প্রবল শ্রদ্ধায় বুদ্ধকে পুষ্প দান করে সুমন মালাকার কী সুফল পেলেন?
ইলা মুৎসুদ্দী
‘সুমন নামে মালাকার রাজা বিম্বিসারকে প্রত্যহ আট কেজি পরিমাণ সুমন পুষ্পের যোগান দিতেন আর তার বিনিময় মূল্যেই পরিবারের ভরণ পোষণ চালাতেন। সে একদিন সেই পুষ্প রাজবাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার পথে ষড়রশ্মি বিচ্ছুরিত সপরিষদ বুদ্ধকে রাজপথে দেখতে পেলেন। সুমন তাদৃশ অপূর্ব দৃশ্যে অভিভূত হয়ে ভাবতে লাগলো আমাদের রাজা মহাপূণ্যবান বলে নিজের যেমন ভোগেশ্বর্যের কোন অভাব নেই, বুদ্ধ ও বুদ্ধ শিষ্যদেরকে পূজা করার মতো মহাপূণ্য সঞ্চয়ে ও কোন বাঁধা নেই। আমি এমনই হতভাগা যে মহান বুদ্ধকে কোন দিন কিছুই দান দিতে পারিনি।
আজ আমি যদি এই পুষ্পরাজি রাজাকে না দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করি তাতে রাজা ত্র“দ্ধ হবেন এবং পরিণতিতে আমাকে হত্যাও করতে পারেন। অতীতে কতো জন্ম নিয়েছি, কিন্তু বুদ্ধকে দান দেওয়ার, পূজা করার সৌভাগ্য হয়নি বলে এজন্মে আমি দুঃখ দারিদ্রতার কষাঘাতে আজ জর্জরিত। আমার জীবন যাক, তবু ও আজকে বুদ্ধকে পূজা করার যেই সুযোগ আমার এক্ষণে উপস্থিত হয়েছে, তা আমি কিছুতেই হাতছাড়া করবো না। জীবন বাজি রেখেই সুমন মালাকার তখন গভীর শ্রদ্ধায় বুদ্ধকে প্রাণ ভরে পুষ্প সম্প্রদান পূজা করলেন।
আশ্চর্য অম্ভুত এক দৃশ্যের অবতারণা হলো, সুমন মালাকার তদগত চিত্তে যখন গমণরত বুদ্ধের সম্মুখে পুষ্পরাশি ছিঁটাতে থাকলেন। তাঁর পুষ্প রাশির কিছু বুদ্ধের মাথার উপরে ছাতার ন্যায়, কিছু বুদ্ধের পেছনে পর্দার ন্যায়, কিছু পুষ্প বুদ্ধের ডানে – বাঁয়ে মালার ন্যায় শূন্যে স্থিত হলো। সুমন মালাকার মহান বুদ্ধের এই মহনীয়তা দর্শনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নৃত্য শুরু করে দিলেন। নগরবাসী ও বুদ্ধের এহেন পূণ্য ঋদ্ধি দর্শনে বুদ্ধকে দান দিতে ভেঙ্গে পড়লেন। আর বিশাল জনস্রোত ভিক্ষু সংঘের সংগে যোগদিয়ে বুদ্ধের অনুগামী হলেন বিশাল শোভাযাত্রা সহকারে।
এই অভূত পূর্ব দৃশ্যে সুমন মালাকারের দেহ মন পঞ্চ প্রীতিতে পরিপূর্ণ হলো, বিদ্যুত চমকানোর মতো প্রীতি যেন তাঁর সারাদেহকে পুণঃপুনঃ শিহরিত করতে থাকলো। কিন্তু দরিদ্রের জীর্ণ-শীর্ণ দেহ আর জীর্ণ মলিন বস্ত্র নিয়ে এই সুসজ্জিত শোভা যাত্রায় যোগদানে তার লজ্জা উৎপন্ন হলো। তবুও আজকে তার দানের এ দৃশ্য মনে ধারণ করে আনন্দে প্রীতিতে তন্ময় হয়ে ধীরে ধীরে বাড়ীতে ফিরে গেলেন। পতœীকে গভীর আগ্রহ ভরে বর্ণনা করলেন আজকের পুরো ঘটনা।
কিন্তু পতœী সুমনে এতসব কথায় মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারলো না। রাজরোষের আতংকে সে বার বার শিহরিত হতে লাগলো। কি জানি কী বিপর্যয় ধেঁয়ে আসছে তার স্বামীর জীবনে, এই দুশ্চিন্তায় সে স্নান আহারের কথা পর্যন্ত ভুলে গেল।
বহু রাস্তা ঘুরে বুদ্ধ তথাগত বিপুল জনতা সহ ভিক্ষু সংঘকে নিয়ে রাজ প্রসাদ প্রাঙ্গণে সকলের দান গ্রহণ করলেন। আলৌকিক পুষ্প সজ্জায় সুসিজ্জত বুদ্ধ আর বিম্ময়কর শোভাযাত্রা দর্শনে রাজা শ্রদ্ধায় আনন্দে অভিভূত হলেন। তিনি স্ব হস্তে বুদ্ধ প্রমূখ ভিক্ষুসংঘকে দান দিলেন। মহাকারুণিক বুদ্ধ রাজপরিষদ সহ বিশাল জন সমাবেশের উদ্দেশ্যে ধর্মদেশনা করলেন। অতঃপর বেণুবন গন্ধ কুঠির পর্যন্ত বুদ্ধকে রাজা পৌঁছে দেয়া মাত্রই গন্ধকুঠির দ্বারে সুমন মালাকারের পূজিত পুষ্প রাশি ভূমিতে পতিত হলো।
মগধরাজ বিম্বিসার স্বচক্ষে এ বিস্ময়কর দৃশ্য অবলোকন করে অনুসন্ধানে জানতে পারলেন, সুমন মালাকার প্রতিদিন রাজাকে যেই পুষ্প সরবরাহ করতো আজ তার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে রাজার পুষ্প দিয়েই সে আজ বুদ্ধকে পূজা করেছে। রাজাজ্ঞা লঙ্ঘনের শাস্তি তো দূরের কথা, সাধু! সাধু! বলে রাজা সুমন মালাকারের এ পূজাকে তিনি অনুমোদন করলেন। আর সেই সাথে নির্দেশ দিলেন সুমন মালাকারের দারিদ্রতা যেন চিরতরে অবসান হয় সে ব্যবস্থা করতে।
এ প্রসঙ্গে বুদ্ধ তথাগত সেবক আনন্দকে বলেছিলেন “ধর্ম -পুন্য অর্জনে জীবনের মায়া ত্যাগ করে প্রবল শ্রদ্ধায় বুদ্ধাদির মতো মহাগুণীকে সেবা পূজা দানের সুফল প্রত্যক্ষ জীবনে যেখানে এমন হয়ে থাকে, পরজন্মে তার বিপাক আরো ব্যাপক বিশালই যে হবে, তাতে সন্দেহ কি? হে আনন্দ! অনন্ত গুণ সম্পন্ন বুদ্ধকে এমন চিত্ত দ্বারা পূজার প্রভাবে এই সুমন মালাকার এক সময়ে প্রত্যেক বুদ্ধত্ব অর্জন করে মহাপরিনির্বাণে নির্বাপিত হবে।
সূত্র ঃ গল্পে গল্পে মহামঙ্গল, অনুবাদক প্রজ্ঞাবংশ মহাস্থবির