দুর্লভ মনুষ্য জীবন
সুলেখা বড়ুয়া
বুদ্ধের ভাষায় – যিনি সহস্র যুদ্ধ জয় করেছেন তাঁর সেই জয় অপেক্ষা আত্নজয়ই শ্রেষ্ঠ । সেই আত্নজয় কেবল মনুষ্য জন্মকে বিশেষত : বৌদ্ধ কূলে জন্ম লাভকে অতীব দুর্লভ জন্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এক সময় শ্রাবস্তির জেতবনের অদূরে সপ্তশী নামক তরুমূলে তথাগত বুদ্ধ অবস্থান করেছিলেন । তখন এক লোক বুদ্ধকে বন্ধনা জানিয়ে এক পাশে বসে হাউ মাউ করে রোদন করিতে আরম্ভ করিল । তখন বুদ্ধ কান্নার কারণ জানতে চাইলে অত:পর তিনি কান্না থামিয়ে বলিলেন , হে তথাগত আমি বড়ই অভাগা । আমি মানুষ নই, শুধুই মানুষের মতো রুপ ধারণ করেছি কিন্তু দীর্ঘ ক্ষণ থাকতে পারবনা। সাপ হয়ে যাব । তখন ভগবান বললেন তাহলে তুমি কে ? ভগবান আমি দিব্য নাগরাজ , আমার নাম এরকাপত্র। বুদ্ধ বললেন, তুমি নাগরাজ হলে কিভাবে ? নাগরাজ বললেন, তথাগত , জগতে আপনার আভিরভাবের পূর্বে একজন সম্যক সম্বুদ্ধের আগমন হয়েছিল , তাহার নাম কাস্যপ বুদ্ধ । সেই কাস্যপ বুদ্ধের আয়ুকাল ছিল ২০ হাজার বছর । কাস্যপ বুদ্ধের সময়ে আমি ধ্যানী ভিক্ষু ছিলাম।আমার ও ২০হাজার বছর আয়ুকাল ছিল। একদিন ঘটনাক্রমে আমাকে বন্যার স্রোতে ভাসাইয়া লইয়া যাচ্ছিল। তখন আমি একখানি লাল খাগড়া ধরিয়া বন্যার স্রোত হইতে মুক্তি পাইবার চেষ্ঠা করেছিলাম । কিন্ত তাহা ছিড়ে গিয়ে আমাকে ভাসাইয়া লইয়া গেল ।
আয্যধর্ম পালনকারী ভিক্ষু-শ্রামনেরা কোন বৃক্ষ রোপণ করিতে পারেনা আবার তাহা আবার তাহা কাটিতে ও পারেনা। এমনকি ফুল , ফল, পাতা ও যেকোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যদি এ কর্ম সম্পাদন হইয়া থাকে , তাহা হইলে ঐ ভিক্ষু ,শ্রামনের থেকে অন্য ভিক্ষুর কাছে আপত্তি দেশনা করিতে হয়।অন্যথায় এ পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়না।
তারপর নাগরাজ বললেন, যখন আমি মৃত্যু শয্যায় শায়িত তখন আমার মনে পড়ে গেল , আমি তো এক সময় নল খাগড়ার আগা ছিঁড়ে ছিলাম , কিন্তু কোন ভিক্ষুর কাছে তো আপত্তি দেশনা করিনাই। তাতে তো আমার অকল্যাণ হবে, অকুশল হবে, হয়ত অপায়গতি ও হতে পারে, এরুপ চিন্তা করতে করতে যখন আমি উঠতে গিয়ে বার বার পড়ে গিয়েছি। কাহাকেও কথাটি বলতে পারলামনা এবং কোন ভিক্ষুর সাথে আর দেখা হলোনা । যার কারণে আমার ক্রোধ চিত্ত উৎপন্ন হয়েছিল তখন এই ক্রোধচিত্তে মিরতু হয়েছিল বলে আমি সর্প যোনিতে জন্ম লাভ করেছি পুনরায় মনুষ্য জন্ম অর্জন করিতে পারছিনা। সর্প যোনিতে জন্ম নিলে , বুদ্ধের সদ্ধর্ম আচরণ করা যায়না । সুতরাং নিজেকে মুক্ত করতে পারবোনা। এই অনুশোচনায় রোদন করিতেছি।
বুদ্ধ নাগরাজের কথা শুনিয়া উক্ত গাথায় তাহাকে উপদেশ দিলেন।
কিচ্ছো মনুসস পবিলাভো কিচ্ছ সচ্চনং জীবিতং
কিচ্ছং সদ্ধম সবনং কিচ্ছ বুদ্ধানং উপ্পাদে
অর্থাৎ – মনুষ্যত্ব লাভ করা কঠিন ব্যাপার
মিরথুশীল জীবনের রক্ষা কষ্ট আর,
পরম কষ্টেতে সাধ্য বুদ্ধত্ব অর্জন।
বুদ্ধের উপদেশ হইতে দেখা যায় যে মনুষ্য জন্ম লাভ করা অতিশয় কষ্টকর। মহান প্রচেষ্টা ও পূর্ব জন্মাজিত পূন্য প্রভাবে তাহা লাভ হয়। যে সেই অবস্থায় থাকুকনা কেন , শীল পালন না করিলে দুর্লভ মনুষ্য জন্ম লাভ করা এবং সুগতি ভূমি স্বর্গ লাভ করা যায়না । যেমন ধ্যানী ভিক্ষু হওয়া স্বত্তবে ও মারা যাওয়ার পর সর্পরাজ রূপে জন্ম হইল। আবার মানব জীবন লাভ করিয়া তাহা রক্ষা করাও কঠিন । সিদ্ধার্থ যখন বোধিজ্ঞান লাভ করেছিলেন তখন উনি জগতে ধর্ম প্রচারের কথা চিন্তা করিতেই নিরুৎসাহিত বোধ করেছিলেন কিন্ত সহম্পতি ব্রম্মার পুনঃ পুনঃ প্রার্থনায় ভগবান ধর্ম প্রচারে সম্মতি দিয়েছিলেন ।
তখন বুদ্ধের মনে এ চিন্তা উদিত হল- আমি সর্ব প্রথম কাহার নিকট এ ধর্ম উপদেশ করিব , কেহ কি তা বুঝিতে পারিবে ? পরক্ষনে তাহার মনে হয়েছিল যখন সিদ্ধার্থ গিহ ত্যাগ করার পর যাদের সঙ্গ পেয়েছিল , চলার পথের সেই সতীর্থ আরাঢ় কালাম ও রাম পুত্র রুদ্রক এর কথা । তথাগতের ইচ্ছা হল , বুদ্ধ ধর্মের নিগুঢ় তথ্য প্রথমে এদের নিকট প্রচার করিব।কিন্তু পরক্ষনে তিনি অবগত হলেন, তাদের একজন এক সপ্তাহ পূর্বে ও অন্যজন গত রাত্রে কালগত হয়েছেন।
এ ক্ষেত্রে অনুধাবন করা যায় , মনুষ্য জন্ম কত দুর্লভ , যেখানে স্বয়ং বুদ্ধ নিজেই যাদের কাছে প্রথম ধর্ম উপদেশ দেওয়ার প্রয়াস করেছিলেন , মনুষ্য জন্মে বেঁচে না থাকায় দিতে পারেনি। সুতরাং মানব জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী । মানব গনের আয়ূষ্কালের কোন নিদিষ্ট সময় সীমা নেই। মানব কূলে জন্ম গ্রহন করা মানে অতীতের অনন্ত অনন্ত পুণ্যফলেরই বহিঃপ্রকাশ । একমাত্র মনুষ্য জন্মেই বুদ্ধের স্বধর্মে বিদর্শন ভাবনা আচরণের মাধ্যমে নিজেকে সংস্কার মুক্ত করে পরম শান্তি নির্বাণ লাভ করা যায়।
নির্বাণ পরম সুখ।