জীবন দুক্খময় এবং পরিত্রাণের উপায়
নশ্বর সুজয়
“অনিত্য, দুঃখ, অনাত্ম” (অঙ্গুত্তরনিকায়: ৩/১/৩৪)- এই একটিমাত্র সূত্রেই বুদ্ধের সমস্ত দর্শন গ্রথিত আছে বলে বৌদ্ধ পণ্ডিতদের অভিমত। এই সূত্রের মূল বক্তব্য হচ্ছে-
‘সর্বং অনিচ্চং, সর্বং দুক্খং, সর্বং অনাত্মং।’ (অঙ্গুত্তরনিকায়-৩/১/৩৪)
অর্থাৎ : যা কিছু সমস্তই অনিত্য, সমস্তই দুঃখ, সমস্তই অনাত্ম।
বুদ্ধমতে অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম এই তিনটি বিষয়ে সম্যক জ্ঞান না থাকাই হচ্ছে অবিদ্যার লক্ষণ। অতএব, বৌদ্ধদর্শনের প্রতিপাদ্য বিষয়ই হলো এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ। তবে বুদ্ধের মতবাদের দার্শনিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার যে, গৌতম বুদ্ধ কোন অধিবিদ্যা বা আধ্যাত্মবাদের দার্শনিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন নি। তিনি সংসারের ক্লেশকর প্রপঞ্চগুলো থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় হিসেবে কিছু আচারমার্গের নীতিপন্থা প্রচারেই আগ্রহী ছিলেন।
তাই সাগ্রহে না হলেও বুদ্ধ কতকগুলি দার্শনিক তত্ত্ব-বিষয়ে তাঁর স্বাধীন ও স্বকীয় সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। বলাই বাহুল্য যে, তাঁর দার্শনিক মত অত্যন্ত দুরূহ ও অনন্যসাধারণ। তাঁর অনেক সিদ্ধান্তই সাধারণ মানুষের সংস্কারকে রীতিমতো বিচলিত করে।
সর্বগ্রাসী দুঃখের কারণ এবং তা থেকে মুক্তির উপায় সন্ধানই গৌতম বুদ্ধের সাধনার লক্ষ্য। জগত দুঃখময়, দুঃখের কারণ আছে এবং দুঃখ নিরোধ সম্ভব, এই দুঃখরহস্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়েই বুদ্ধের সাধনায় সিদ্ধিলাভ। এবং এই দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে আচারমার্গের নির্দেশনাই বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মমত। গোটা বৌদ্ধমত দুঃখকেন্দ্রিক চারটি আর্যসত্য নির্ভর। সবকিছু ছাপিয়ে দুঃখই সত্য বলে বৌদ্ধদর্শন মূলত দুঃখবাদেরই নামান্তর। তথাগত বুদ্ধ স্বয়ং বলেছেন-
‘জাতি পি দুক্খা, জরা পি দুক্খা, ব্যাধি পি দুক্খা, মরণং পি দুক্খং, সোক-পরিদেব-দুক্খদোমনস্স-উপায়াসা পি দুক্খা, যং পি ইচ্ছং ন লভতি তং পি দুক্খং, সংকখিত্তেন পঞ্চুপাদানক্খন্দা দুক্খা।’- (মহা সতিপতানসূত্ত-২২/১৮)
অর্থাৎ : জন্মে দুঃখ, নাশে দুঃখ, রোগ দুঃখময়, মৃত্যু দুঃখময়। অপ্রিয়ের সংযোগ দুঃখময়, প্রিয়জনের বিয়োগ দুঃখময়। রোগ হতে উৎপন্ন পঞ্চস্কন্ধ দুঃখময়। সকল কিছু দুঃখময়।
.
এই দুঃখ অল্প নয়, প্রচুর, অপর্যাপ্ত। ‘ধম্মপদে’র জরাবর্গে তিনি বলেছেন-
‘অনেকজাতি সংসারং সন্ধাবিস্সং অনিব্বিসং,
গহকারকং গবেসন্তো, দুক্খা জাতি পুনপপুনং।’ (ধম্মপদ-জরাবর্গ-৮)
অর্থাৎ : এ (দেহরূপ) গৃহের নির্মাতাকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে (জ্ঞানাভাবে) তাকে না পেয়ে আমি বহু জন্মজন্মান্তর সংসার পরিভ্রমণ করলাম। বার বার জন্ম গ্রহণ করা দুঃখজনক।
সংসার দুঃখেই পরিপূর্ণ। এবং সকল দুঃখের নিদান যে প্রকৃতপক্ষে পঞ্চস্কন্ধরূপ দেহ ও দেহ-সম্পর্কিতই, ধম্মপদের সুখবর্গে বুদ্ধ-বচনে তা-ই প্রতিধ্বনিত হয়েছে-
‘নত্থি রাগসমো অগ্গি নত্থি দোসসমো কলি,
নত্থি খন্ধাসমা দুক্খা নত্থি সন্তিপরং সুখং।’ (ধম্মপদ-সুখবর্গ-৬)
অর্থাৎ : আসক্তির (রাগ) ন্যায় আগুন নেই, দ্বেষের সমান পাপ কলি নেই, পঞ্চস্কন্ধের মতো দুঃখ নেই এবং নির্বাণের চেয়ে সুখ নেই।
কার্যে কারণে সবকিছুতেই দুঃখের এই বিপুল উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কেউ কেউ বৌদ্ধদর্শনকে নৈরাশ্যবাদী দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেন, যার সাথে কিছুতেই একমত হওয়া সম্ভব নয়। কেননা সবকিছুই দুঃখময় হলেও চূড়ান্ত বিচারে এই দুঃখ নিবৃত্তিই বৌদ্ধদর্শনের অনিবার্য লক্ষ্য। বরং বৌদ্ধদর্শন চমৎকারভাবে একটি আশাবাদপূর্ণ দর্শন। কেননা সবকিছুই দুঃখময় হলেও চূড়ান্ত বিচারে এই দুঃখ নিবৃত্তিই বৌদ্ধদর্শনের অনিবার্য লক্ষ্য। বুদ্ধের উপদেশ-সংবলিত ‘ধম্মপদে’র ‘পিয়বগগে’ তিনি বলে গেছেন-
‘মা পিয়েহি সমাগঞ্ছি অপ্পিয়েহি কুদাচনং,
ডপয়ানং অদস্সনং দুক্খং অপ্পিয়ানঞ্চ দস্সনং।’ (ধম্মপদ-প্রিয়বর্গ-২)
‘তস্মা পিয়ং ন কয়িরাথ পিয়াপায়োহি পাপকো,
গন্থা তেসং ন বিজ্জন্তি যেসং নত্থি পিয়াপ্পিয়ং।’ (ধম্মপদ-প্রিয়বর্গ-৩)
‘পিয়তো জায়তে সোকো পিয়তো জায়তে ভয়ং,
পিয়তো বিপ্পমুত্তস্স নত্থি সোকো কুতো ভয়ং।’ (ধম্মপদ-প্রিয়বর্গ-৪)
‘পেমতো জায়তে সোকো পেমতো জায়তে ভয়ং,
পেমতো বিপ্পমুত্তস্স নত্থি সোকো কুতোভয়ং।’ (ঐ-৫)
‘রতিয়া জায়তে সোকো রতিয়া জায়তে ভয়ং,
রতিয়া বিপ্পমুত্তস্স নত্থি সোকো কুতো ভয়ং।’ (ঐ-৬)
‘কামতো জায়তে সোকো কামতো জায়তে ভয়ং,
কামতো বিপ্পমুত্তস্স নত্থি সোকো কুতো ভয়ং।’ (ঐ-৭)
‘তণ্হায় জায়তে সোকো তণ্হায় জায়তে ভয়ং,
তণ্হায় বিপ্পমুত্তস্স নত্থি সোকো কুতোভয়ং।’ (ঐ-৮)
অর্থাৎ :
প্রিয় কিংবা অপ্রিয় কোন কিছুতে অনুরক্ত হয়ো না। কারণ প্রিয়বস্তুর অদর্শন এবং অপ্রিয়বস্তুর দর্শন উভয়ই দুঃখজনক (প্রিয়বর্গ-২)। তাই (কোন বস্তু বা ব্যক্তির) প্রিয়ানুরাগী হয়ো না, প্রিয়বিচ্ছেদ দুঃখজনক। যাঁর প্রিয়-অপ্রিয় কিছুই নেই তাঁর কোন বন্ধন থাকে না (প্রিয়বর্গ-৩)। প্রিয় থেকে শোক উৎপত্তি হয়; প্রিয় থেকে ভয় উৎপত্তি হয়। যিনি প্রিয়াসক্তি থেকে উত্তীর্ণ তাঁর শোক থাকে না, ভয় থাকবে কিভাবে? (প্রিয়বর্গ-৪) প্রেম থেকে… আসক্তি (রতি) থেকে… কাম (বিষয়-বাসনা) থেকে… তৃষ্ণা থেকে শোক উৎপত্তি হয় ; প্রেম…আসক্তি…কাম…তৃষ্ণা থেকে ভয় উৎপত্তি হয়। যিনি প্রেম…আসক্তি…কাম…তৃষ্ণা থেকে উত্তীর্ণ তাঁর শোক থাকে না, ভয় থাকবে কিভাবে?- (ধম্মপদ-প্রিয়বর্গ-৫-৮)।
নিজের অবিদ্যাপ্রসূত কর্ম দ্বারাই মানুষ দুঃখকে বরণ করে জন্মশৃঙ্খলে বন্দি হয়, আবার সম্যক জ্ঞানের মাধ্যমে অবিদ্যা দূর করে নির্বাণলাভের মাধ্যমে মানুষ এই জন্মরূপ দুঃখ থেকে পরিত্রাণও পেতে পারে। এজন্যে মানুষকে অন্য কোন অলৌকিক নিয়ন্ত্রকের অধীনস্থ হতে হয় না। ধম্মপদের দণ্ডবগগো’তে তাই বুদ্ধ বলেছেন
‘অস্সো যথা ভদ্রো কসানিবিট্ঠো
আতপিনো সংবেগিনো ভবাথ,
সদ্ধায় সীলেন চ বিরিয়েন চ
সমাধিনা ধম্ম বিনিচ্ছয়েন চ,
সম্পন্ন বিজ্জাচররণা পতিস্সতা
পহস্সথ দুক্খমিদং অনপ্পকং। (ধম্মপদ-দন্ডবর্গ-১৬)
অর্থাৎ : কশাঘাত ক্লিষ্ট ভদ্র অশ্ব যেমন ক্ষিপ্র ও বেগবান হয়, তেমনি শ্রদ্ধা, শীল, বীর্য, সমাধি ও ধর্ম বিনিশ্চয় প্রজ্ঞায় বিদ্যাচরণ সম্পন্ন ও স্মৃতিমান হও। তাহলে দুঃখরাশিকে অপনোদন করতে পারবে।
এবং সংযুক্তনিকায়ে নির্বাণার্থি ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে বুদ্ধ বলেছেন (মজ্ঝিমনিকায়-১০৪ সূত্রেও বুদ্ধের অনুরূপ বাণী রয়েছে)-
‘সেয্যথাপি ভিক্খবে! তেলং চ পটিচ্চ বট্টিং প পট্টিচ্চ তেলপ্ পদিপো ঝায়েয্য, তত্র পুরিসো ন কালেন কালং তেলং আসিঞচেয্য, ন বট্টিং চ উপসংহরেয্য। এবং হি সো ভিক্খবে! তেলপ্পদিপো পুরিমন চ উপাদানস্স পরিযাদানা অঞ্ঞস্সচ অনুপাহারা অনাহারো নিব্বায়েয্য। এবং এব খো ভিক্খবে! সঞযোজনীয়েসু ধর্মেসু আদীনবানুগস্সিনো বিহরতো তণ্হা নিরুজ্ঝতি, তণ্হানিরোধা উপাদান-নিরোধোপি। এবং এতস্স কেবলস্স দুক্খখন্ধস্স নিরোধো হোতি।’- (সংযুক্তনিকায়)
অর্থাৎ :
হে ভিক্ষুগণ! তৈল ও বর্তি সংযোগে প্রজ্বলিত প্রদীপে যদি কেউ আর তৈল ও বর্তি যোগ না করে তবে প্রদীপ যেমন উপাদানের অভাবে নির্বাপিত হয়, সেইরূপ যিনি সমস্ত সংযোজনের অস্থিরত্ব উপলব্ধি করে অনাহারে বিচরণ করেন, তাঁর তৃষ্ণা নিরুদ্ধ হয়, তৃষ্ণা-নিরোধে উপাদান নিরুদ্ধ হয় এবং দুঃখের নিদান পঞ্চস্কন্ধের নিরোধ হয়।
এছাড়াও বুদ্ধ দুক্খের আদি – অন্ত বুঝাতে প্রতীত্যসমুৎপাদের ব্যাখ্যা করেন। “প্রতীত্যসমুৎপাদ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘একটি বস্তুর কিংবা ঘটনার অধীনে বা উপস্থিতিতে (আগমনে) অন্য কোন বস্তুর বা ঘটনার উৎপত্তি’। মজ্ঝিমনিকায় (১/৪/৮) বলা হচ্ছে-
‘অস্মিন্ সতি ইদং ভবতি’-(মজ্ঝিমনিকায়-১/৪/৮)
অর্থাৎ : ‘এটি ঘটবার পর ওটি ঘটছে’।
প্রতীত্যসমুৎপাদকে সমগ্র বৌদ্ধদর্শনের আধার বলা হয়। স্বয়ং বুদ্ধের বাণী থেকেই জানা যায়-
“যিনি প্রতীত্য-সমুৎপাদকে দেখেন, তিনি ধর্মকে (বৌদ্ধদর্শন) দেখতে পান, যিনি ধর্মকে দেখেন তিনি প্রতীত্য-সমুৎপাদকে দেখেন। পঞ্চ উপাদান স্কন্ধও প্রতীত্য সমুৎপন্ন।” (মজ্ঝিমনিকায়: ১/৩/৮)।
প্রতীত্য-সমুৎপাদের নিয়মকে মানব ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে বুদ্ধ দ্বাদশাঙ্গ প্রতীত্য-সমুৎপাদের কথা বলেছেন। প্রাচীন উপনিষদের কয়েকজন ব্রাহ্মণ আচার্য নিত্য, ধ্রুব, অবিনশ্বরকে আত্মা বলেছেন। কিন্তু বুদ্ধের প্রতীত্য-সমুৎপাদে আত্মা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। এজন্যে আত্মাবাদকে তিনি মহা অবিদ্যা বলেছেন।
বুদ্ধ স্বয়ং বলেছেন-
‘যে প্রতীত্যসমুৎপাদ জানে সে ধর্ম জানে, যে ধর্ম জানে সে প্রতীত্যসমুৎপাদ জানে।’- (মজ্ঝিমনিকায়-২২)