বর্তমান তথা বুদ্ধ যুগে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা
কতটুকু প্রকৃতির সান্নিধ্যে ছিলেন?
নশ্বর সুজয়
.
পালি সাহিত্য কত যে বিশাল ও ব্যপক তা চর্চা না করলে বুঝা অসম্ভব। পালি সাহিত্যে ত্রিপিটক ছাড়াও অগণিত বৌদ্ধ গ্রন্থ আছে যেখানে বুদ্ধ যুগের শিল্প ,সংস্কৃতি ,প্রাকৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার সকল দিক তুলে ধরা হয়েছে। হয়তো এদিকে আমি খুবই ভাগ্যবান, জীবন চলার পথে এমন কিছু সৎ কল্যাণমিত্রের সান্নিধ্য ও সঙ্গ লাভ করেছি। যেদিন ৬ষ্ঠ সঙ্গায়নের মূল পালি সিডি কপি হস্তগত হয় সেদিন থেকে মনে মনে গতির সঞ্চার অনুভব করি। তাই একটু আর্ধু চর্চা করতে চেষ্টা করি মাত্র।
.
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ উক্তি করেছেন- উপন্যাস যদি লিখতে চাও তাহলে জাতক পড়; জাতক পড়।
কেননা এখানে অধ্যাত্ম তত্ত্ব বিশ্লেষণের সাথে সাথে প্রাকৃতিক রূপ বর্ণনায় সাহিত্যের বৃহত্তর একটি অংশকে বিশেষভাবে পরিপুষ্ট করেছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্য বর্ণনার এমন সহজ ও সুন্দর প্রকাশ ত্রিপিটক ব্যতীত পৃথিবীর যে কোন সাহিত্যে সুদুর্লভ। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে তপশ্চর্যা বুদ্ধশিষ্যদের কন্ঠে উচ্চারিত প্রাকৃতিক রূপ বর্ণনার বহু সুন্দর ও সাবলীল অপদান দেখলে অবাক্ হতে হয়।
.
তথাগতের নির্দেশানুযায়ী শ্রাবকসংঘ সাধনায় প্রবিষ্ট হয়ে জীবনের মহত্তম জ্ঞান লাভ করার পর নির্বাণ মুক্তির আনন্দে যে সকল উচ্ছ্বাস গাথা আবৃত্তি করেছিলেন তাতে বুঝাযায় প্রাকৃতিক পরিবেশ সাধক পুরুষদের পক্ষে কতখানি উপযুক্ত এবং এখান থেকেও সত্য লাভের জ্ঞান আহরণ করা কত সম্ভব তার সহজ প্রকাশ সুন্দর ভাবেই ব্যক্ত হয়েছে ত্রিপিটকে।
শান্ত নদীতটে ,রমণীয় বনখন্ডে, পর্বত কন্দরে, গিরি শিখরে সমাধি মগ্ন হয়ে যোগীপুরুষ প্রাকৃতিক রূপ পরিবর্তনের যে কী গভীর আনন্দ অনুভব করেন তা সপ্পক স্থবির ও গিরিমানন্দ স্থবিরের জীবনীতে আমরা দেখতে পাই। (থেরগাথা অট্ঠকথা এবং থের অপদান মূলপালি)
.
সপ্পক ছিলেন শ্রাবস্তীর সুখ্যাত কূলীন ব্রাম্মণ পরিবারের সন্তান। বুদ্ধের গুণমহিমায় উপযুক্ত বয়সে ভিক্ষু ধমর্ে দীক্ষিত হন। স্বীয় চিত্তশুদ্ধির তথা প্রকৃতির মাঝে নিজেকে আরো গভীরতর উপলব্ধি করতে অজকরনী নদীতারস্থ এক আবাসে বাস করতেন। বেশ অল্প কয়েক দিনে তা তিনি অধিগতও করেন। অতপর সেই শান্ত সৌম্য মুক্ত পুরুষ প্রকৃতির মাঝে কতটুকুই বিবেকানন্দ লাভ করা যায়
তা তিনি ছন্দে ছন্দে নিনাদ করেন –
.
যদা বলাকা সুচিপণ্ডরচ্চদা
কালস্স মেঘস্স ভযেন তজ্জিতা;
পলেহিতি আলযমালযেসিনী
তদা নদী অজকরনী রমেতি মং।
যদা বলাকা সুচিপণ্ডরচ্চদা
কালস্স মেঘস্স ভযেন তজ্জিতা;
পরিযেসতি লেনমলেনদস্সিনী
তদা নদী অজকরনী রমেতি মং।
কন্নু তত্থ ন রমেন্তি জম্বুযো উভতো তহিং;
সোভেন্তি আপগা কূলং মম লেনস্স পচ্ছতো। (মূল পালি সংক্ষেপণ করা হল)
অর্থাৎ – ধবল পালকাবৃত বলাকাপাল যখন কালো মেঘের বিকট নাদে চরনভূমি ত্যাগ করে ঝোপঝাড়ে লুকাতে উদ্গত হয় তখন কি অপরূপ শোভাময় হয় অজকরনীর দু,কুল। জলরাশি দু;কুল প্লাবিত করে নিজ গতিতে দূর দিগন্তে মিশে যায়। এদিকে বলাকাদল আশু বৃষ্টির ভয়ে স্বীয় নিড় নির্মাণে নিমগ্ন থাকে। প্রকৃতির এমন দৃশ্য আমার বিবেক সুখের সঞ্চার করে। আমার আবাস পশ্চাতে বেগবান অজকরনীর দু,কুল জম্বুকবৃক্ষ ফুলে ফলে নত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সর্পভয় উপেক্ষা করে ভেকপাল (বেঙ) স্বশব্দে চারিদিক মুখরিত করে তুলেছে। এদিকে বৃষ্টিদেব জলানন্দে গিরি নদী দুটোকে এক সূত্রে বেধে একীভূত করে রেখেছে। আমি খুব চিত্ত সুখে অবস্থান করছি। প্রকৃতির এরূপ শত শত রূপলীলায়
আমার গৃহ শোভাময় করে রেখেছে। আমি বিবেকানন্দে খুবই রমিত। (অনুবাদ-নশ্বর সুজয়)
এদিকে গিরিমানন্দ স্থবিরও বর্ষাঋতুর তথা প্রকৃতির গুণকীর্তন এভাবেই করেছিলেন-
স্থান -রাজগৃহ।
পালি- বস্সতি দেবো যথা সুগীতং ছন্ন মে কুটিকা সুখা নিবাতা, তস্স বিহারামি বূপসন্তো অথ চে পত্থযসি পবস্স দেব।
বস্সতি দেবো যথা সুগীতং ছন্না মে কুটিকা সুখা নিবাতা,
তস্সং বিহরামি সন্তচিত্তো বীতরাগো বীতদোসো বীতমোহো অথ চে পত্থযসি পবস্স দেব। (সংক্ষেপিত)
অর্থাৎ – হে মেঘমালা তুমি সুগর্জনে যত ইচ্ছে বর্ষণ কর, আমার কুটির সুরূপে আচ্ছাদিত আছে। তোমার এই বিরামহীন বর্ষণ আমার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের মতোই প্রতিভাত হচ্ছে। আমি শান্ত চিত্তে বীতরাগ বীতদোষ ও বীতমোহে বিবেকানন্দে কুটিকায় তোমার বর্ষণ উপভোগ করছি। তুমি যত খুশী বর্ষণ করো। (অনুবাদ- সুজয় বড়ুয়া)
এমন দিনে তারে বলা যায়,/ এমন ঘনঘোর বরিষায়।/ এমন দিনে মন খোলা যায়-/ এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে/ তপনহীন ঘন তমসায়।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এ পংক্তির মতো বাঙালির মন বর্ষায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে এভাবেই। বিরহী প্রেমিক বর্ষায় ফোটা প্রেমের প্রতীক কদম ফুল হাতে প্রেম নিবেদন করতে চায় প্রেমিকাকে।
মনে হয়, এই যেন মাহেন্দ্রক্ষণ। বর্ষা এভাবেই শত শত বছর ধরে আকুল করে এসেছে সকল প্রানীকূলকে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের পর বর্ষা আসে তৃষিত হূদয়ে বারির ধারা নিয়ে। শুধু হূদয়েই নয়, প্রকৃতিতেও বৃষ্টির ধারা ছড়িয়ে দেয় সবুজের পরশ। গাছে গাছে সবুজ কিশলয় গজিয়ে ওঠে– করে প্রকৃতি-বন্দনা। সবুজ-শ্যামল রূপের যে উপমা– এই বর্ষাতেই তা সার্থকতা পায়। বৃষ্টি যেভাবে মানুষকে আকুল করে তা বোধ হয় অন্যকোন ঋতু করে না।
বৃষ্টির অঝোর ধারা মন রাঙিয়ে দেবেই। বর্ষায় যতদূর চোখ যায় দিগন্তজোড়া ঘন কালো মেঘ নেমে আসে মাথার ওপরে। খোলা প্রান্তরে মেঘের ডাকাডাকি, দুরন্ত বেগে নেমে আসা বৃষ্টির রূপ আজো অবাক বিস্ময়ের সৃষ্টি করে মানুষের হূদয়ে। টিনের চালে, দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠে, নদীর স্রোতধারায়– বৃষ্টির ফোঁটা যেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিলম্বিত রাগের একটানা বাজিয়ে চলেছে ধুন। বৃষ্টি, ঘন কালো মেঘ প্রকৃতির বিশালতাকে উপলব্ধি করার জন্য এক অমোঘ টানে আবিষ্ট করে মানুষকে।
ভ্যাপসা দুঃসহ গরমে হঠাত্ মেঘের দুদ্দাড় ছুটে আসা, দিগন্তজুড়ে মেঘের কালো ছায়া, দমকা হাওয়ায় ধানের খেতে উথাল-পাতাল দোল দেখে মন অকারণ খুশিতে ভরে উঠত। তুমুল বৃষ্টিতে গ্রামের মেঠো পথে মন রাঙীয়ে দেয়।
এ চরাচর জুড়ে অঝোর ধারার বৃষ্টি মোহগ্রস্ত করে তোলে। নিঃসঙ্গতা বোধকেও করে তোলে তীব্র। বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছেন:
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/ এ ভরা বাদর/ মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর/। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বর্ষায় বিরহ বেদনা নিয়ে লিখেছেন: শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/ বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে/ ভুলিও স্মৃতি মম নিশীথ স্বপন-সম/ আঁচলে গাঁথা মালা ফেলিও পথ-’পরে।
বিরহ ও বর্ষা কাব্যে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত একটি প্রধান স্থান দখল করে আছে। বুদ্ধদেব বসু এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এর প্রধান কারণ বোধহয় কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের সর্বগ্রাসী প্রতিপত্তি। .. পরবর্তী শ্রেষ্ঠ কবিরা বর্ষা-বিরহ সমন্বয়টিতেই অর্পণ করলেন তাদের মুগ্ধতা ও সৃষ্টিকল্পনা– কেমন আশ্চর্য সফলতার সঙ্গে। … বৈষ্ণব কবিদের রাধিকা, উজ্জয়িনীর মেয়েদের মতোই, বর্ষার রাত্রে অভিসারে বেরোন; আকাশে মেঘ উঠলে নায়ক-নায়িকার সঙ্গলিপ্সা বর্ধিত হয়… বর্ষার সঙ্গে প্রেম ও বিরহের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ স্থাপিত হ’য়ে গেছে। এই যে সাহিত্যিক ঐতিহ্য যুগ-যুগ ধ’রে গ’ড়ে উঠল, তার মধ্যে ‘মেঘদূতে’র প্রভাব অনস্বীকার্য।’
রৌদ্র-দগ্ধ ধানক্ষেত আজ তার স্পর্শ পেতে চায়, নদীর ফাটলে বন্যা আনে পূর্ণ প্রাণের জোয়ার।/ কাজী নজরুল ইসলাম প্রকৃতির বর্ণনা করেছেন এভাবে: রিমি রিমঝিম রিমঝিম নামিল দেয়া/ দেখি শিহরে কদম বিদরে’ কেয়া/ নামিল দেয়া/।
বর্ষায় সবুজ প্রকৃতির মাঝে অলঙ্কারের মত ফুটে ওঠে অসংখ্য ফুল। দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, বেলি, বকুল, হাসনা হেনা, জুঁই, কদম ফুলের মাতাল করা গন্ধ ভেসে বেড়ায় প্রকৃতিজুড়ে। বিরহী বর্ষা ফুলের গন্ধ-ব্যাকুল করা মনে কী যে অব্যক্ত দ্যোতনার সৃষ্টি করে তার হদিস পাওয়া ভার।
লেখক: নশ্বর সুজয়
সংস্কৃত কর্মী, সিডনি , অস্ট্রেলীয়া।।