমলে পাহাড় কেটে গুহা তৈরী হয়েছে অজস্র। তিনি নিজেই গড়ে দিয়েছিলেন প্রায় আশী হাজারের মত গুহা। সে সব গুহার বাইরেটাই পাথরের মত রুক্ষ। কিন্তু ভেতরটা এমনভাবে পালিশ করা, মনে হবে কাচ বসানো বুঝি। এক-পাথরে গড়া স্তম্ভ, শিলালিপির খোদাই, এসবও স্তম্ভিত করেছিল ফা-হিয়েনকে। তখনকার কালে বেশীর ভাগ বাড়ি-ঘরই তৈরী হত কাঠ দিয়ে। তবে ইটের চলও শুরু হয়েছে অল্প সল্প। দেশে মুদ্রার প্রচলন ছিল। নাম ‘দিনার’। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম এত সস্তা যে, সাধারণ মানুষ কড়ি দিয়েই চালাতো কেনা কাটার কাজ।
রাজার আয়ের প্রধান উত্স, ‘ভাগ’। ‘ভাগ’ হল জমিতে জন্মানো ফসলের ছ’ ভাগের এক ভাগ অংশ। রাজার পাওনা সেটাই। এছাড়াও রাজার রোজগার ছিল অন্য উপায়ে। ছিল নদীতে খেয়া বাইবার কর। বাণিজ্যের বা ব্যবসার শুল্ক। সৈন্য সামন্ত দিয়ে চারপাশ ঘিরে রাখা দুর্গের মধ্যে কেউ যদি নিরাপদে বাস করে, তার কর। বিনা পারিশ্রমিকে কখনো কখনো কাজ করতে হয়েছে রাজার। এছাড়া অন্যান্য রাজ কর্মচারীরা পেত মাস মাইনে। চাকরীতে মাইনের বদলে জমি বা জায়গীর দেওয়ার চল হয়নি তখনো।
তখন সাধারণের মধ্যে একটা সংস্কার ছিল প্রবল। সেটা হল অস্পৃশ্যতা। সমাজে চণ্ডালের ঠাঁই ছিল না। তারা থাকতো শহরের বাইরে। শহরে বা বাজারে ঢোকার আগে কাঠের উপরে আওয়াজ তুলে তাদের সংকেত জানাতে হতো। লোকে সরে যেতো দূরে, পাছে মাড়িয়ে ফেলে তাদের ছায়া, অথবা চোখে পড়ে যায় তাদের মুখ।
ফা-হিয়েন যে-সময়ে ভারতবর্ষে এসেছিলেন সেটা ভারতের স্বর্ণযুগ। সোনার রঙের রোদের মত আলো যেন ফুটে বেরুতো সারা দেশের শিল্প সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের গা থেকে। তখনকার শ্রেষ্ঠ কবিরা হলেন কালিদাস, শূদ্রক, বিশাখদত্ত। গণিতশাস্ত্রে আর্যভট্ট। জ্যোতিষে বরাহ-মিহির। শিল্পে অজন্তা ইলোরা। বৌদ্ধ স্তূপে সাঁচী, সারনাথ, ভারহূত। শিক্ষায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। বাণিজ্য চলেছে দেশ বিদেশের সঙ্গে। উপনিবেশ গড়ে উঠেছে নানা জায়গায়। এশিয়ার দেশে দেশে, বিশেষ করে চীনে ছড়িয়ে পড়েছে বুদ্ধের বাণী। সব মিলিয়ে ফা-হিয়েনের আমলের ভারতবর্ষ যেন এক স্বপ্নের দেশ। সৌভাগ্যেরও।
সুত্র: আনন্দ বাজার